ভারত

এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমে কিভাবে দেশের নিরাপত্তায় কাজ করে?

বর্তমান সময়ে আধুনিক বোমারু এবং যুদ্ধ বিমানের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে স্থল, নৌবাহিনী ও সকল সামরিক স্থাপনা এবং বেসামরিক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো শত্রুবাহিনীর এয়ার ফোর্সের প্রধান লক্ষবস্তুতে পরিনত হয়েছে। কোনোভাবে যুদ্ধে লিপ্ত হলে মূলত প্রথমে একদেশ এয়ার পাওয়ার প্রয়োগ করে অন্যদেশের উপর আধিপত্য বিস্তার করে। যখন আকাশসীমার উপর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা স্থাপিত হয় এখন পদাতিক বাহিনী এবং নৌবাহিনীকে উপর থেকে উপর্যুপরি আক্রমণ করে পরাজিত করা সহজ। 

এজন্যই বিশিষ্ট মার্কিন যুদ্ধপ্রবক্তা জন ওয়ার্ডেন বলেছেন, ১৯৩৯ সালে জার্মানি পোল্যান্ডে আক্রমণের পর থেকে কোন দেশ কোন যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারেনি শত্রুদেশ কতৃক আকাশে আধিপত্য অর্জনের পর। অপরপক্ষে কোন দেশ যুদ্ধে হারেনি নিজেদের আকাশ আধিপত্য বজায় রেখে। কারণ বর্তমানের আধুনিক বোমারু বিমান ও যুদ্ধবিমান গুলো পদাতিক ও আর্টিলারির ফায়ার পাওয়ারের রেঞ্জের বাইরে থেকেও সুনিপুণ ভাবে লক্ষবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। বাংলাদেশের আকাশসীমার গভীরতা কম হওয়ায় এ হুমকি আরো বেশি মাত্রায় বহন করে। দেশের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে দক্ষ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ আকাশ প্রতিরক্ষা গঠন করা অপরিহার্য।

এখন আলোচনা করা যাক আকাশ প্রতিরক্ষা, তথা এয়ার ডিফেন্স কিভাবে কার্যকর হয়?

সার্বিকভাবে এয়ার ডিফেন্স হচ্ছে মাতৃভূমি, সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনা গুলোকে শত্রুর এয়ার অ্যাটাক থেকে রক্ষা করার কার্যক্রম। অন্যভাবে বলা যায়, এয়ার ডিফেন্স শত্রুর এয়ার অ্যাটাক প্রতিহত করে অথবা শত্রুর আক্রমণের কার্যকারিতা কমায়।

মূলত দুই ধরের এয়ার ডিফেন্স রয়েছে- 

১) প্রত্যক্ষ এয়ার ডিফেন্স এবং ২) পরোক্ষ এয়ার ডিফেন্স।

প্রত্যক্ষ এয়ার ডিফেন্স: শত্রুর এয়ার আক্রমণকে প্রতিহত করা এবং শত্রুর বিমানের উপর কাউন্টার অ্যাটাক  করা। যেমন-

  • একটি রাডার সিস্টেম যা শত্রুবিমানকে অনুসরণ এবং ধ্বংস করার জন্য অস্ত্রসমূহকে নির্দেশ দেয়।
  • একটি কমান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশন ও ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম যা অস্ত্র ও রাডার সিস্টেমকে সংযুক্ত করে।
  • একটি ওয়েপন সিস্টেম যা শত্রু বিমানকে ধ্বংস করতে পারে৷

পরোক্ষ এয়ার ডিফেন্স: উন্নত পরোক্ষ এয়ার ডিফেন্স থাকা সত্বেও কিছু কিছু শত্রুবিমান টার্গেটে পৌঁছাতে পারবে। পরোক্ষ এয়ার ডিফেন্স এমন একটি সিস্টেম যা এয়ার অ্যাটাকের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কমাতে পারে, এধরনের সিস্টেম এয়ার অ্যাটাকের আগে থেকেই স্থাপন করা হয়। যেমন-

  • বিমান ও ঘাঁটি গুলোর ক্যামোফ্লাজ  ধারণ।
  • বিমান গুলোকে অন্যত্র সরিয়ে রাখা।
  • ব্ল্যাক আউট ও সতর্কীকরণ।
  • ফায়ার ফাইটিং, মেডিকেল ও বেসামরিক স্থাপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এয়ার ডিফেন্সের নীতি: এয়ার ডিফেন্সের নীতি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত ও কার্যকর৷ যেকোন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এটা ফলো করে যে, আগত শত্রু বিমানকে ডিটেক্ট এবং ধ্বংস করতে হবে তার লক্ষবস্তুতে পৌঁছানোর আগেই। 

এয়ার ডিফেন্স যেসব নীতির উপর কাজ করে তা হলো-

  • নির্ণয়করণ
  • চিহ্নিতকরণ
  • হুমকির বিশ্লেষণ
  • অস্ত্রের মোতায়েন
  •  নিযুক্তির মূল্যায়ন

