চীনের সাবমেরিন ধ্বংস করতে ভারতবর্ষের কাছে কি ধরনের বিমান রয়েছে?
ভারতের কাছে একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আগেই ছিল আইএনএস বিক্রমাদিত্য এবং সম্প্রতি আরও একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার লঞ্চ করেছে ভারত আইএনএস বিক্রান্ত। এই দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার দিয়ে ভারত মহাসাগরে চাইনিজ নেভির বিরুদ্ধে ভারত সফল প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তবে অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞের মতে চীনের নৌবাহিনীর সাবমেরিন হচ্ছে ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং সাবমেরিনকে কাউন্টার লড়বার ভারতের কাছে যথেষ্ট ব্যাবস্থা নেই। তবে এই ধারনা ঠিক নয়, ভারতের কাছে এই মহূর্তে সাবমেরিন কিলার পি-৮ আই বিমান রয়েছে যা শত্রু সাবমেরিনকে চোখের নিমেষে ধ্বংস করতে সক্ষম। ভারতীয় নৌবাহিনীর এই পি-৮ আই বিমান সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
সাবমেরিনকে সবসময় যেকোন দেশের নেভির সবচেয়ে ঘাতক অস্ত্র বলা হয়। সমুদ্রের গভীরতা থেকে একটি সাবমেরিন শত্রুকে কখন ধ্বংস করে দেবে তা টেরও পাওয়াও মুশকিল, এজন্য সাবমেরিনকে সাইলেন্ট কিলার বা নিঃশব্দ ঘাতক বলা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও সাবমেরিনের যথেষ্ট ব্যবহার হয়েছিল। ১৯১৫ সালের ৭ মে দক্ষিন আয়ারল্যান্ড উপকূলে একটি ব্রিটিশ জাহাজ আরএমএস লুসিটানিয়াকে ধ্বংস করে দেয় জার্মান সাবমেরিন, যাতে জাহজে থাকা ১২০০ জন সেনার মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ১২৮ জন আমেরিকান নাগরিক ছিল। সেসময় জার্মান সাবমেরিনকে ইউবোট বলা হত। এই ঘটনার পরই আমেরিকা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়। এরপরই বিশ্বের শক্তিশালী দেশ গুলো সাবমেরিন টেকনোলজি নিয়ে ব্যাপক গবেষনা শুরু যার ফল স্বরূপ বর্তমানে সামরিক শক্তিশালী অনেক দেশেরই নিজস্ব সাবমেরিন ফ্লীট রয়েছে। এবার আসা যাক একবিংশ শতাব্দীতে। দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তিশালী দেশ হচ্ছে চীন ও ভারত। দুই দেশের মধ্যে সীমানা নিয়ে লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসিতে মাঝেমধ্যেই ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়। এবার চীন ল্যান্ড বর্ডার থেকে শুরু করে জলপথেও ভারতকে ঘিরে ফেলবার পরিকল্পনা করেছে। যার জন্য চীন শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দর, পাকিস্তানের গোয়াদার বন্দর, বাংলাদেশ, মায়ানমারের কোক দ্বীপের মাধ্যমে এবং চীনের বিখ্যাত ব্যার্থ প্রজেক্ট বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই এর মাধ্যমে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ইরান, সুদান হয়ে ভারতকে দক্ষিন চীন সাগর থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগর এবং বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে আরব সাগর পর্যন্ত পুরো ঘিরে ফেলতে চাইছে, একে চীনের স্ট্রিং অফ পার্লস নীতি বলা হয়। যার জন্য চীনের প্রধান অস্ত্র তাদের সাবমেরিন। নিউক্লিয়ার ও কনভেনশনাল মিলিয়ে ৭৯ টি সাবমেরিন যুক্ত বিশাল সাবমেরিন ফ্লীট আছে চীনের। কিন্তু চীন বোধ হয় ভুলে গেছে ভারতও আর ১৯৬২ তে পড়ে নেই। বর্তমানে ভারতের সামরিক ক্ষমতা বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে যার জন্য ভারত এখন বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ। ল্যান্ড বর্ডারের পাশাপাশি ভারতীয় নেভিও খুবই শক্তিশালী। ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নেভির মজবুত অবস্থান রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ডিরেক্টরি অফ মর্ডান মিলিটারি ওয়ারশিপসের তথ্য অনুযায়ী চীনের কাছে এই মহূর্তে ৭৯ টি সাবমেরিন আছে, যেখানে ভারতের কাছে ১৬ টি সাবমেরিন আছে। এই তথ্য দেখে মনে হতে পারে চীনের সামনে ভারত কিছুই নয়। কিন্তু সাবমেরিনের পাশাপাশি ভারতের কাছে সাবমেরিন হান্টার পি-৮আই বিমান রয়েছে যা চীনের সাবমেরিনের যম। এই বিমান সম্পর্কে একটু বলা যাক।
পি-৮আই বিমানকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার বিমান বলা হয়। পি-৮আই একসাথে তিন ধরনের মিশন পরিচালনা করতে সক্ষম, অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার, অ্যান্টি সারফেস ওয়ারফেয়ার ও সারভিলেন্স অর্থাৎ সোজা কথায় বললে পি-৮আই বিমান থেকে লঞ্চ হওয়া মিসাইল শত্রুর সাবমেরিনের পাশাপাশি যুদ্ধজাহজকেও ধ্বংস করতে সক্ষম এবং প্রয়োজনে পি-৮আই নজরদারির কাজেও ব্যাবহার করা যায়। পি-৮ বিমান আমেরিকার ডিফেন্স জায়ান্ট বোয়িং এর তৈরি যা বোয়িং এর ৭৩৭-৮০০ বিমানের উপর বেসড করে তৈরি করা হয়েছে। বোয়িং আমেরিকান নেভির জন্য এটি তৈরি করেছিল। ২০০৯ সালের ২৫ এপ্রিল বিমানটি প্রথম আকাশে ওড়ে এবং ২০০৯ সাল থেকে বিমানটির উৎপাদন শুরু হয়। ২০২২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ১৫০ টি ধরনের বিমান তৈরি হয়েছে। এর আগে আমেরিকা সাবমেরিন হান্টার ও সারভিলেন্সের জন্য লকহিড মার্টিনের পি-৩ ওরিয়ন বিমান ব্যবহার করত ১৯৬২ সালে। কিন্তু ১৯৮০ সাল থেকে এই বিমানের রিপ্লেসমেন্ট খুঁজতে শুরু করে আমেরিকা। ১৯৮৯ সালে লকহিড মার্টিনকে পি-৭ নামে আরেকটি বিমান তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় কিন্তু সেবছরই এই প্রজেক্ট বাতিল করে দেওয়া হয় কারন আমেরিকান নেভির পচ্ছন্দ হয়নি। ২০০০ সালে লকহিড মার্টিন পি-৩ এর রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে ওরিয়ন ২১ নামে একটি আপগ্রেডেড বিমান অফার করে, সাথে বোয়িং তাদের পি-৮ এবং বেয়েই সিস্টেম নিমরোড এমআরএফোর নামে একটি বিমান অফার করে। পরে ২০০২ সালে বেয়েই সিস্টেম তাদের অফার প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে আমেরিকান নেভির ভবিষ্যতে সাবমেরিন কিলার বিমানের প্রতিযোগিতায় শুধু দুটি কোম্পানির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় লকহিড মার্টিন ও বোয়িং এর মধ্যে। শেষপর্যন্ত ২০০৪ সালের ১৪ মে বোয়িংকেই আমেরিকান নেভি নির্বাচন করে।
১৫ বিলিয়ন ডলার মূল্যে আমেরিকা ১০৮ টি পি-৮ অর্ডার দেয় বোয়িংকে। পি-৮ এ ম্যাগনেটিক অ্যানোমেলি ডিটেকশন সিস্টেম বা ম্যাড রয়েছে, যা জলের গভীরে থাকা সাবমেরিনকে সহজেই খুঁজে বের করে। এছাড়া এই বিমানে আরও অনেক রেডার আছে যা দীর্ঘ দূরত্বে নজরদারির কাজে ব্যবহৃত হয়। বিমানটির একদম সামনে সিন্থেটিক অ্যাপারচার রেডার রয়েছে। এটি যেকোনও খারাপ আবহওয়ায়, দিন রাত সবসময়ই বিমানটির মিশন সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। বিমানটিতে থাকা ইলেকট্রো অপটক্যাল ফাইবার উচ্চ রেজোল্যুশনের ছবি ও ভিডিও গ্রহন করতে সাহায্য করে। এই বিমানটিতে মোট এগারোটি হার্ড পয়েন্ট রয়েছে যাতে মার্ক ৫৪ টর্পেডো, মার্ক ৮৪ ডেপথ চার্জ হারপুন মিসাইল, অ্যান্টি