ভারত

ভারতবর্ষের ব্রাহ্মসকেই সবথেকে ভয়ংকর মিসাইল কেন বলা হয় জানেন?

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের ব্যাপক প্রভাব আছে। রাশিয়া হোক কিংবা আমেরিকা বিশ্বের সব শক্তিশালী দেশের সাথেই ভারতের সুসম্পর্ক আছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে ৭৫ বছরে ভারত আন্তর্জাতিক স্তরে অনেক দেশের সাথেই কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। গুটি কয়কটি দেশ যেমন পাকিস্তান ও চীন ছাড়া মোটামুটি সব দেশের সাথেই ভাল সম্পর্ক আছে ভারতের তাও চীনের সাথে মজবুত বানিজ্য সম্পর্ক রয়েছে। যদি ভারতের সবচেয়ে ভাল বন্ধু দেশ কোনটি বলা হয় তাহলে অবশ্যই রাশিয়ার নাম সবার উপরে আসবে। ভারতের সবচেয়ে ভাল বন্ধু হিসাবে ইসরায়েল, রাশিয়া ও ফ্রান্সের প্রথন তিনে থাকবে কোন সন্দেহ নেই। রাশিয়া ও ভারতের সম্পর্ক আজ থেকে নয় সেই ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকে। তখন অবশ্য স্বাধীন রাশিয়া বলে কোন দেশ ছিলোনা। তখন ইউরোপে একটিই সুপার পাওয়ার দেশ ছিল যার নাম সোভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়। দুই দেশই বিশ্বে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। সেসময় আমেরিকার সাথে ভারতের শত্রু পাকিস্তানের ভাল সম্পর্ক তৈরি হয় অন্যদিকে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে বন্ধুত্ব তৈরি হয়৷ অস্ত্র, লোন, টেকনোলজিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল ভারতের বড় ভরসার নাম। ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে সোভিয়েত সাবমেরিনের কারনেই আমেরিকা পাকিস্তানকে সমর্থন করেনি। আজও ভারতের ৬০ শতাংশ প্রতিরক্ষা সামগ্রী রাশিয়া থেকেই আসে। ভারত রাশিয়ার বন্ধুত্বের আরও একটি বড় নিদর্শন ব্রাহ্মস প্রজেক্ট। 

ভারতের কনভেনশনাল যেসব মিসাইল আছে তাদের মধ্যে ব্রাহ্মস সবচেয়ে ঘাতক। কনভেনশনাল মানে যেসব মিসাইলে ওয়ারহেড হিসাবে পরমানু বোম্ব ব্যবহার করা হয়না। শুধু ভারতেরই নয় বরং বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির সুপারসনিক মিসাইল এই ব্রাহ্মস। ভারতের ব্রহ্মপুত্র এবং রাশিয়ার মস্কোভা নদীকে নিয়ে যৌথভাবে ব্রাহ্মস নাম রাখা হয়েছে। ব্রাহ্মস একটি সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল যাতে রামজেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। বাতাসে শব্দের গতি ৩৩২ মিটার/সেকেন্ড, একে ১ ম্যাক বলা হয়। কোন মিসাইলের গতি শব্দের গতির থেকে বেশী হয় তাহলে তাকে সুপারসনিক মিসাইল বলা হয়। যদি মিসাইলের গতি ১ ম্যাকের কম হয় তাহলে তাকে সাবসনিক মিসাইল বলা হয় এবং মিসাইলের গতি যদি ৫ ম্যাক অথবা তার বেশী হয় তাহলে তাকে হাইপারসনিক মিসাইল বলা হয়। অর্থাৎ সুপারসনিক মিসাইলের গতি ১ ম্যাকের বেশী কিন্তু ৫ ম্যাকের কম হবে। রামজেট ইঞ্জিন এক বিশেষ ধরনের ইঞ্জিন যা বাতাসকে ব্যাবহার করে মিসাইল বা কোন বিমানকে সুপারসনিক গতি অর্জন করতে সাহায্য করে। ভারতে ব্রাহ্মস মিসাইল তৈরি করে ব্রাহ্মস এরোস্পেস লিমিটেড, এটি ভারত ও রাশিয়ার যৌথ সংস্থা। 