নির্ণয়করণ: শত্রুবিমান প্রকৃতপক্ষে নির্নয়ের সাথেসাথেই তাকে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। যদি যথেষ্ট আগে শত্রুবিমান নির্নয় করা না হয় এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম শত্রুবিমানকে সমরাস্ত্র নিক্ষেপের লাইনের আগে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হতে পারে। সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, যত আগে নির্নয় করা যাবে পরিকল্পনা প্রনয়ণ এবং বল প্রয়োগে তত সময় বেশি পাওয়া যাবে। বর্তমানে আধুনিক যুদ্ধবিমান গুলো অত্যন্ত নিচু দিয়ে উড়ে রাডারকে ফাঁকি দিতে পারে৷ সেজন্য উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন এবং লো লুকিং দুইধরনের রাডারই প্রয়োজন। পর্যবেক্ষণ বাড়াতে মোবাইল অবজারভেশন ইউনিটও ডেপ্লয় করা যেতে পারে।

চিহ্নিতকরণ: কোনো ফ্লাইং অবজেক্ট ডিটেক্ট করার পর তা চিহ্নিতকরণ বা আইডেন্টিটিফাই করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এরপরের বাকি সব কার্যক্রম এর উপরেই নির্ভর করে। এয়ার ডিফেন্সের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে ফাইং অবজেক্টকে আইডেন্টিটিফাই করে। যেমন- ইলেকট্রনিক ইন্টারোগেশন, ফ্লাইট প্ল্যানের তথ্য, বিমানের গতিবিধি ইত্যাদি। আমাদের দেশে যেকোনো বিমানের অনুমতি দেওয়া হলে সেটাকে বন্ধুভাবাপন্ন হিসেবে ধরা হয় কিন্ত অনুমতি ছাড়া কোনো বিমান ঢুকে পরলে সেটাকে শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তখন সেটার হুমকির মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হয়। পুরো এয়ার ডিফেন্সের তথ্য যাচাই করে দেখা হয় বিমানটি কি ধরনের ক্ষতি সাধন করতে পারে।

হুমকির বিশ্লেষণ:  যখন কোনো বিমানকে শত্রুভাবাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা হয় তখন এই তথ্যগুলো যাচাই করা হয়-

১) বিমানটি কি শত্রুভূমি থেকে উড্ডয়ন করেছে?

২) বিমানটি কি কোন অনুমোদিত কাউন্টার ব্যবস্থা গ্রহণ করছে?

৩) বিমানটি কি নো ফ্লাইং জোন, তথা কোন নিষিদ্ধ অঞ্চলে প্রবেশ করছে?

৪) বিমানটি কি কোনো উন্মুক্ত এলাকায় উড্ডয়ন করেছে?

৫) বিমানটি কি কোনো মিত্রবিমান নয়? যেটা Identification of friend and foe (IFF) অকার্যকর অবস্থায় শত্রুদেশ থেকে ফিরেছে?

৬) বিমানটি কি কোনো সম্ভাব্য আক্রমনের স্থানে তথা ভালনারেবল পয়েন্টের দিকে যাচ্ছে ?

৭) বিমানটির উচ্চতা ও গতি কোন ধরনের?

অস্ত্র মোতায়েন: উপরের বিষয় গুলি বিশ্লেষণ করে হুমকি নির্নয় করা হয় এবং কার্যকরী অস্ত্র প্রয়োগের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়। ইন্টারসেপশন যত দূর থেকে সম্ভব করা হয় যেনো শত্রু বিমান সময় কম পায়। হুমকির ধরণ অনুযায়ী এয়ার ডিফেন্স নানা ধরনের অস্ত্র মোতায়েন করে। যেমন: ইন্টারসেপ্টর, ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপনযোগ্য মিসাইল (স্যাম), বিমান বিধ্বংসী গোলা।

নিযুক্তির মূল্যায়ন:  এয়ার ডিফেন্সের শেষ অধ্যায় হচ্ছে  অস্ত্র মোতায়েনের মূল্যায়ন। শত্রুবিমানকে ঘায়েল করার জন্য যে অস্ত্র মোতায়েন করা হয় এয়ার ডিফেন্স সর্বদা নজর রাখে সেটা কতটুকু কার্যকর হয়েছে।

একে আবার চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে।

১) উৎক্ষেপণ- যুদ্ধবিমানের বেলায় উৎক্ষেপ কিন্তু মিসাইল বা গোলার ক্ষেত্রে ফায়ারিং।

২) নিয়ন্ত্রণ ও গতি- একটি যুদ্ধবিমান দ্বারা শত্রু বিমানকে ইন্টারসেপ্ট করার জন্য এয়ার ডিফেন্স রাডার সহায়তা করে। মিসাইলের ক্ষেত্রে রাডার সেটার নিয়ন্ত্রণ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। 

৩) ইন্টারসেপশন- একটি সময়োপযোগী উড্ডয়ন একটি সফল ইন্টারসেপশন পরিচালনা করতে পারে৷

৩) ধ্বংস- শত্রুবিমানের ধ্বংসের মাত্রা নির্ভর করবে এয়ার ডিফেন্সের দক্ষতা, শত্রুর কৌশল, অস্ত্র ও আবহাওয়ার উপর।

Leave a Reply

Your email address will not be published.