ভারত

তিব্বত সীমান্তে কেন চীনের সাথে সমস্যা কোনদিন মিটবেনা?

২৭ মে, ২০২১ এ হিমাচল প্রদেশের ধরমশালাতে তিব্বতের এক্সাইলের নতুন রাষ্ট্রপতি শপথ নেন। ধরমশালাতেই বৌদ্ধদের ধর্মগুরু দলাই লামা ১৯৫৯ সালে তিব্বত থেকে এসে বসবাস করছেন। ২০১১ সালের ২৯ মে ১৪ তম দলাই লামা তিব্বতের সম্পর্কে কোন রাজনীতিতে অংশ না নেবার পর ধরমশালাতে তিব্বতীয় এক্সাইল সরকার গঠন করা হয়। গত বছর এই নির্বাচনে পেনপা শেরিং নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে ভারত, আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়াতে থাকা প্রায় ৬৪,০০০ তিব্বতি ভোট দেয়। পেনপা শেরিং জানিয়েছেন তিনি সিনো তিব্বত সমস্যা সমাধানের জন্য চীনের সরকারের সাথে কথা বলবে। 

১৯৫০ এর দশক থেকেই চীন ও তিব্বতের ঝামেলা শুরু হয়। ১৯৫০-৫৯ সালের মধ্যে চীন জোর করে তিব্বতকে দখল করে নেয়। এই সময় চীনের পিপিলস লিবারেশন আর্মি অনেক তিব্বতিদের হত্যা করে। সেই থেকে তিব্বতে চাইনিজ সরকার রয়েছে এবং ছয় দশক ধরে তিব্বত অন্যায় ভাবে দখল করে রেখেছে চীন। সেসময় তিব্বত থেকে অনেক মানুষ ভারত, আমেরিকা সহ অনেক দেশে পালিয়ে যায়। এরাই ধরমশালাতে তিব্বতের এক্সাইল সরকার তৈরি করছে তবে এই সরকারকে নিষিদ্ধ করেছে চীন। তবে ভারতে থাকা তিব্বতিদের দাবি তাদের ভূমি জোর করে দখল করে চীন সেখানে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যাবহার করছে। মজার ব্যাপার হল ভারত একদিকে তিব্বতকে চীনের অংশ হিসাবে স্বীকার করে আবার অন্যদিকে তিব্বত থেকে আসা লোকেদের আশ্রয়ও দেয়। ১৯৫৯ সালেই ভারত ধরমশালাতে তিব্বতীদের থাকবার জন্য অনুমতি দিয়েছে, তবে এই তিব্বতিরা এখনও ভারতীয় নাগরিক নয়। বিগত দশ বছরে তিব্বতী ও চাইনিজ সরকারের মধ্যে তেমন কোন কথা হয়নি। 

তিব্বতের ইতিহাস ও কী করে তিব্বত চীন দখল করল সেব্যাপারে জানা যাক। ভারত ও চীনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত তিব্বতের বেশীর ভাগ অংশ উঁচু পার্বত্য অঞ্চল এবং মালভূমি যুক্ত এইজন্য তিব্বতকে পৃথিবীর ছাদও বলা হয়। ১৪,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত তিব্বতকে পৃথিবীর সবচেয়ে উচ্চতম বসবাস যোগ্য স্থানও বলা হয়। তিব্বতে এভারেস্ট পর্বতও রয়েছে। যদি তিব্বতের সীমানা দেখা যায় তাহলে এর উত্তর পূর্বে চীনের কিংঘাই, পূর্বে সিচুয়ান, দক্ষিন পূর্বে ইউনান, দক্ষিনে মায়ানমার, ভুটান, ভারত, পশ্চিমে ভারতের কাশ্মীর, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশ রয়েছে। তিব্বতের রাজধানী লাসা। এখানে ১৯৫৯ সালের আগে দলাই লামার বসবাস ছিল। বৌদ্ধদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র জায়গা এই তিব্বত। ১৯৫০ এর পর জোর করে চীন তিব্বত দখল করলেও তিব্বতের স্বাধীন ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরোনো। যদিও চীন দাবি করে তেরো শতক থেকে তিব্বত তাদের ছিল। পূর্ব তিব্বতের কুয়ামদোর কাছে পাওয়া বিভিন্ন নিদর্শন থেকে জানা যায় এখানে ৪০০০-৫০০০ সাল আগেও মানুষ বসবাস করত। স্থানীয় পৌরানিক কাহিনী অনুযায়ী একটি পবিত্র বাঁদর থেকে এখানের মানুষের উৎপত্তি। দশম শতকে চীনের ত্যাং রাজবংশের সময়ের ইতিহাস থেকে জানা যায় তিব্বতিদের উৎপত্তি কুয়াং উপজাতি থেকে যা উত্তর পূর্ব চীনে ২০০ সালের দিকে বসবাস করত। সপ্তম থেকে নবম শতকে তিব্বতের সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়ায় শক্তিশালী ছিল কিন্তু এই রাজবংশের পতনের পর দশম থেকে তেরো শতক পর্যন্ত তিব্বতিরা ধীরে ধীরে ব্যাবসায়ী হয়ে ওঠে। এরপর মঙ্গোল সাম্রাজ্য তিব্বতের বৌদ্ধ ধর্মকে রক্ষা করে দীর্ঘদিন ধরে। 

