বিজ্ঞান বনাম ধর্ম! এই যুদ্ধে এগিয়ে কে?
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন ধর্মকে বাদ দিয়ে বিজ্ঞানের অর্থ খোঁজা বোকামি এবং ধর্ম বিজ্ঞান ছাড়া অন্ধ। অর্থাৎ দুজনেই একে অপরের পরিপূরক কিন্তু বিজ্ঞান সবসময় প্রমান খোঁজে কিন্তু মানুষের মন ধর্মে আকৃষ্ট। সেজন্য ধর্ম ও বিজ্ঞান একসাথে যায়না। তাহলে বিজ্ঞান নাকী ধর্ম কোনটা বেছে নেওয়া উচিৎ? ধর্ম ও বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো এবং এটা চলতেই থাকবে। আধুনিক অতি শিক্ষিত মানুষরা বলবেন ধর্মের নামে সব ধর্মেই পশুবলি দেওয়া হয় যেমন নেপালের গড়িমাই উৎসবে প্রতিবছর ২,৫০,০০০ পশু বলি দেওয়া হয়, মুসলিমদের কুরবানী কিংবা হিন্দুদের কালী পূজোয় পশুবলি এখনো চলছে। কিন্তু বিজ্ঞানও তো প্রত্যহ বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য অসংখ্য প্রানীর জীবন নষ্ট করছে বা তাদের বিকলাঙ্গ বানিয়ে দিচ্ছে! পশু হত্যা দুদিকেই হচ্ছে, তাহলে ঠিক কে, ভুল কে! প্রত্যেকটা বিষয়ে ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের দ্বন্দ্ব রয়েছে। যেমন আমেরিকার মহাকাশ গবেষনা সংস্থা নাসার দাবি ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিস্ফোরনের মাধ্যমে। কিন্তু বিভিন্ন ধর্মে ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি বিভিন্ন ভাবে বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে বলা হয়েছে ভগবান ব্রহ্মা এই ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেছেন তাঁর হাতের পদ্মফুল দিয়ে, ইসলাম মতে মহান আল্লা এই বিশ্ব সৃষ্টি কর্তা, খ্রীষ্টান, জৈন, বৌদ্ধ ধর্মে আলাদা ব্যাখা আছে। তাহলে এর সঠিক প্রমান কোন পক্ষে আছে!! এবিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে যার মূল লক্ষ্য বিজ্ঞান বনাম ধর্ম।
হিন্দু ধর্মের মহাগ্রন্থ শ্রীমদ ভগবদগীতা ও বেদ অনুযায়ী আমরা এখন ভগবান ব্রহ্মার ৫১ তম বছরের প্রথম দিনে রয়েছি। এটা হয়ত অনেকের কাছে জটিল মনে হবে একটু বুঝিয়ে বলা যাক। হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী পৃথিবীর সৃষ্টি ও প্রানের সঞ্চার ব্রহ্মাজীই করেছেন কিন্তু ব্রহ্মাজী অন্যান্য দেবতার মতন অমর নন ওনারও মৃত্যু আছে। দেখুন এটা হয়ত অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে কিন্ত যেসব কথা বলা হচ্ছে সবই শাস্ত্রে লেখা আছে। বলা হয় ব্রাহ্মাজীর মোট জীবনকাল ১০০ বছর। হিন্দু ধর্মে ত্রিদেবের মধ্যে শুধুমাত্র ভগবান শিব ও ভগবান বিষ্ণুকেই অমর বলা হয়। বাকী সমস্ত দেবতার নির্দিষ্ট সময় পর মৃত্যু হয়। তবে এখানে ১০০ বছর শুনে মোটেও সাধারন হিসাব করবেন না, ব্রহ্মাজীর সময় মানুষের সময়ের হিসাবের সাথে যায়না। ব্রহ্মার একবছর সমান পৃথিবীর হিসাবে ৩.১১ বিলিয়ন বছর! সুতরাং এই হিসাবে আমাদের পৃথিবী ১৫৫.৫২ ট্রিলিয়ন বছর আগে তৈরি হয়েছিল কারন ব্রহ্মার জন্মের সাথে বিশ্ব তৈরি হয়েছিল এবং ব্রহ্মার মৃত্যুর সাথেই বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে। ব্রহ্মার মোট জীবনকাল পৃথিবীর হিসাবে ৩১১.