ভারতের ডিআরডিও এবং রাশিয়ার এনপিও ম্যাসিনোসত্রোয়েনিয়া সংস্থা যৌথভাবে এই মিসাইল তৈরি করেছে। ম্যাসিনোসত্রোয়েনিয়া শব্দটা রাশিয়ান যার অর্থ মেশিনের রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট করা। এই দুটি সংস্থার যৌথ সংস্থা এই ব্রাহ্মস এরোস্পেস লিমিটেড। এই বছর সংস্থাটির ২৫ বছর পূর্তি হয়েছে। ১৯৯৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারিতে এই সংস্থাটি তৈরি হয়েছিল। এই যৌথ সংস্থায় ভারতের ৫০.৫ শতাংশ শেয়ার এবং রাশিয়ার ৪৯.৫ শতাংশ শেয়ার আছে। ভারত এই প্রজেক্টে ১২৬.২৫ মিলিয়ন ডলার এবং রাশিয়া ১২৩.৭৫ মিলিয়ন ডলার প্রাথমিকভাবে বিনিয়োগ করেছে। ২০০৪ সাল থেকে ব্রাহ্মসের বিভিন্ন পরীক্ষা করা হচ্ছে। রাজস্থানের পোখরানে ২.৮ ম্যাক গতিতে ব্রাহ্মসের পরীক্ষা করা হয়েছিল যা ভারতীয় সেনাবাহিনীর ল্যান্ড অ্যাটাক সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। ব্রাহ্মসকে তৈরি করা হয়েছিল অ্যান্টিশিপ মিসাইল হিসাবে কিন্তু এর ক্ষমতা দেখে ব্রাহ্মসকে ইউনিভার্সাল ক্রুজ মিসাইল হিসাবে তৈরি করা শুরু হয় অর্থাৎ যুদ্ধবিমান, ভূমি, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন সব জায়গা থেকেই এই মিসাইল লঞ্চ করা সম্ভব হবে। রাশিয়ার পি-৮০০ অনিক্সের উপর নির্ভর করে এই ব্রাহ্মস তৈরি করা হয়েছে। ২০১২ সালে ব্রাহ্মসের এয়ার লঞ্চড ভার্সন প্রথম তৈরি করা হয়। ২০১৬ সালে সুখোই-৩০ এমকেআই বিমানে প্রথম ব্রাহ্মসকে যুক্ত করা হয়। ২০০৮ সালে কেলটেক নামে একটি সংস্থাকে ১৫০০ কোটি টাকায় কিনে নেয় ব্রাহ্মস এরোস্পেস লিমিটেড। ভারতীয় সেনা ও নেভির জন্য ব্রাহ্মসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এখানে তৈরি করা হয়। রাশিয়া রামজেট ইঞ্জিন সহ ব্রাহ্মসের ৬৫ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ অংশ সরবরাহ করে। ভারতে ব্রাহ্মস মিসাইলের ৬৫ শতাংশ তৈরি করা হয় এবং লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এটা বেড়ে ৮৫ শতাংশ হবে।

ব্রাহ্মস প্রজেক্ট যখন শুরু করা হয় তখন এর গতি ঠিক করা হয়েছিল ২৯০ কিলোমিটার /ঘন্টা। তবে এর পেছনেও একটি গল্প আছে। ১৯৮৭ সালে বিশ্বের প্রথম সারির ৩৫ টি দেশ মিলে তৈরি হয় এমটিসিআর বা মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম নামে এক সংস্থা। এই সংস্থাটি গন বিধ্বংসী অস্ত্রের ক্ষমতা কমানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই সংস্থাটির একটি নিয়ম আছে যেই সব দেশ এই সংস্থাটির সদস্য নয় তারা ৩০০ কিলোমিটার বেশী রেঞ্জের মিসাইল অন্য কোন দেশ থেকে কিনতে পারবেনা। ১৯৯৮ সালে এই সংস্থায় রাশিয়া যুক্ত ছিল ভারত ছিলনা সেজন্য ভারত তখন রাশিয়ার সাহায্যে ৩০০ কিলোমিটারের বেশী রেঞ্জের মিসাইল তৈরি করতে পারতনা। তবে ২০১৬ সালে ভারত এই সংস্থার সদস্য হয়। সেজন্য এখন ভারত ব্রাহ্মস ২ নামে আরও একটি অ্যাডভান্সড ভার্সন তৈরি করছে যার গতি ৭-৮ ম্যাক হবে অর্থাৎ হাইপারসনিক ব্রাহ্মস মিসাইল এবং এর রেঞ্জ হবে ৬০০ কিলোমিটার। এই প্রজেক্ট ২০২৪ এর মধ্যে সম্পন্ন হয়ে যাবে। ২০০১ সালের ১২ জুন প্রথম বারের জন্য ব্রাহ্মস মিসাইলের টেস্ট করা হয় ওড়িশার চাঁদিপুর থেকে। এরপর ২০০৪ সালে টেস্ট হয় এবং ২০০৮ সালে আইএনএস রাজপুত ও আইএনএস রনভীর ডেস্ট্রয়ার থেকে ব্রাহ্মসের সফল পরীক্ষা করা হয়। এরপর এখনও পর্যন্ত ৬১ বার ব্রাহ্মস মিসাইলের টেস্ট করা হয়েছে। একটি ব্রাহ্মস মিসাইলের ওজন সাধারনত ৩০০০ কেজি। এটি ৩০০ কেজি ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম এবং এর গতি ৩ ম্যাকের বেশী। এয়ার, সমুদ্র ও ল্যান্ড ভার্সন ব্রাহ্মসের রেঞ্জ যথাক্রমে ৩৫০ কিলোমিটার, ৬০০ কিলোমিটার ও ৭০০ কিলোমিটার। তবে অন্যকোন দেশকে বিক্রি করতে গেলে সেই ভার্সনের রেঞ্জ ২৯০ কিলোমিটারই থাকবে। যেমন কীছুদিন আগে ব্রাহ্মসের জন্য ফিলিপিন্স ও ভারতের মধ্যে ২৫০০ কোটি টাকার চুক্তি হয়। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম সহ বেশ কীছু দেশ ব্রাহ্মস কিনতে আগ্রহী। ব্রাহ্মস এরোস্পেস লিমিটেডের বক্তব্য তারা অদূর ভবিষ্যতে অন্তত ১৩ বিলিয়ন ডলারের ব্রাহ্মস মিসাইল বিক্রি করবে। ব্রাহ্মসের বেশ কীছু ভার্সনের উপর কাজ চলছে:–