উনিশ শতকে রাশিয়ান সাম্রাজ্য এবং ব্রিটিশ ভারতের মধ্যবর্তী বাফার জায়গা হিসাবে ছিল। বিশাল রাশিয়ান সাম্রাজ্য বহুবছর ধরে ইউরোপ, এশিয়া জুড়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্য হয়ে ছিল। ১৯৫০ এর পর চীনের তিব্বত আক্রমন থেকে তিব্বত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি বিতর্কিত জায়গা হিসাবে রয়েছে। কিন্তু চীন হঠাৎ করে কেন তিব্বত দখল করল! এটা জানার জন্য প্রথমে চীনের রাজনীতি এবং সেখানের কমিউনিস্ট দলের কাজ করবার পদ্ধতি জানা দরকার। ১৯২১ সালে চীনের সাংহাই শহরে কমিউনিস্ট দল গঠন হয়। প্রথমে এটি ছিল শিক্ষা দল যারা চীনের জাতীয়তাবাদ সরকারের সাথে কাজ করত। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে আসবার জন্য এই দল চীনের সেনার সাথে অংশ নেয় চীনকে রক্ষা করা এবং দেশে একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু চীনের জাতীয়তাবাদ দল বা ন্যাশানালিস্টরা কমিউনিস্টদের সেনাবাহিনী থেকে বের করে দেয় এবং অনেককে হত্যাও করে। কিন্তু যখন ১৯৩১ সালে জাপান চীনের মান্চুরিয়া আক্রমন করে তখন ন্যাশনালিস্টের প্রধান চ্যাং কাই সামনে দুটি সমস্যা তৈরি হয় প্রথমত জাপানী আক্রমনের মোকাবিলা করা এবং দ্বিতীয়ত দেশের অভ্যন্তরে কমিউনিস্টদের বৃদ্ধি আটকানো। চ্যাং কাই সেক জপানকে ছেড়ে কমিউনিস্টদের দমন করা বেশী প্রয়জনীয় মনে করে। কিন্তু চীনের সেনাবাহিনীর অনেক জেনারেল ও ন্যাশনালিস্ট দলের অনেকেই চ্যাং কাই সেকের এই নীতির বিরোধিতা করে। তবে কমিউনিস্ট দল এসময় চীনের গ্রাম্য অঞ্চলে শক্তিশালী হতে থাকে, তারা ভূমি সংস্কার আইন আনে এবং জাপানিদের পরাজিত করে যার কারনে চীনের সাধারন মানুষের কাছে কমিউনিস্ট দলের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান আত্মসমর্পনের পর চীনের ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট দল ও ন্যাশানালিস্ট দলের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট দল চীনের ক্ষমতা দখল করে এবং সেই বছর ১ অক্টোবর মাও জেডং চীনের রাষ্ট্রপতি হয়। এইভাবে চীনের ইতিহাসের এক রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ সমাপ্ত হয়। চীনে কমিউনিস্ট সরকার থাকার জন্য জাতিসংঘ অনেকদিন চীনের সাথে কোন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রাখে নি। এরই মধ্যে মাও জেডং রাইট প্লাম নীতি নিয়ে আসে। যাতে বলা হয় লাদাখ, সিকিম, অরুনাচল প্রদেশ, ভুটান, নেপাল চীনের ডান হাতের পাঁচটি আঙুল এবং তিব্বত হাতের চেটো। এইজন্য চীন তিব্বত আক্রমন করে এবং এশিয়াতে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। চীন আজও অরুনাচল প্রদেশ তাদের বলে দাবি করে। আন্তর্জাতিক ভাবে মনে করা হয় তিব্বত একটি স্বাধীন প্রদেশ কিন্ত চীন কোন কীছুর পরোয়া না করে অক্টোবর, ১৯৫০ এর পর তিব্বতে গনহত্যা চালায়। চীন প্রায় আড়াই লাখ সেনা তিব্বতে প্রেরন করে যাতে সেখানকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তিব্বত আমেরিকার কাছে সাহায্য চায় কিন্তু কোন লাভ হয়নি। তিব্বতি ধর্মগুরু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান গুরু ১৪ তম দলাই লামা তখন ২৩ বছর বয়সী ছিলেন। তিনি তিব্বতকে বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কোন লাভ হয়নি। ১৯৫১ সালের ২৩ মে চাইনিজ সরকার জোর করে তিব্বতের সাথে একটি চুক্তি করে যাতে তিব্বতের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রন চীনের হাতে চলে যায়। 