০৪ ট্রিলিয়ন বছর। প্রাচীন কালে ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞান প্রচুর উন্নত, এসবই তখন গুরুকূলে শেখানো হত কিন্তু সেই জ্ঞান আমাদের কাছে পৌঁছানোর পূর্বেই ধ্বংস হয়ে যায়। হয়ত ভবিষ্যতে নতুন কোন সভ্যতা তৈরি হবে সেখানে এখনকার উন্নত বিজ্ঞান পৌঁছাবেই না। এটা তো গেল ধর্মের কথা এবার বিজ্ঞানের তথ্য অনুযায়ী মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে জানা যাক। বিজ্ঞানের ভাষায় ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছে বিগ ব্যাং থিওরি অনুযায়ী। মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কে অধ্যয়নকে কসমোলজি বলা হয়। শুরুতে সবকিছু উচ্চ চাপ ও উচ্চ উষ্ণতায় একটি বিন্দুর মধ্যে ছিল। বিগ ব্যাং থিওরি অনুযায়ী আজ থেকে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বা ১৩৮০ কোটি বছর আগে এক বিশাল বিস্ফোরনের মাধ্যমে সেই বিন্দু থেকে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর ধীরে ধীরে সম্প্রসারনের মাধ্যমে এবং শীতল হয়ে পৃথিবী গঠিত হয়। বিগ ব্যাং থিওরির জনক রাশিয়ান বিজ্ঞানী ফ্রিডম্যান। বলা হয় তখন থেকে সময়ের উৎপত্তি, যার ব্যাখা স্টিফেন হকিং তার বই এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ টাইম ফ্রম বিগ ব্যাং টু ব্ল্যাক হোলে দিয়েছেন।
২০১৬ সালে নাসা হাবাল টেলিস্কোপের সাহায্যে এই বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো নক্ষত্রমন্ডলকে খুঁজে বের করেছে যার নাম রাখা হয়েছে জিএন-জেড১১. এই নক্ষত্রমন্ডল ১৩.৪ বিলিয়ন বছরের পুরোনো এবং এটি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। এটা দেখেই বিজ্ঞানীদের ধারনা ব্রহ্মান্ড ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে তৈরি হয়েছিল। বিস্ফোরনের পর ধ্বংসাবশেষে গতিকে গননা করলে বিস্ফোরনের সময়কাল সম্পর্কে জানা যায় অর্থাৎ বিজ্ঞানের কাছে ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির প্রমান রয়েছে। আজ থেকে তিন লাখ বছর আগে আমাদের পূর্ব পুরুষ আদিম মানুষেরা বা হোমো সেপিয়েন্স ও নিয়েন্দার থালসরা তাদের মৃতদেহ রীতিমতো নিয়ম মেনে কবর দিত অর্থাৎ তখনও ধর্ম ছিল। এই ধর্মের উৎপত্তি হল কীভাবে? কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনা অনুযায়ী আদি মানুষরা যখন সংঘবদ্ধ ভাবে থাকতো তখন জীবন যাপনের জন্য কিছু নিয়ম তৈরি করা হয়েছিল যা পরে ধর্মের রূপ নেয়।
হিন্দু ধর্মের রামায়ন, মহাভারত থেকে অহিংসা, শত্রু দমন, মানুষের কল্যান অর্থাৎ সঠিক জীবন যাপনের শিক্ষা পাওয়া যায়। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে প্রাচীন ভারতে, মেসোপটোমিয়া, মিশরে আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা হয় প্রকৃতির কারনে। প্রকৃতিকে কাজো লাগিয়ে কীকরে বেঁচে থাকা যায় তার থেকেই বিজ্ঞানের জন্ম। চার শতাব্দীতে বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বলেছিলেন মানুষের কৌতূহল থেকেই বিজ্ঞানের জন্ম হয়েছে। অজানাকে জানার মানুষের এই প্রচন্ড কৌতুহলের কারনে মানুষের মাথা থেকে বিজ্ঞান বেরিয়েছে। যে মানুষের কৌতুহল যত বেশী তার ডিপ্রেশন তত কম অর্থাৎ কৌতুহল মানুষের ডিপ্রেশনের ওষুধ রূপে কাজ করে কিন্তু