১) ব্রাহ্মস ২ :– হাইপারসনিক ব্রাহ্মস যার রেঞ্জ ৬০০ কিলোমিটার। 

২) ৮০০-১৫০০ কিলোমিটার রেঞ্জের একটি ব্রাহ্মস ভার্সন তৈরির কাজ চলছে। ২০২০ সালের ২৪ নভেম্বর ডিআরডিও ৮০০ কিলোমিটার রেঞ্জের ব্রাহ্মস মিসাইলের সফল পরীক্ষা করেছে।

৩) ব্রাহ্মস এনজি:– এটি আগের ব্রাহ্মস ভার্সন গুলোর থেকে অন্তত ৫০ শতাংশ হালকা। সাবমেরিন সহ ভারতের একাধিক যুদ্ধবিমান থেকে একে লঞ্চ করা সম্ভব হবে। এর গতি ৩.৫ ম্যাক হবে।

৪) ড্রোন থেকে লঞ্চের জন্যও আলাদা একটি ভার্সনের উপর কাজ হবে সম্ভবত।

ভারতের কাছে এই মহূর্তে কতগুলি ব্রাহ্মস আছে তা কোনদিনই প্রকাশ করা হবে না কারন এগুলো খুবই গোপন ব্যাপার। তবে ভারতীয় বায়ুসেনা ৮০০০ কোটি টাকার বিনিময়ে ৪০০ মিসাইল অর্ডার দিয়েছে  উত্তর প্রদেশে ব্রাহ্মস তৈরির জন্য আলাদা একরি কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে। একটি ব্রাহ্মস মিসাইলের দাম প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার বা ৪০ কোটি টাকা প্রায়।

ব্রাহ্মস প্রজেক্টের জন্য রাশিয়াকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল কারন রাশিয়ার মিসাইল টেকনোলজি, সাবমেরিন টেকনোলজি এবং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম খুবই অ্যাডভান্সড। ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রিটেন ও আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। সেসময় ভারতকে ভয় দেখাতে আমেরিকা তার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সাথে সাথে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের নিউক্লিয়ার সাবমেরিন পাঠিয়ে দিয়েছিল যার কারনে আমেরিকা ভয়ে চলে যায়। ফলে যুদ্ধে ভারত জিতে যায় এবং পাকিস্তানকে ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়। তখন থেকেই সোভিয়েত টেকনোলজির উপর ভারতের ভরসা বেড়ে যায়। এই ধরনের অ্যাডভান্সড টেকনোলজি রাশিয়া ছাড়া আর কারও কাছে পাবেও না ভারত। 

ভারত ও রাশিয়ার বন্ধুত্ব বানিজ্য ছাড়াও মূলত পাঁচটি সেক্টরে রয়েছে। প্রতিরক্ষা, মহাকাশ গবেষনা, জঙ্গি দমন, সিভিল নিউক্লিয়ার এনার্জি ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি। রাশিয়া থেকেই ভারত তার সিংহভাগ প্রতিরক্ষা সামগ্রী ক্রয় করে। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারত সেবছর তার মোট অস্ত্রের ৬৮ শতাংশ রাশিয়া থেকে কিনেছে। শুধু ব্রাহ্মসই না সুখোই-৩০ এমকেআই বিমান, হেলিকপ্টার, পরিবহন বিমান, ফ্রিগেট, সাবমেরিন, এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, একে-২০৩ বন্দুক সহ ভারতের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে রাশিয়া বিরাট ভাবে জড়িত। রাশিয়া ও ভারতের সম্পর্ক এতটাই মজবুত যে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ চলাকালীন সময়েও আমেরিকা ও পশ্চিমাদের অনেক বারন করা সত্বেও ভারত রাশিয়া থেকে কম দামে তেল কিনছে। যখন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে বলা হয় ভারত তেল কিনে রাশিয়াকে যুদ্ধে অর্থায়ন করছে যাতে ইউক্রেনের রক্ত লেগে আছে, জবাবে জয়শঙ্কর জানিয়েছেন ইউরোপ নিজেও গ্যাস কেনে রাশিয়ার থেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.