পৃথিবী

ইউক্রেনেই ঘটেছিল বিশ্বের সবথেকে বড় পরমানু বিপর্যয়। অবাক করা অজানা ইতিহাস

রাজেশ রায়: ২৬ এপ্রিল, ১৯৮৬ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ানক পরমানু দুর্ঘটনা ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রিপেয়াত শহরের কাছে চেরনোবেল পরমানু কেন্দ্রের চার নম্বর রিয়্যাক্টারে বিস্ফোরন হয় যাতে রিয়্যাক্টারের কোর ফেটে যায় এবং ভেতরে থাকা কয়েক টন রেডিও অ্যাক্টিভ ইউরেনিয়াম বাইরে চলে আসে। এরপর শুরু হয় ভয়ানক ধ্বংসলীলা। লাখ লাখ লোক আক্রান্ত হয়। ইউক্রেনের পাশাপাশি বেলারুশ এবং জার্মানির লোকও এর ফল ভোগ করে। হিরোশিমা ও নাগাসাকি তে যে পরমানু বোম্ব ফেলা হয়েছিল তার থেকে চেরনোবেল দুর্ঘটনার রেডিয়েশন ৪০০ গুন বেশী ছিল!! তাহলে বুঝতেই পারছেন এর ফল কতটা ঘাতক হয়েছিল! কী কারনে এই ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটেছিল, এর জন্য দায়ী কে! এই ব্যাপারেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

মানুষ তার লোভ ও লালসার জন্য কতটা নীচে নামতে পারে চেরনোবেল দুর্ঘটনা তার বাস্তব উদাহারন। এই ভয়ানক রেডিয়েশনের কারনে প্রিপেয়াত শহরের আশেপাশে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে আগামী কয়েকশো সাল কেউ বাস করতে পারবে না। সময়টা ১৯৮০ এর দশক, সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল। এখানে একটা কথা জানা দরকার সেসময় ইউক্রেন বলে স্বাধীন কোন দেশ ছিলনা। সেসময় রাশিয়া, ইউক্রেন যৌথভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে একটি দেশ ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে আলাদা দেশ তৈরি হয় তখন ইউক্রেন স্বাধীন দেশ হয় এবং রাজধানী হয় কিয়েভ। এই কিয়েভের কাছেই চেরনোবেল অবস্থিত। ১৯৭০-৮০ থেকে আমেরিকার অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিতে পাচ্ছিলনা সোভিয়েত ইউনিয়ন। আমেরিকার একাধিক বড় শহর টেক্সাস, ক্যালিফোর্নিয়া তখন অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নতি করছে কিন্তু অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক অঞ্চলই অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নে আর্থিক বিকাশ মূলত রাশিয়ার মস্কো কেন্দ্রিক ছিল। এর জন্য তৎকালীন সোভিয়েত সরকার একটি পরিকল্পনা নিল, তারা ঠিক করল ইউক্রেন অঞ্চলে বেশ কয়েকটি নতুন শহর তৈরি করা হবে যাতে আর্থিক বিকাশ ঘটবে। 

ইউক্রেনে প্রথমে যে নতুন শহর তৈরির কথা হয় তার নাম দোওয়া হয় প্রিপেয়াত। এবার শহর হলে তার জন্য বিদ্যুৎ লাগবে। সেজন্য প্রিপেয়াত থেকে কিছুটা দূরে চেরনোবেলে একটি পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির কাজ শুরু হ ১৯৭০ থেকে যার প্রাথমিক নাম ছিল ভি আই লেনিন পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্র। প্রিপেয়াত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নবম অটোমোগ্রাদ শহর। রাশিয়ান ভাষায় অটোমোগ্রাদ শব্দের অর্থ অ্যাটমিক। অর্থাৎ সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়টি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিশিষ্ট শহর তৈরির পরিকল্পনা করেছিল। প্রিপেয়াতে ১৫ টি বাচ্চাদের স্কুল, ৫ টি উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, পার্ক সহ বিশাল একটি শহর তৈরি হচ্ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এখানে ২-৩ লাখ লোককে বসতি স্থাপনের জন্য পরিকল্পনা নিয়েছিল। চেরনোবেলের নিরাপত্তার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটি ডুগা ৩ ব্যালেস্টিক মিসাইল ওয়ার্নিং রেডার এখানে মোতায়েন করেছিল। ১৯৭৬ সালের জুলাই থেকে ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এগুলো এখানে ছিল। 