অতিরিক্ত কৌতুহল অনেক সময় মানুষের ক্ষতিও করে। যেমন রক গায়ক স্টিভ লুডিন বিষ থেকে বাঁচতে ৩০ বছর ধরে সাপের বিষের অ্যান্টি ভেনম নিত, এগুলো একধরনের পাগলামী। বিজ্ঞান শুধুমাত্র অতিরিক্ত বুদ্ধিমান কিছু মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ কিন্তু ধর্মবিশ্বাস পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যেই রয়েছে। ধর্ম মানুষকে বেঁধে রেখে সমাজের মধ্যে সুস্থ ভাবে বাঁচতে শেখায় কিন্তু যদিও এখন ধর্মের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যার্থ হয়েছে মানুষ এখন ধর্মের কারনে বিভক্ত ও হানাহানিতে মেতে উঠেছে।
প্রাচীন যুগে হিন্দু ধর্মে, গ্রীক, রোমান ধর্মে প্রকৃতিকে পূজো করা হত। যেমন হিন্দু ধর্মে সূর্য, চাঁদ, পৃথিবী, বায়ু, অগ্নি সবের পূজো করা হয়। শুধু তাই নয় বিশেষ বিশেষ দেবতার সাথে কোন প্রানীকে তার বাহন হিসাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যেমন গনেশজীর বাহন ইঁদুর, কার্ত্তিকের বাহন ময়ূর, বেড়ালকে মা ষষ্ঠীর বাহন এরকম প্রায় সব প্রানীর সাথেই কেননা কোনও প্রানী রয়েছে। আসলে এর অর্ন্তনিহিত অর্থ ছিল যে মানুষ যাতে অহেতুক হিংসার বশবর্তী হয়ে কোন প্রানীকে হত্যা না করে। কিন্তু সব ধর্মেই কিছুনা কিছু গোঁড়ামি বা কুসংস্কার আছে যার থেকে মুক্তি একমাত্র বিজ্ঞানই দিয়েছে, তবে এর জন্য অনেক বড় মূল্যও চোকাতে হয়েছে। ১৬৩২ সালে ইটালির বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও একটি বইয়ে লিখেছিলেন সূর্য নয় বরং পৃথিবী সহ সব গ্রহ সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। কিন্তু এই কথা তখনকার গির্জা ও স্থানীয় মানুষরা পচ্ছন্দ করেনি। কারন তখনকার মানুষ বিশ্বাস করত বাইবেল অনুযায়ী পৃথিবী স্থির বরং সূর্য তার চারদিকে ঘুরছে। যার জন্য গ্যালিলিওকে ধর্ম বিরোধী আখ্যা দিয়ে শাস্তি হিসাবে আজীবন গৃহবন্দী রাখা হয়। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে জাতপাত, সাদা কালো, ধনী গরীব কিছু দেখা হয় না, যদি কারও বুদ্ধি থাকে এবং সে যদি তার কথা বা আবিষ্কার প্রমান করতে পারে তবে তা সাথে সাথে মেনে নেওয়া হয়। তবে বিজ্ঞানেরও কালো অধ্যায় আছে। প্রতি বছর বিভিন্ন পরীক্ষার কারনে প্রায় ১০০ মিলিয়ন পশুকে হত্যা করা হয় যার মধ্যে পাখি, ইঁদুর, ব্যাঙ, কুকুর, বেড়াল, বাঁদর সব আছে। যদি বিচার করা হয় তাহলে বিজ্ঞানের পরীক্ষার জন্য ধর্মের তুলনায় বেশী পশু হত্যা করা হয়েছে। এই হিসাবে বিচার করে দেখতে গেলে ধর্ম ও বিজ্ঞান একই সাথে ওতপ্রত ভাবে যুক্ত, একটি ছাড়া আরেকটির অস্তিত্ব নেই। বিজ্ঞানের যেখানে শেষ সেখান থেকেই ধর্মের শুরু। পৃথিবীর প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বেদে এমন সব তথ্য রয়েছে যা বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করছে। প্রাচীন ভারতের স্থাপত্য শিল্প, জ্যোতিষ জ্ঞান আাধুনিক বিজ্ঞানকেও অবাক করে দেয়। ভারতীয় যোগশাস্ত্রে এমন এমন যোগ ও তার কার্যকারিতা সম্পর্কে বলা হয়েছে যার কোন ব্যাখা নেই বিজ্ঞানের কাছে। সুতরাং ধর্ম নাকী বিজ্ঞান এই দ্বন্দ্ব চলতেই থাকবে, যে যেভাবে বিশ্বাস করবে তার উপর নির্ভর করবে।