পৃথিবী

ফ্রান্সের বাতিল করা যুদ্ধবিমান কেন ক্রয় করা হয়েছিল?

ভারতীয় বিমান বাহিনী একটি ফরাসি প্রাইভেট কোম্পানির সাথে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে যাতে, ফ্রান্সের বাতিল করা শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান মিরাজ ২০০০ এর স্পেয়ার পার্টসগুলো ভারত নিজস্ব সেনাবাহিনীর হাতে থাকা মিরাজের মেরামতির কাজে ব্যবহার করতে পারে।

রাফায়েলের আগমনের পর ফরাসি বিমান বাহিনী এক প্রকার ভাবে মিরাজ ২০০০ এর ব্যবহার প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে বললেই চলে। তবে অপরদিকে, ভারতের বিমান বাহিনীর হাতে রয়ে গেছে কম করে প্রায় এমন ৫০ টি মিরাজ যা এখনও বহুকাল সার্ভিস দিতে সক্ষম। আর তাই- ই ভবিষ্যতে এই যুদ্ধবিমানগুলিতে কোনোরকম যান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দিলে তা ঠিক করার মতো উপযুক্ত যন্ত্রাংশ মজুদ রাখা খুবই প্রয়োজনীয়। একথা মাথায় রেখেই ভবিষ্যতে আলাদা করে ঝামেলা এড়াতে এক বছরের মধ্যেই ভারত সরকার ফ্রান্সের সাথে পর পর দুটি চুক্তি সম্পন্ন করেছে। সূত্রের খবর আইএএফ গত বছর  ১৬ টি মিরাজ সরবরাহের জন্য ফ্রেঞ্চ এয়ারফোর্সের সাথে যে  চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, তার ডেলিভারি বছর শেষের আগেই সম্পন্ন করা গেছে।সম্প্রতি ভারতের প্রায় অর্ধেকর বেশি মিরেজ ফ্লিটকে আপগ্রেড করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে এই আপগ্রেডের ফলে  মিরাজ আরও অন্তত এক দশক আকাশে ডানা মেলতে সক্ষম হবে। 

ভবিষ্যতে যুদ্ধবিমানের যান্ত্রিক ত্রুটি এড়াতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি মজুদ রাখা আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কারন ধীরে ধীরে, বিভিন্ন দেশে মিরাজের ব্যবহার যেমন কমছে তেমনি পাল্লা দিয়ে কমছে এই যুদ্ধ বিমানের স্পেয়ার পার্টসের উৎপাদনও। আর পরবর্তীকালে যদি শুধুমাত্র ভারতের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখে মিরাজের স্পেয়ার পার্টস তৈরি করতে হয় তবে ভারতের খরচও বৃদ্ধি পাবে অনেকটা। প্রতিরক্ষা দপ্তর সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে অতিরিক্ত স্পেয়ার পার্টস নিজেদের আয়ত্তে রাখার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে ঠিক এই বিষয়গুলি মাথায় রেখেই।

সূত্রগুলি একটি কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, IAF এর নেওয়া পদক্ষেপগুলি কেবলমাত্র “বিদ্যমান যুদ্ধবিমানগুলো উন্নতি এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নেওয়া হচ্ছে”, ভারতের মিরেজ ২০০০ এর ফ্লিটের তালিকায় যোগ করার জন্য নয়। অপর এক সূত্রের মতে “এই চুক্তিটি উড়তে সক্ষম এমন কোনো বিমানের জন্য নয়।” ৩১ শে আগস্ট হওয়া চুক্তির কারণ ব্যাখ্যা করে, সূত্রগুলি আরো জানিয়েছে যে মিরাজগুলি নক-ডাউন সংস্করণ হিসাবে কন্টেইনারে আসবে৷

সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে,একটি বিমানে এমন বেশ কিছু অংশ থাকে যেগুলো অন্যান্য অংশের তুলনায় অনেক বেশিদিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। যেমন-বিমানের উইংস। বিমানের উইংস এ কখনো কোনো ফাটল দেখা দিলে বা গোলযোগ দেখা দিলে খুব সহজেই সেটা পাল্টে অন্য বিমানের সেকেন্ড-হ্যান্ড উইংস ব্যবহার করা যেতে পারে। একই কথা প্রযোজ্য বিমানের ইঞ্জিনের ক্ষেত্রেও। সেই কারণেই লক্ষনীয়, ভারতীয় মিরাজের ইঞ্জিন পুরোনো মিরাজের ইঞ্জিনের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হলেও, ইঞ্জিনের ৮০ শতাংশই কিন্তু আসলে সেই পুরোনো ইঞ্জিনের মতোই। ফলত, ভবিষ্যতে ইঞ্জিনে কোনোরকম ত্রুটি দেখা দিলে তাতে পুরোনো অনেক যন্ত্রাংশ পুনরায় ব্যবহার করা যেতে পারে।