চেরনোবেল পরমানু কেন্দ্র চারটি ইউনিটে বিভক্ত ছিল। প্রথম ইউনিট ১৯৭৭ সালে, দ্বিতীয় ইউনিট ১৯৭৮ সালে, তৃতীয় ইউনিট ১৯৮১ সালে এবং চতুর্থ ইউনিট ১৯৮৩ সালে তৈরি হয়। পরমানু বিদ্যুৎ উৎপাদন নিউক্লিয়ার ফিসান প্রক্রিয়াতে করা হয়। এই পদ্ধতিতে একটি ভারী মৌলের নিউক্লিয়াসকে একটি নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা হয় ফলে ভারী মৌলটি অন্য দুটি নিউক্লিয়াসে ভেঙে যায় এবং প্রচুর শক্তি উৎপন্ন হয়। যেমন তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়াম ২৩৫ বা প্লুটোনিয়াম ২৩৯ কে যদি নিউট্রন দ্বারা আঘাত করা হয় তাহলে ইউরেনিয়াম ২৩৬ তৈরি হয় এবং এটি ভেঙে বেরিয়াম ১৪১ ও ক্রিপটন ৯২ তৈরি হয় এবং আরও তিনটি নিউট্রন তৈরি হয় এবং যা আগে আরও ইউরেনিয়ামকে ভাগ করতে থাকে। এভাবে পরমানু বোম্ব তৈরি হয়। কিন্তু পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ওই তিনটি নিউট্রনকে নিয়ন্ত্রন করবার জন্য বোরন, গ্রাফাইট বা ভারী জল ব্যবহার করা হয়। একে মডারেটর বলা হয়। চেরনোবেলে গ্রাফাইট মডারেটর ব্যবহার করা হয়েছিল। সবকীছু ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু ২৬ এপ্রিল ১৯৮৬ তে সেই ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে। শুনলে অবাক হবেন চেরনোবেল দুর্ঘটনা ঘটেছিল শুধু কীছু পরীক্ষার জন্য। সেই কেন্দ্রে কাজ করা কীছু বিশেষজ্ঞ পরীক্ষা করে যদি ভবিষ্যতে কোন সমস্যা হয় তাহলে এমারজেন্সির সময় রিয়্যাক্টার ঠিক ভাবে কাজ করবে কীনা এই পরীক্ষা করতে গিয়েই সমস্যা হয়। সোভিয়েত রিয়্যাক্টার গুলো এমনভাবে ডিজাইন করা ছিল যদি পাওয়ার সাপ্লাই কম হয়ে যায় তাহলে এগুলো নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাবে। এই রিয়্যাক্টারের সিনিয়র ইঞ্জিনিয়র ২৬ বছর বয়সী লিওনিড টপটুনোভ জানতই না এমারজেন্সি টেস্টের সময় কী করা উচিৎ। এটা অদ্ভুত যে এতবড় প্রজেক্টের নিয়ন্ত্রন নাকী একটি ২৬ বছর বয়সী ছেলের হাতে ছিল! সে করে কী টেস্টের সময় গোটা রিয়্যাক্টারকে অটোমোড করে দেয়। ফলে পাওয়ার সাপ্লাই মাত্রাতিরিক্ত যায় এবং রিয়্যাক্টার আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যায়। রিয়্যাক্টার প্রচুর গরম হয়ে ওঠে। পরমানু রিয়্যাক্টারে উপর থেকে জল ঢালা হয়। সেইসময় জল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বাষ্পীভূত হয়ে রিয়্যাক্টারের কোর ফাটিয়ে দেয়। ফলে পুরো রেডিয়েশন বাইরে এসে যায়। বিস্ফোরনে ঘটনাস্থলেই অনেকের মৃত্যু হয়। পুরো কেন্দ্রে ব্যাপক আগুন লেগে যায় ঘটনাস্থলেই উপস্থিত হয় অগ্নিনির্বাপকরা। 

