পৃথিবী

ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতবর্ষের সম্পর্ক এতো ভালো হওয়ার পেছনে কি কারন রয়েছে?

ভারতবর্ষ এবং ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। দুই দেশের সম্পর্ক যদিও এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। তবে একটা কথা না বললেই নয় যে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সত্যিকারের বন্ধু খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। কারণ সম্পর্কের মধ্যে কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়, এইভাবেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চলে। সেক্ষেত্রে ইসরায়েলের সাথে ভারতবর্ষের সম্পর্ক একদমই তেমন নয়। কার্গিলের যুদ্ধে ইসরায়েল ভারতবর্ষকে সাহায্য না করলে আজ পরিস্থিতি অনেক আলাদা হত বলে মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু ইসরায়েলের সঙ্গে ভারতবর্ষের এতো ভালো সম্পর্ক কেন?

দুই দেশ এতো ভালো সম্পর্ক হলেও স্বাধিনতা এসেছিল দুইরকম ভাবে। এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সেভাবে কোনও মিলই নেই। ১৯৪৭ সালে দুভাগ হয়ে তৈরি হয়েছিল ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তান, অন্যদিকে ১৯৪৮ সালে প্যালেস্তাইনকে সরিয়ে ইসরায়েলের জন্ম হয়। তবে এদিক থেকে দেখতে গেলে ইসরায়েলের সাথে পাকিস্তানের অনেক মিল ছিল, কারণ দুটি দেশেরই জন্ম হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে। একদিকে ইহুদিদের জন্য নতুন দেশ ইসরায়েলের জন্ম হয়, অন্যদিকে মুসলিম রাষ্ট্র হিসাবে তৈরি হয় পাকিস্তান। সেদিক থেকে এই দুটি দেশের মধ্যে বেশ কিছুটা মিল রয়েছে। প্যালেস্তাইনকে সরিয়ে এইভাবে ইসরায়েল তৈরি হওয়ার ঘটনা অনেকে মেনে নিতে পারেননি। পাকিস্তানের জন্ম ঠিক তেমন ভাবেই হয়েছিল “ লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান”। আর সেই কারণে প্রথম দিকে ইসরায়েলকে মেনে নিতে কিছুটা হলেও অসুবিধা হয়েছিল নেহেরু, গান্ধিজির মতো নেতাদের ক্ষেত্রে।

স্বাধিনতার পর ভারতবর্ষ হয়ে উঠেছিল ধর্ম নিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান হয়ে ওঠে ইসলামিক রিপাবলিক বা মুসলিম প্রজাতন্ত্র। অন্যদিকে ইসরায়েল নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত দিলেও আরবের মুসলিমদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করে রাখা হয়। ভারতবর্ষের প্রধান মন্ত্র ছিল অহিংসা, অন্যদিকে ইসরায়েলকে অন্য পথ বেছে নিতে হয়েছিল। আর এই কারনের জন্য অর্থাৎ মতাদর্শের দিক থেকে দুটি রাষ্ট্র দুরকম ছিল।

২০০০ বছর পর ইহুদিদের জন্য নতুন কোনও রাষ্ট্রের ঘোষণা করা হয়, যেখানে গিয়ে গোটা আরবে ছরিয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদিরা অবাধে নাগরিকত্ব পায়।

১৯৬৭ সালে আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধে বাজে ভাবে পরাজিত হয় আরবের দেশ গুলি। ইসরায়েল একাই বাকি দেশ গুলিকে দমিয়ে রাখে। বিশেষ করে ইসরায়েলের টেকনোলোজির কাছে সকলকে মাথা নথ করতে বাধ্য হয়। আর এই যুদ্ধের পর গোটা পৃথিবীতে মুসলিম বিরোধী ভাবমূর্তি তৈরি হয় ইসরায়েলের। আর সেই কারণে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে কিছুটা সমস্যায় পরে ভারতবর্ষ। কারণ সেইসময় ভারতবর্ষে মুসলিম মানুষের সংখ্যাটা ছিল অনেক, ফলে ইসরায়েলের সাথে ভারতবর্ষের দুরত্ত্ব স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে যায়। তবে শুধু এই একটি কারণ নয় এর পাশাপাশি ছিল আন্তর্জাতিক সমস্যাও। আসলে সেইসময় আরবের দেশ গুলির থেকে তেল ক্রয় করার ব্যাপারে ভারতবর্ষ এবং পাকিস্তান মরিয়া হয়েছিল। আরব দুনিয়াতে নিজেদেরকে প্রমান করতে ভারত এবং পাকিস্তান দুই দেশই আগ্রহী ছিল। আসলে তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের কারণে আরবের সাথে সম্পর্ক মজবুত করা জরুরি হয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষের। তবে তলে তলে ইসরায়েলের জন্মের পর থেকেই তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা শুরু করে ভারতবর্ষ।

১৯৯০ সালের পর ইসারায়েলের সাথে সম্পর্ক সরাসরিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতবর্ষের। পি ভি নরসিংহ রাও ইসরায়েলের সঙ্গে পুরোপুরিভাবে সম্পর্কে স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও এর পেছনে একাধিক কারণ ছিল। সবথেকে বড় কারণ হল সেইসময়য় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়, আর তার ফলেই বেড়ে যায় আমেরিকার একনায়কতন্ত্র। নতুনভাবে সরকার চালনা শুরু করেন জর্জ এইচ ডবলু বুশ। আর সেই কারনেই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক রাখা আরও বেশী জরুরি হয়ে পরে। তাই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক তৈরি করতে আসতে আসতে এগিয়ে যেতে থাকে ভারতবর্ষ।

