জওহরলাল নেহরু এবং মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রীর নিয়ে এখনও চর্চা হওয়ার পেছনে কি কারন রয়েছে?
নিউজ ডেস্কঃ এডউইনা মাউন্টব্যাটেন এবং তার স্বামী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের যাবতীয় চিঠি এবং নথিপত্র গোপন রাখতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে ব্রিটিশ সরকার। WION-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে তাদের যাবতীয় ডায়েরী এবং ভারত ভাগের সমকালে তাদের দু’জনের মধ্যে আদান প্রদান হওয়া চিঠিপত্র সমস্ত কিছুই ব্রিটেন চিরকালের মতো ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে।
WION এর রিপোর্টে বলা হয়েছে অ্যান্ড্রু লোনি নামক এক লেখক নথিপত্রগুলি দেখার দাবি জানালেও, ব্রিটিশ সরকার একেবারেই সেগুলি জনসমক্ষে আনতে রাজি নয়। কিন্তু কেনো? মনে করা হচ্ছে ব্রিটিশ সরকারের আশঙ্কা এই নথিগুলো সামনে এলে তা ভারত, পাকিস্তান এবং ব্রিটেনের সম্পর্কে এক বড়সড় অবনতি ঘটাতে পারে।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে এডউইনা মাউন্টব্যাটেনের ‘বিশেষ’ সম্পর্ক গোপন কোনো খবর নয়। এমনকি অনেক বিশেষজ্ঞ তো এমনটাও মনে করেন যে নেহেরু এবং এডউইনার এই গোপন সম্পর্কের জন্য ভারতের জাতীয় স্বার্থকে অব্দি বিপন্ন করেছিলেন নেহেরু। WION এর প্রকাশিত রিপোর্টে উঠে এসেছে এডউইনার নেহরুকে লেখা একটি চিঠির কিছু অংশ। তিনি লিখেছিলেন, ” আপনাকে সকালে চলে যেতে দেখতে একেবারেই ভালো লাগে না আমার। এক অদ্ভুত শান্তি পাই আমি আপনার সন্নিগ্ধে। হয়তো, আপনার জীবনেও আমি কিছুটা শান্তি আনতে পারি ?”
লেখক অ্যান্ড্রু লোনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে মাউন্টব্যাটেন সম্পর্কিত যাবতীয় নথিপত্রগুলি প্রকাশ করার জন্য আবেদন করলে ব্রিটিশ তথ্যের স্বাধীনতা আইনের অধীনে সফলভাবেই সেগুলির বেশিরভাগই যোগার করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। তবে, ১৯৪৭- ১৯৪৮ সালের নথিপত্রগুলি সম্পর্কে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। এই নথিগুলির মধ্যে রয়েছে মাউন্টব্যাটেন দম্পতির লেখা বেশ কয়েকটি ডায়েরি এবং চিঠি।
WION এর রিপোর্ট অনুসারে, ব্রিটিশ সরকার এই নথিগুলিকে যে কোনো মতে রক্ষা করার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে রাজি। এখনো পর্যন্ত এই তথ্য রক্ষার্থে সরকার প্রায় ৬০০,০০০ পাউন্ড খরচ করেছে। ফলে, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে ঠিক কি এমন গুরুতর তথ্য লুকিয়ে আছে ওই নথিতে?