সেন্টার অফ এয়ার পাওয়ার স্টাডিজের মহাপরিচালক এয়ার মার্শাল অনিল চোপড়া (অব.) এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে সম্প্রতি দ্য প্রিন্টকে জানিয়েছেন “ভবিষ্যতের খুচরা যন্ত্রাংশের প্রয়োজন মেটাতে সেকেন্ড-হ্যান্ড অথবা পুরোনো মিরাজ ক্রয় করা ভারতের জন্য এক বুদ্ধিমত্তার কাজ হবে। এর ফলে ভবিষ্যতে, আপগ্রেড করা বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ করা যেমন সহজ হবে তেমন ব্যয় ও কমবে অনেকটাই। তাছাড়া, এর ফলে ভারত অন্তত আরো এক দশক বেশি সময় ধরে এই বিমান ব্যবহার করতে পারবে।”

১৯৮০ এর দশকে ভারতে মিরাজের আগমনের গল্পটিও বেশ অদ্ভুত। এখন আইএএফ মিরাজ যুদ্ধবিমানের কার্যক্ষমতা বজায় রাখার জন্য ওভারটাইম কাজ করে মিরাজের স্পেয়ার পার্টস যোগার করতে  মরিয়া হয়ে উঠেছে ঠিকই তবে উল্লেখ্য, এর আগেও কিন্তু ভারত সরকার দু- দুবার নিজ দেশে এই বিমান উৎপাদনের সুযোগ নষ্ট করেছে। একবার ১৯৮০ এর দশকে এবং একবার ২০০০ এর দশকে।

সূত্রের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ১৯৮০ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে F-16 বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিলে তা ভারতের জন্য এক যথেষ্ট চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তান F-16 ক্রয় করলে বায়ুশক্তির দিক থেকে ভারতের বিরুদ্ধে অনেকটাই বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠতে সক্ষম হতো। আর ঠিক এই ভয় থেকেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সিদ্ধান্ত নেন প্রোটোটাইপ পর্যায়ে থাকা সমস্ত মিরাজ ২০০০ কিনে ফেলার।

শোনা যায়, ভারতকে ১৯৭৯ সালে প্রথমবারের মতো মিরাজ যুদ্ধবিমান ক্রয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয় শুধুমাত্র অ্যাংলো-ফরাসি যুদ্ধ বিমান জাগুয়ারের ক্রয় বন্ধ করানোর জন্য। ভারত যেখানে জাগুয়ার আমদানির আগে বিভিন্ন রকম পরীক্ষা নিরীক্ষা ও আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেখানে মিরাজ ক্রয়ের সময় এতো কিছু প্রটোকলের ধারই ধরা হয়নি বলা চলে। এর ফলে ২০১৭ সালে ৩৬ টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান ক্রয়ের সময় সরকার যে রকম সমালোচনার মুখে পড়েছিল ঠিক একই ভাবে মিরাজ ক্রয়ের সময়েও বিভিন্ন অভিযোগের আঙ্গুল ওঠেছিলো সরকারের দিকে।ঘটনাক্রমে, মিরাজ এবং রাফালে এই উভয়েরই  নির্মাতা কিন্তু একই, Dassault  aviation।

প্রাথমিকভাবে ভারত এবং ফ্রান্সের মধ্যে আলোচনায় ঠিক করা হয়েছিল ক্রয় করা ১৫০ টি মিরেজের মধ্যে ১০০ টি এইচএএল ভারতেই তৈরি করবে। কিন্তু ১৯৮২ সালের শেষ দিকে ভারত শেষ অব্দি মাত্র ৪০ টি বিমান ক্রয় করতে রাজি হয়। চুক্তি অনুযায়ী ঠিক করা হয় ভারত চাইলে ফ্রান্সের কাছ থেকে পরবর্তীকালে আরো ১১০ টি যুদ্ধবিমান অর্ডার করতে পারবে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য ভারতের হঠাৎ করে পুরোনো পরিকল্পনা বাতিলের মূল কারণ ছিল সোভিয়েতদের চাপ। ইউনিয়ন হঠাৎ করে ভারতের কাছে  মিগ-২৯ বিক্রয় করার জন্য নানা ভাবে চাপ দিতে আরম্ভ করেছিলো। অথচ, অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর অঙ্গদ সিং এর দাবি অনুযায়ী এর আগে পর্যন্তও রাশিয়ানরা সরাসরি  মিগ-২৯ এর অস্তিত্ব অস্বীকার করতো। 

কিন্তু, তারাই আবার হঠাৎ লাইসেন্স সহ ভারতকে এই যুদ্ধবিমান বিক্রয়ের অফার করলে অবাক হয়েছিল অনেকেই। সিং এর মতে ঘটনার আকস্মিক পরিবর্তনে শেষ অব্দি ঠিক করা হয় ভারত মিগ- ২৯ এবং মিরাজ দুটিই অল্প পরিমাণে ক্রয় করবে এবং সেনাবাহিনীর যুদ্ধ বিমানগুলো কয়েক বছর ব্যবহারের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে ভারত অভ্যন্তরীণ ভাবে কোন বিমান উৎপাদন করবে। 

