পদ্মনাভস্বামী মন্দির। কেন এতো রহস্যময় এই ধর্মীয় স্থানটি?
রাজেশ রায়:— বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ধর্মীয় স্থান গুলির একটি হচ্ছে কেরালার বিষ্ণু মন্দির যাকে পদ্মনাভস্বামী মন্দির বলা হয়। এই মন্দিরের প্রাচীন ইতিহাস, অবিশ্বাস্য সম্পদ এবং এই মন্দিরের রহস্যময় ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
বর্তমান যে পদ্মনাভস্বামী মন্দির রয়েছে তা তৈরি করেছে আঠারো শতকে ত্রিবাঙ্কোর প্রদেশের মহারাজা মারটন্ডো বর্মা। এই মন্দিরের ইতিহাস বহু পুরোনো। এই মন্দিরের বিশেষত্ব হচ্ছে শায়িত বিষ্ণু মূর্তি। এখানে ভগবান শ্রী বিষ্ণু অনন্তশয্যায় শেষ নাগের উপর শুয়ে আছেন। নয় শতকে তামিল বৈষ্ণব সাধু সম্প্রদায় নামালভার দের গানে এই মূর্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার কোনও কোনও ইতিহাসবিদ দের মতে দ্বিতীয় শতকে লেখা শিলাপদ্মিকরম কাব্যে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। স্থানীয়দের মতে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠার সাথে মহান সাধু ভিল্লমঙ্গলাম স্বামীয়ার জড়িত আছেন। মালাবার অঞ্চলে অনেক মন্দির উনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। উনি প্রতিদিন শালিগ্রাম শিলা পূজো করতেন এবং ভগবান শ্রী বিষ্ণুর বিরাট রুপ দর্শনের জন্য চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতেন। কিন্তু প্রতিদিন ধ্যান করবার সময় একটি ছোট বাচ্চা ওনাকে বিরক্ত করত। একদিন তিনি বাচ্চাটিকে ধরে ফেলেন এবং যেই চোখ খুলতে যাবেন তখন শুনতে পান বাচ্চাটি বলছে আমিই শ্রী হরি বিষ্ণু, যদি আমারা বিশাল রূপ দেখতে হয় তাহলে অনন্ত কাড়ু জঙ্গলে আসতে হবে। তিনি এর আগে কোনওদিন এই জঙ্গলের নাম শোনেননি। তিনি বাচ্চাটির গলার আওয়াজ শুনে সেই পথে এগোতে থাকলেন। রাস্তায় তিনি দেখেন একটি বাচ্চা কাঁদছে এবং বাচ্চাটির মা তাকে অনন্ত কাড়ু জঙ্গলে রেখে আসার ভয় দেখাচ্ছে। তিনি সেই মহিলাটিকে জঙ্গলের ঠিকানা জিজ্ঞেস করে জঙ্গলে উপস্থিত হন। হঠাৎ দেখেন তার সামনে একটি বিশাল মহুয়া গাছ। হঠাৎই মহুয়া গাছটি পড়ে যায় এবং তিনি দেখেন তার সামনে নাগেদের রাজা শেষ নাগের পিঠে অনন্ত শয্যায় শুয়ে আছেন শ্রী হরি বিষ্ণু, তার সেই রূপ এতটাই বিশাল যে একটি প্রান্ত তিরুভল্লাম এবং আরেকটি প্রান্ত তিরুআপ্পাপুরে রয়েছে। এই বিশাল রূপ দেখে মহা সাধক স্বামীয়ার ভগবানকে ছোট হতে অনুরোধ করেন যাতে তিনি ভগবানের পূজো করতে পারেন এবং তাকে প্রদক্ষিন করতে পারেন। ভগবান ওনার অনুরোধ শোনেন। যখন ত্রিবাঙ্কোরের মহারাজা এই ঘটনা শোনেন তখন তিনি সেখানে এই মন্দির তৈরি করেন।