সবথেকে বড় ব্যাপার হল অস্ত্র। কারণ ভারতবর্ষের অস্ত্রের ৯০ শতাংশের উপর আসত সোভিয়েত থেকে। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর কিছুটা হলেও চিন্তিত হয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষ। সবথেকে বড় ব্যাপার হল এই যে পশ্চিমের দেশ গুলি চট করে অস্ত্র দিতে চায়না এবং দিলেও প্রচুর দাম হাকিয়ে বসে। সেই কথা মাথায় রেখেই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক আরও গভীর হয়, কারণ তারাই অস্ত্র দেওয়ার পাশাপাশি অস্ত্রের টেকনোলোজি দিতেও কোনও আপত্তি করেনি। ১৯৯২ থেকে ২০২২ এই ৩০ বছরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির নতুন নতুন সমীকরণ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে মধ্য প্রাচ্য থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়াতে নতুনভাবে সম্পর্ক তৈরি করেছে একাধিক দেশ।

শুধু যে এই কারণ গুলি প্রধান ছিল তা কিন্তু নয়, ১৯৯১ সালের অর্থনীতিক মন্দাও একটা বড় কারণ হয়ে ওঠে। সেইসময় সোভিয়েত ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে ভারতবর্ষের বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, বিশেষ করে সোভিয়েতের অস্ত্র গুলির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য স্পেয়ার পার্টস এবং হাতে অর্থ না থাকার ফলে কিছুটা হলেও কম দামে ভারতবর্ষ অস্ত্র ক্রয় করতে পারবে। ঠিক এইভাবেই ভারতবর্ষের প্রধান ভরসা হয়ে ওঠে ইসরায়েল। তারা নিজেরাই অস্ত্র বিক্রি করার জন্য অফার করে এবং তা ভারতবর্ষ কমদামেই পেয়ে যায়।

তবে কি শুধু অস্ত্র ব্যবসা বা আন্তর্জাতিক সমীকরণের ফলেই দুই দেশ একে ওপরের কাছে এসেছিল? আসলে এর পেছনে ছিল একাধিক কারন। প্রধানত তিনটি কারণকেই দায়ী করা হয় একে ওপরের কাছে আসা নিয়ে। তবে প্রথমের যে কারণটি সবার সামনে আসে তাহল টেকনোলোজি। পৃথিবীর বাকি দেশ গুলির থেকে টেকনোলোজির দিক থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিল ইসরায়েল। কারণ খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ইসরায়েল কৃষি ক্ষেত্রে বিরাট উন্নতি করে। তারা কৃষি ক্ষেত্রে তাদের টেকনোলোজি ব্যবহার করে যা গোটা পৃথিবীর কাছে এক দৃষ্টান্ত। 

মরুভুমিতেও যে চাষ করা যায় তা করার ফলে চমকে যায় গোটা বিশ্ব। আর সোজা কথায় ভারতবর্ষের সেই সময় এই ধরনের প্রযুক্তির ভীষণভাবে দরকার হয়ে পরে। বিশেষ করে কোন জমিতে কি চাষ করা যায়? কতোটা জল দেওয়া যাবে সেই জমিতে? জমিতে কতোটা ফসল উৎপন্ন হবে? ড্রোন দিয়ে তার ল্যান্ড ম্যাপিং করা। শুধু তাই নয় “ কাটিং এজ টেকনোলোজি”। এই ধরণের টেকনোলোজি ইউরোপের কাছে ছিল, কিন্তু ইউরোপের দেশ গুলি চট করে এই ধরনের টেকনোলোজি দিতে অস্বীকার করে, যা সহজেই ভারতবর্ষকে দেয় ইসরায়েল। 

বর্তমানে পরিস্থিতি বদলেছে, মতাদর্শ এখন আর এতোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর সেই কারনেই আরবের দেশ গুলির সাথে ভারতবর্ষের সাথে সম্পর্ক বেশ ভালোভাবেই টিকে রয়েছে। সবথেকে বড় ব্যাপার হল এই যেভাবে পেট্রো পন্যের দাম এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম পরছে যার ফলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের মতো বড় মাপের ক্রেতাকে কেউ ছাড়তে চাওয়ার মতো ভুল করবেনা। শুধু ইসরায়েলের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করার জন্য এই ধরনের সিদ্ধান্ত এখন আর আরবের মতো দেশ গুলি নেবেনা। অন্যদিকে আবার নিজেরাই এখন ইসরায়েলের থেকে টেকনোলোজি নিতে চাইছে আরব।

ভারতবর্ষ এবং ইসরায়েলের একে অপরকে বিশেষভাবে প্রয়োজন। বিগত ৩০ বছরে ইসরায়েলের সাথে ভারতবর্ষের ব্যবসা বেড়েছে অনেকটাই। ২০ কোটি টাকা থেকে ব্যবসা শুরু হলেও বর্তমানে ভারতবর্ষের সাথে ইসরায়েলের ৮ বিলিয়ন ডলারে ব্যবসা পৌঁছেছে। আর ইসরায়েলের সাথে ব্যবসায় সামরিক অস্ত্রের থেকেও বেশী গুরুত্ব বর্তমানে দেওয়া হচ্ছে টেকনোলজির ক্ষেত্রে। কৃষি ক্ষেত্রে থেকে শুরু করে সাইবার সিকিউরিটিতে ভারতবর্ষকে বর্তমানে বিরাটভাবে সাহায্য করছে ইসরায়েল। অন্যদিকে তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস বিক্রি করার ক্ষেত্রে ভারতীয় বাজারকে বিশেষভাবে দরকার আরবের দেশ গুলির। ভারতবর্ষ এবং ইসরায়েলের সংস্কৃতির আদানপ্রদান অনেক আগে থেকেই রয়েছে বমে মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.