ইউএসএসআর, যা আগে ভারতকে মিগ-২৩ এমএল অফার করেছিল, তা মিগ-২৯-এ স্যুইচ করেছিল। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, এই mig-২৯ তৈরি করা হয়েছিল মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের F-১৬-এর প্রত্যুত্তর হিসেবে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রয়ারিতে ভারত মিগ -২৯ এর দীর্ঘ মূল্যায়নের শেষে ১৯৮৫ সালের নভেম্বরে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত করে।

এয়ার মার্শাল চোপড়া যিনি ১৯৮৫ সালের জুন মাসে মিরেজ ২০০০ বিমানের প্রথম সাতটি সেট ভারতে উড়িয়ে এনেছিলেন তার কাছ থেকে জানা যায় সেই সময় মিরাজ এবং মিগ-29-এর জন্য ভারতীয় পাইলটদের প্রশিক্ষণ ঘটেছিল প্রায় একই সময়ে।তবে, অঙ্গাদ সিংয়ের মতে, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শেষ অব্দি মিরাজ ২০০০ বা মিগ-২৯ তৈরির পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায় ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ১৯৯০-এর দশকের আর্থিক সংকটের কারণেই। 

প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল মিরাজ ২০০০ এর মধ্যে যে ১১০ টি ‘ অপশনাল’ ছিলো সেগুলো ভারতেই তৈরি করা হবে। এর মধ্যে ৪৫ টি কিট থেকে এবং বাকি 65টি তৈরি করা হবে কাঁচামাল থেকে। যাবতীয় সিদ্ধান্ত ১৯৮৪ সালের মধ্যেই নেওয়া হবে ঠিক করা হলেও সোভিয়েতরা হঠাৎ মিগ-২৯ বিক্রির প্রস্তাব দিলে, পূর্ব পরিকল্পিত মিরাজ লাইসেন্স উৎপাদন বন্ধ রাখা হয় এবং এরই প্রায় এক বছর পরে মিগ-২৯-এর চুক্তি সম্পন্ন হয়।

তিনি যোগ করেছেন যে ১৯৮২ সালে ভারত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে উৎপাদন বিকল্প খোলা রাখার জন্য অতিরিক্ত অর্থ অব্দি প্রদান করেছিল।

কার্গিলের শেষে ভারতে নতুন করে মিরাজ তৈরীর প্রচেষ্টা শুরু হয়।১৯৯৯ এর কার্গিল যুদ্ধের সময় মিরাজ ২০০০ ই ছিলো ভারতের একমাত্র ভরসা। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এই যুদ্ধবিমান সেই সময় স্বমহিমায় প্রবর্তিত হয়ে “স্মার্ট বোমা” নামে পরিচিত আমেরিকান পেভওয়ে লেজার-গাইডেন্স কিট নিক্ষেপ করে শত্রু ঘাঁটিকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিল।

মিরাজ ২০০০ এর কার্যকারিতায় খুশি হয়ে আইএএফ ভবিষ্যতে শত্রুর মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে আরো কয়েকটি নতুন মিরাজ ২০০০ যুদ্ধ বিমান কিনতে ইচ্ছুক ছিলেন। কিন্তু, Dassault Aviation সেই সময় তাদের Mirage ২০০০ এর উৎপাদন বন্ধ করার পরিকল্পনা করছিল ফলত, তারা উৎপাদন ভারতে স্থানান্তর করার প্রস্তাব দেয়।

দূর্ঘটনার কবলে পড়া বিমান প্রতিস্থাপনের জন্য মাঝে মাঝে ভারতকে এমনিই মিরাজের অর্ডার দিতে হতো। তার সাথে ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত আলাদা করে আরো ১০ টি মিরাজ যুদ্ধ বিমানের অর্ডার দিয়েছিল। ফ্রান্সের অফার এরকম এক সময়ে আইএএফ এর কাছে খুবই গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো কারণ এর ফলে আইএএক মিরাজ ২০০৫-৬ এর সবচেয়ে নতুন মডেলের ইয়ার ক্রাফট হাতে পাওয়ার সুযোগ পায়।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, অটল বিহারী বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার সেই সময়ে ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলো কেবল মাত্র অতীতের দুর্নীতির কারণেই। ভারত ২০০৪ সালে মিরাজ ২০০০ তৈরির পরিবর্তে মিডিয়াম মাল্টি-রোল কমব্যাট এয়ারক্রাফ্ট (এমএমআরসিএ) এর জন্য বিশ্বব্যাপী দর খোঁজার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু, দুই বছর পরে, ড্যাসাল্ট তাদের মিরাজ অফারের পরিবর্তে রাফাল কেনার জন্য চাপ দিতে শুরু করে।

2007 সালে প্রথমবারের মতো এক গ্লোবাল রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল  (RFP) জারি করা হয়েছিল, যেখানে রাফালে 2012 সালে বিজয়ী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published.