বলা হয় ভগবান পদ্মনাভস্বামীর মূর্তি তৈরি হয়েছে সেই মহুয়া গাছের কাঠ দিয়ে। পদ্মনাভস্বামী মন্দির ভগবানের নিজের দেশ কেরালার রাজধানী তিরুবান্তপুরমে অবস্থিত। তামিল ও মালায়লাম ভাষায় তিরুবান্তপুরমের অর্থ ভগবান অনন্তের শহর। ভগবান বিষ্ণুরই একটি নাম অনন্ত। এই মন্দিরের কাছেই আরব সাগর অবস্থিত যেখানে বছরে দুবার ভগবানকে স্নান করানো হয়। এই মন্দিরে গঠন প্রনালী অসাধারন। এই মন্দির দ্রাবিড়, তামিল এবং কেরালার নিজস্ব স্থাপত্যেের মিলিত রূপ। এই মন্দিরে অনন্ত শয্যায় শায়িত বিষ্ণুর সাথে ভগবান ব্রহ্মা এবং ভগবান শিবকেও দেখা যায়। ভগবান বিষ্ণু শায়িত অবস্থায় তার ডান হাত একটি শিবলিঙ্গ কে স্পর্শ করছে এবং বিষ্ণুর নাভি থেকে একটি পদ্ম তৈরি হয়েছে যাতে ভগবান ব্রহ্মা বসে আছেন। এই জন্য এই মন্দিরের নাম হয়েছে পদ্মনাভস্বামী মন্দির। এই মন্দিরে বিষ্ণু মূর্তি নির্মানে কাঠের পাশাপাশি অসংখ্য শালিগ্রাম শিলা ব্যবহৃত হয়েছে। বলা হয় আঠারো শতকে মারতন্ড বর্মা মন্দির পুননির্মানের সময় নেপালের গন্ডোকী নদী থেকে ১২,০০৮ টি শালিগ্রাম শিলা আনিয়েছিলেন। যদি মন্দিরটি বাইরে থেকে দেখেন দেখবেন উজ্জ্বল সোনালী রঙের বিশাল গোপুরাম আকৃতি বিশিষ্ট যা অসাধারন দিব্য লাগে দেখতে। কেরালার অন্য কোনও মন্দিরে এধরনের স্থাপত্য দেখতে পাওয়া যায় না। মন্দিরে তিনটি দরজা রয়েছে। প্রথম দরজা দিয়ে ভগবান বিষ্ণুুর মুখ, শেষনাগ ও শিবলিঙ্গ দেখা যায়, দ্বিতীয় দরজা দিয়ে বিষ্ণুর নাভির থেকে নির্গত পদ্মে ব্রহ্মাজী কে এবং তৃতীয় দরজা থেকে ভগবান শ্রী বিষ্ণুর পাদপদ্ম দেখা যায়।
পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে ছয়টি ভল্ট বা গোপন কুঠরি পাওয়া গেছে। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে এগুলো খোলার পর দেখা গেছে মন্দিরে প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। যার জন্য এই মন্দিরকে বিশ্বের অন্যতম ধনী মন্দির বলা হয়। তবে এটা তো শুধু সাধারন হিসাব করা হয়েছে এই সম্পত্তির সাথে এর ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য ধরাই হয়নি যেমন এখানে পাওয়া সোনার মুদ্রা গুপ্তুযুগের যা এখানকার যুগের সোনার থেকে অনেক দামী তাই পুরো হিসাব করলে এই মন্দিরে সম্পত্তির মূল্য অনেক। ত্রিবাঙ্কোরের রাজপরিবার সম্পর্কে অনেক কথা চালু আছে যেমন এই রাজ্যের রাজর বৌ ওনার বৌ নয় বরং বোন এবং রাজত্ব উত্তরাধিকার সূত্রে রাজার ছেলে নয় বরং ওনার বোনের ছেলে মানে ভাগ্নে পাবে। এভাবেই আঠারো শতকে রাজ্যভার গ্রহন করেন মহারাজ মারতন্ড বর্মা। তিনি তার সমস্ত রাজত্ব ভগবান পদ্মনাভস্বামীর পায়ে অর্পন করে নিজেকে ভগবানের দাস ঘোষনা করে আজীবন ভগবানের সেবক হয়ে শাসন সামলান। ভারতের স্বাধীনতার পর সুপ্রিম কোর্টের দি ত্রিবাঙ্কোর কোচি ধর্মীয় আইন অনুযায়ী ১৯৫১ সালে এই মন্দিরের অধিকার ত্রিবাঙ্কোরের রাজ পরিবারকে দিয়ে দেয়। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হবার পর এই অধিকার কেড়ে নেন যা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়।