প্রত্যেক দেশেই সেনাবাহিনী, পুলিশকে বিশেষ সম্মান দেওয়া হয় তবে এই অগ্নিনির্বাপরাও সমান সম্মানের অধিকারী। অগ্নিনির্বাপকরা কোন রকম বিশেষ নিরাপত্তা ছাড়াই আগুন নেভাতে চলে যায়, রেডিয়েশন কী সে-সম্পর্কে তাদের কোন জ্ঞানই ছিলনা। যখন কোন মানুষের শরীর ব্যাপক রেডিয়েশনের সংযোগে আসে প্রথমেই চোখ ফুলে যায়, ফুসফুস ফুলে যায়, গায়ের চামড়া খুলে পড়ে। সোজা কথায় রেডিয়েশন ক্যান্সারের পাশাপাশি মানুষের শরীরের ডিএনএ পরিবর্তন করে দেয়। সেই অগ্নিনির্বাপকদের সাথেও এমন ঘটে। অত্যন্ত কষ্টদায়ক মৃত্যু হয় তাদের। এত বড় ঘটনা সম্পর্কে তৎকালীন চেরনোবিলের প্রধানরা সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকারের উপরমহলকে অনেকদিন কিছু জানায় নি কারন চাকরি চলে যাবার ভয়ে। আশেপাশের লোকও এতটা পাত্তা দেয়নি এই ঘটনা কারন কারোরি পরমানু, রেডিয়েশন সম্পর্কে তেমন কোন জ্ঞান ছিলনা। দুদিন অবধি আশেপাশের দেশও এই ভয়ানক দুর্ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারে নি। পরে ২৮ এপ্রিল চেরনোবিল থেকে ১০০০ কিলোমিটার দূরে সুইডেনের ফোর্সমার্ক পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করা ইন্জিনিয়ার ক্লিফ রবিনসন বাতাসে রেডিয়েশনকে শনাক্ত করে। এই নিয়ে সেসময় আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলোতে প্রচুর প্রতিবেদন লেখা হয় যে চেরনোবেলে ২০০০ লোক মারা গেছে কিন্তু বাস্তবে মারা গেছিল ৫০ জন। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসময় কোন সাংবাদিককে এখানে আসতে দেয়নি। বিশ্বে সেসময় ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিরোধী অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আমেরিকা। রিয়্যাক্টার ৪ এ দুর্ঘটনা ঘটার পরও এটি সচল ছিল এবং এটিই ছিল সবচেয়ে বড় চিন্তার কারন। সোভিয়েত বায়ুসেনা সেসময় হেলিকপ্টারে করে প্রথমে ১৫০ টন বালি ঢালে রিয়্যাক্টারের উপর কিন্তু পরমানু বিজ্ঞানীদের দাবি ছিল অন্তত ৫০০০ এন বালি ঢালা দরকার। সুতরাং এক সপ্তাহ ধরে প্রায় ৫০০০ টন বালি ঢালা হয়। প্রিপেয়াত শহরের অধিবাসীদের জন্য এটা ছিল সবচেয়ে কষ্টকর। পুরো শহরের লোকেদের অন্যত্র বসতি স্থাপন করতে হয়।  পুরো শহর নির্জন হয়ে যায়। আজও ইউক্রেনে চেরনোবেল শহরে বড় বড় স্থাপত্য পড়ে আছে নির্জন জনমানবহীন হয়ে। প্রায় ৬৮,০০০ লোককে অন্যত্র বসতি স্থাপন করতে হয়। এতে কয়েক বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। যার ফলে ভবিষ্যতে বিভিন্ন প্রদেশে লোক প্রতিবাদ করতে থাকে আর্থিক সংকটের জন্য। বলা হয় ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাবার জন্য চেরনোবেল দুর্ঘটনা অনেকটা দায়ী। 

এই দুর্ঘটনার প্রধান কারন ছিল সোভিয়েত রিয়্যাক্টারের ডিজাইন। সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ঘটনা প্রকাশ করে নি প্রথমে যাতে সবাই জানতে না পারে সোভিয়েত রিয়্যাক্টারের গুনমান সম্পর্কে। ইউক্রেনে বর্তমানে এই প্রিপায়াত শহরে ঘোস্ট টাউন বলা হয়। এখানে আজও রেডিয়েশনের যা মাত্রা রয়েছে তাতে মানুষের শরীরের জন্য চিন্তার বিষয়। ১৯৮৬ সালেই প্রিপেয়াত থেকে কীছুটা দূরে স্লাভাউচ নামে একটি শহর তৈরি করা হয় যেখানে মানুষদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়। তবে বর্তমানে ভারত সহ বিভিন্ন দেশে যেসব পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী, দুর্ঘটনা ঘটবার কোন সুযোগ নেই আর যদিও হয় তাহলে বিশাল কোন ক্ষতি হবে না। যেমন আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার তিন মাইল দ্বীপেও পরমানু কেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু তাতে কারও মৃত্যু হয়নি কারন এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা মজবুত ছিল। জাপানের ফুকোশিমাতেও দুর্ঘটনা ঘটেছিল কিন্তু তাতেও কোন মৃত্যু হয়নি। চেরনোবেল দুর্ঘটনা বিশ্বের জন্য একটি শিক্ষা ছিল কীভাবে পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও মজবুত করা যায়। ভবিষ্যতে অপ্রচলিত শক্তি উৎস হিসাবে পরমানু বিদ্যুৎের গুরুত্ব রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.