শিপ মিসাইল সহ মাইন ও অন্যান্য অস্ত্র বহন করে। বিমানটি ১২৯ টি সোনোবুই বহন করে, জলের গভীরতায় থাকা সাবমেরিনকে চিহ্নিত করতে এটি ব্যাবহৃত হয়। শুধু আক্রমনই নয় পি-৮আই নিজের আত্মরক্ষাও করতে পারে যার জন্য এতে মিসাইল ওয়ার্নিং সিস্টেম, রেডার ওয়ার্নিং রিসিভারও ইনস্টল করা হয়েছে। একটি পি-৮ বিমানে সর্বমোট নয়জন লোক থাকতে পারে। পি-৮আই এর সর্বোচ্চ গতি ৯০৭ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা এবং এর রেঞ্জ ২২০০ কিলোমিটার। আমেরিকা ছাড়াও, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, দক্ষিন কোরিয়া, ইংল্যান্ড এই বিমান ব্যাপার করে। বোয়িং আমেরিকার জন্য যে পি-৮ বিমান তৈরি করেছে তার নাম পি-৮এ পসিডন কিন্তু ভারতের জন্য বোয়িং ভারতের জন্য পি-৮ এর সম্পূর্ণ একটি আলাদা ভার্সন তৈরি করেছে যাতে ভারতের প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ইনস্টল করা হয়েছে, এই ভার্সনের নাম পি-৮আই নেপচুন।
২০০৮ সালে বোয়িং এই পি-৮আই কেনার প্রস্তাব দেয় ভারত সরকারকে। এই পি-৮আই এ পি-৮এ এর থেকে আলাদা করে ম্যাড সিস্টেম এবং এপিএস-১৪৩ ওশেনআই রেডার ইনস্টল আছে। ২০০৯ সালের ৪ জানুয়ারি ভারত ২.১ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আটটি পি-৮ আই কেনার চুক্তি করে বোয়িং এর সাথে পুরোনো রাশিয়ান টুপলভ টিইউ- ১৪২ এম বিমানের পরিবর্তন হিসাবে। টিইউ-১৪২ ২৯ বছর ভারতীয় নৌবাহিনীতে ছিল। শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় শান্তিরক্ষা বাহিনীকে সাহায্য করেছিল এই বিমান। ২০১৬ সালে ভারত সরকার আরও চারটি পি-৮আই কেনার চুক্তি করে। ২০১৯ সালে ভারত সরকার আরও অতিরিক্ত ছয়টি পি-৮ আই কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। পি-৮আই এর জন্য আমেরিকার সাথে ৪২৩ কোটি টাকার বিনিময়ে মার্ক ৫৪ টর্পেডোর চুক্তিও করেছে ভারত। ভারতীয় পি-৮আই এ আইএফএফ বা আইডেন্টিফিকেশন ফ্রেন্ড এন্ড ফো সিস্টেম রয়েছে এরা মাধ্যমে বিমানটি শত্রুর বিমান ও নিজেদের বিমানের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারে। আইএফএফ এর দুটি অংশ আছে ১৪১০ ট্রান্সপোরেন্ডারস যা হ্যাল বা হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড তৈরি করে এবং ইন্টারোগেটর যা ভারত ইলেকট্রনিকস লিমিটেড তৈরি করে। এই মহূর্তে ভারতের কাছে মোট ১২ টি পি-৮আই বিমান আছে। প্রথম ব্যাচে ৮ টি পি-৮আই ভারত পায় ২০১৩ সালে। এগুলো তামিলনাড়ুর কাছে আরাকোনামে ভারতীয় নেভির আইএনএস রাজালিতে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাচের চারটি পি-৮আই গোয়ার ডাবোলিমে ভারতীয় নৌবাহিনীর আইএনএস হানসা বেসে রাখা হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাচের এই বিমান গুলো ভারতীয় নেভির আইএল-৩৮ বিমানকে রিপ্লেস করেছে। ১৯৭৭ সালে ভারতীয় নেভিতে যুক্ত হয়েছিল এই আইএল-৩৮, অবশেষে ৪৪ বছর পর এবছর ১৭ জানুয়ারি এগুলো অবসরে যায়। পি-৮আই ২০৫০ অবধি ভারতীয় নৌবাহিনীতে থাকবে। ২০২০-২১ চীনের সাথে গালওয়ান ভ্যালিতে ঝামেলার পর থেকে পি-৮ আই সবসময় চীনের নেভির উপর নজরদারি করছিল। ভারতমহাসাগরে পি-৮আই সবসময় মোতায়েন থাকে। শুধু পি-৮ আই নয় ভারত আমেরিকার থেকে এমএইচ ৬০ রোমিও অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার হেলিকপ্টার ও কিনেছে ২৪ টি। ভবিষ্যতে আরও পি-৮আই বিমান ও রোমিও হেলিকপ্টার ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত হবে।