২০১১ সালে কেরলা হাইকোর্ট ত্রিবাঙ্কোর রাজ পরিবারের কাছ থেকে এই অধিকার কেড়ে নেয়। কিন্তু এই বছরই সুপ্রিম কোর্ট কেরালা হাইকোর্টের আদেশের উপর স্থগিতাদেশ দিয়ে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ কমিটি একে একে মন্দিরের ছয়টি ভোল্ট খুলতে শুরু করে কিন্তু ভল্ট বি কে নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়। মন্দিরের পুরোহিত ও রাজ পরিবার এই ভল্ট বি কে খুলেতে দেয় না করান তাদের মতে ভল্ট বি এর গায়ে সাপের চিহ্ন রয়েছে, এই ভল্ট খোলার অর্থ বিপদকে আমন্ত্রন দেওয়া। দশ বছর ধরে চলা মামলার পর সুপ্রিম কোর্ট ত্রিবাঙ্কোর রাজ পরিবারকেই মন্দিরের দায়িত্ব পুনরায় দিয়ে দেয় এবং মন্দিরের যাবতীয় সম্পত্তি সংরক্ষনের আদেশ দেওয়া হয়। পদ্মনাভস্বামী মন্দির কেরলা তথা তিরুভান্তপুরমের ইতিহাসের সাথে যুক্ত। এই মন্দিরের কারনেই এই শহরের নাম ত্রিবান্দ্রম থেকে পাল্টে তিরুভান্তপুরম রাখা হয়। এই মন্দিরের বিখ্যাত উৎসব হচ্ছে আরাট্টু উৎসব। মালয়ালি ভাষায় আরাট্টুর অর্থ হচ্ছে রাজকীয় স্নান। বছরে দুবার ভগবানের স্নান হয়। মার্চ থেকে এপ্রিলে যাকে বলা হয় পেনকুনি আরাট্টু এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বরে আলপাসি আরাট্টু। এই দুই উৎসবের সময় মন্দির থেকে রাজকীয় শোভাযাত্রা বের করা হয়, ভগবান পদ্মনাভস্বামী, ভগবান শ্রী কৃষ্ণ এবং ভগবান নরসিংহ দেবের ছবি রাজকীয় হাতিতে চাপিয়ে আরব সাগরে নিয়ে যাওয়া হয়। এই শোভাযাত্রা এতটাই রাজকীয় হয় যে কয়েক ঘন্টার জন্য ত্রিভান্তপুরম এয়ারপোর্টের বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তবে এই মন্দিরের আসল নির্মান সময় এবং শ্রী বিষ্ণুর মূর্তির বয়স কেউই সঠিক বলতে পারে না। শাস্ত্র অনুযায়ী ভগবান শ্রী কৃষ্ণের বড় দাদা বলরাম এই মন্দিরে এসে স্নান করে পূজো করেছিলেন। প্রসিদ্ধ পন্ডিত এল এ রবি বর্মার মতে আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে কলিযুগের প্রথম দিন এই মন্দির তৈরি হয়েছিল এবং কলি যুগের ৯৫০ তম বছরে এই মন্দরে ভগবানের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। সবচেয়ে বেশী রহস্যময় ব্যাপার বলা হয় এই মন্দিরের ভল্ট বি কে নিয়ে। পদ্মনাভস্বামী মন্দিরে ছয়টি ভল্ট আছে এ, বি, সি, ডি, ই, এফ। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে সব কটা ভোল্ট খোলা হয়। বি ভোল্টকেও খোলা হয়। কিন্তু বি ভোল্টের দরজার ভিতর আরও একটি মোটা কাঠের দরজা পাওয়া যায়। দরজার গায়ে দুপাশে দুটি সাপ আকা। বলা হয় এই দরজার ওপাশে বিষধর সাপেরা রয়েছে যারা মন্দিরের বিশেষ সম্পত্তি রক্ষা করছে। স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস এই দরজা নাগপাশ নামে বিশেষ মন্ত্র দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে যা কোনও বিশেষ সিদ্ধ পুরুষই গড়ুর মন্ত্রের দ্বারা খুলতে পারবে। কিন্ত এই মহূর্তে বিশ্বে তেমন কোনও সিদ্ধ পুরুষ নেই।
এই মন্দির একাধিক বিষয় নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। একাধিক তথ্যের উপর ভিত্তি করে এই লেখা, আপনাদের মতামতও একান্তভাবে কাম্য।