TOI এর প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় সম্প্রতি একটি ট্রাইব্যুনালের শুনানির সময় লোনিয়ারের আইনজীবী ক্লারা হ্যামার্স বলেছেন যে ১৯৪৭ সালের ১২ জুলাই লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ডায়েরি এন্ট্রি থেকে জানা যায় সেদিন তিনি সীমানা কমিশনের চেয়ারম্যান ব্রিটিশ বিচারক সিরিল র্যাডক্লিফ এবং তার সচিব ক্রিস্টোফার বিউমন্টের সাথে ডিনার করেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে পরের দিন থেকে লেখা যাবতীয় ডায়েরি এন্ট্রি ব্রিটিশ সরকার দ্বারা সংশোধিত হয়েছে। যা থেকে পরিষ্কার যে ওই বিশদ বিবরনে এমন কিছু আছে যা ভারত ও পাকিস্তানের সাথে ব্রিটেনের সম্পর্ককে বিপাকে ফেলতে পারে।
হ্যামার জানিয়েছেন ১৯৪৭ সালের ১২ জুলাই মাউন্টব্যাটেনের সাথে র্যাডক্লিফের যোগাযোগ হওয়ার কোনো রকম কথা একেবারেই কথা ছিল না। উল্লেখ্য, মাউন্টব্যাটেনর ১৯৪৭ সালের ৬ আগস্ট এর ডায়েরি এন্ট্রিটিকেও সংশোধন করা হয়েছে। বারংবার নথিপত্রের এরূপ সংশোধন ভারত ভাগে মাউন্টব্যাটেনের ভূমিকা এবং দেশভাগ পরবর্তী হিংসায় হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু সম্পর্কে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করে। একই সাথে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর আচরণ এবং এডউইনের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক সেই সময়ে ভারতের জাতীয় স্বার্থকে কতটা প্রভাবিত করেছিল সে সম্পর্কেও ওঠে প্রশ্ন।
গুরুত্বপূর্ণ এই নথিগুলো এতদিন ছিলো ইউনিভার্সিটি অফ সাউদাম্পটন লাইব্রেরিতে। টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুসারে, অবসরপ্রাপ্ত আর্কাইভিস্ট এবং ইউনিভার্সিটি অফ সাউদাম্পটন লাইব্রেরির কিউরেটর, ট্রাইব্যুনালের সামনে জানিয়েছেন যে তিনিই প্রথম ব্রিটিশ ক্যাবিনেট অফিসকে মাউন্টব্যাটেন সম্পর্কিত ডকুমেন্টের প্রকৃতি এবং সংবেদনশীলতা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন। নথিতে যোগ করা হয়েছে যে এতে ব্রিটিশ রাজপরিবার এবং ভারত বিভাজন সম্পর্কে এমন কিছু বিবরণ রয়েছে যা অহেতুক এতো বছর পর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করবে।
উলগার ট্রাইব্যুনালে বলেছেন যে মন্ত্রিপরিষদের অফিস ঘটনার গাম্ভীর্য বুঝে ঘন্টা তিনেকের মধ্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল এবং নথিগুলি যে সত্যিই সংবেদনশীল সে বিষয়েও একমত ছিলো ক্যাবিনেট অফিস।
নথিগুলি ব্রডল্যান্ডস আর্কাইভের একটি অংশ হিসাবে মোট ৪৫০০ টিরও বেশি বাক্সে সংরক্ষিত ছিলো। যার মধ্যে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ডায়েরির ৪৭টি ভলিউম এবং এডউইনা মাউন্টব্যাটেনের ৩৬টি ভলিউম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই নথিপত্রগুলি মাউন্টব্যাটেনের পারিবারিক সম্পত্তি ব্রডল্যান্ডস হাউসে রাখা হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে বিক্রি করা হয় সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। রিপোর্ট অনুসারে, সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় কয়েক মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করেছিলো কেবল সেই নথিগুলি ক্রয় করার জন্য।
ইউনিভার্সিটি অফ সাউদাম্পটন ও এডউইনা এবং নেহরুর মধ্যে আদান প্রদান হওয়া চিঠিগুলি জনসমক্ষে আনতে অস্বীকার করছে। তাদের দাবি ইউনিভার্সিটি কর্তপক্ষ কেবলমাত্র নথিগুলি সংরক্ষণের দায়ীত্বে রয়েছে, তারা এগুলোর মালিক নয়।
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য এই লর্ড লুই মাউন্টব্যাটেন আবার ছিলেন প্রিন্স ফিলিপের মামা এবং রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের দ্বিতীয় চাচাতো ভাই। ভারতের সাবেক এই গভর্নর জেনারেল যুক্তরাজ্যের রাজপরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ একজন সদস্য হওয়ার সাথে ছিলেন প্রিন্স চার্লসের অনেকটা পিতৃস্থানীয় একজন ব্যক্তি। ফলে, তথ্যগুলো সামনে এলে রাজপরিবারেও যে এর প্রভাব পড়বে সেকথা বলাই বাহুল্য।