১৯৫০ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত চীনের অত্যাচার তিব্বতের উপর এতটাই বৃদ্ধি পায় যে তিব্বতিরা গেরিলা যুদ্ধের জন্য তাদের একটি দল তৈরি করে যার নাম দেওয়া হয় ন্যাশানাল ভলেন্টিয়ার ডিফেন্স ফোর্স, একে চুশী গ্যাংড্রুকও বলা হত। বলা হয় এই ফোর্সকে আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ প্রশিক্ষন দিয়েছিল। সিআইএ এর দুজন রেডিও অপারেটরের মাধ্যমে প্রশিক্ষন দেওয়া হয়েছিল। মার্চ, ১৯৫৯ সালে সিআইএ তিব্বতে অপারেশন ইমিডিয়েট শুরু করে। আমেরিকার কাছে খবর ছিল চীন দলাই লামাকে গ্রেফতার করে হত্যা করতে পারে সেজন্য সিআইএ তার বিশেষ পরিকল্পনা অনুযায়ী দলাই লামাকে তিব্বতের বাইরে বের করার মিশন শুরু করে। ১৭ মার্চ, ১৯৫৯ দলাই লামা লাসা ত্যাগ করে। চুশী গ্যাংড্রুকের একটি বিশেষ দল ওনার সুরক্ষায় ছিল। রাস্তায় আসা চাইনিজ সৈনিকদের হত্যা ও বন্দি করা হয়। দলাই লামা ও ২০ জন লোক লাসা ত্যাগ করেছিল এদের মধ্যে তিব্বত সরকারের ছয়জন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ছিল। প্রায় ১৫ দিন ধরে তিব্বতের বরফাবৃত পথ ও নদী পেরিয়ে ৩১ মার্চ অরুনাচল প্রদেশেের তাওয়াং মঠে এসে উপস্থিত হন। তারপর থেকে তিনি ভারতেই আছেন। এর পাশাপাশি আরও অনেক তিব্বতি পরে ভারতে চলে আসে। তবে ভারত এখনও এদের নাগরিকত্ব দেয়নি, এদের বিদেশী মনে করা হয় এখনও। 

আসলে শরনার্থীদের নিয়ে ভারতে নির্দিষ্ট কোন আইন নেই এখনও। ভারতে তিব্বতি, মায়নমার, বাংলাদেশী, আফগানি এবং শ্রীলঙ্কান মিলে প্রায় ২ লাখ শরনার্থী আছে কিন্ত তারা কেউই ভারতীয় নাগরিকত্ব পায়নি। তবে ২০১৪ সালে তিব্বতি রিহ্যাবিলিটেশন নীতি অনুযায়ী তিব্বতি শরনার্থীদের বিশেষ সুবিধা দেয় ভারত তবু তাদের সম্পত্তি কেনা, সরকারি চাকরী ও ভ্রমনের উপর নিষেধাজ্ঞা আছে। যার কারনে অনেক তিব্বতি ভারত ছেড়ে অন্য কোন দেশে সুরক্ষিত ভবিষ্যতের জন্য চলে যাচ্ছে। একটি তথ্য অনুযায়ী ২০১১-১৮ অবধি ভারতে থাকা দেড় লাখ তিব্বতিদের মধ্যে থেকে প্রায় ৬৫০০০ তিব্বতি ভারত ছেড়ে চলে গেছে। এদের মধ্যে বেশীরভাগ আমেরিকা চলে গেছে। ভারত এতদিন তিব্বতকে চীনের অংশ হিসাবেই স্বীকৃতি দিত। এমনকী আমেরিকাও তিব্বতকে চীনেরই মানত। তবে প্রাক্তন আমেরিকান রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকে আমেরিকা তার অবস্থান থেকে সরে আসে। বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন এবং ভারত ও চীনের মধ্যে বিভিন্ন মত অনৈক্যের কারনে এবার ভারত সরকারও তিব্বতের ব্যাপরে কোন পদক্ষেপ নিতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.