হাজার হাজার চাইনিজ নকল ওয়েবসাইট তৈরি। কেন করা হয়েছিল জানেন?
রাজেশ রায় :— সময়টা ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর, আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া শহরের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এজেন্সির এজেন্ট ব্যান্ডেন ক্যালেনের ফোনের রিঙ বেজে ওঠে। ফোনের ওপাশে এজিআই নামক একটি কোম্পানির অফিসার বলে যত দ্রুত সম্ভব যেন তার অফিসে আসা হয় এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বলার আছে যা ফোনে বলা সম্ভব নয়। এই এজিআই বা অ্যানালিটিক্যাল গ্রাফিক্স ইনকোরপোরেট সংস্থাটি আমেরিকার মিলিটারি সার্ভিস সহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরের সফটওয়্যার তৈরি করে। ব্যান্ডেন ততক্ষনা এজিআই অফিসে যান, সেখানে সফটওয়্যার ডেভলপার সহ গ্রাফিক্স ডিজাইনার সবার সাথে তিন ঘন্টা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে ব্যান্ডেন সেই মহূর্তেই ফোন করেন ফিলাডেলফিয়ার ফেডারেল প্রসিকিউটার ডেভিড লককে। ব্যান্ডেন জানান আমেরিকার স্যাটেলাইট ও মিসাইল সিস্টেমকে নিয়ন্ত্রন করা কয়েক লাখ ডলারের সফটওয়্যার কে কেউ ইন্টারনেটের একটি ওয়েবসাইটে বিক্রি করছে। বর্তমান বিশ্ব ডিজিট্যাল। ২৫-৩০ বছর আগে যে কাজ সমস্ত লোক করত সেসব কাজই এখন সফটওয়্যার করে। মিলিটারি, স্পেস সহ সিগন্যাল, এমনকী উচ্চ শিক্ষার কাজেও সফটওয়্যারই ব্যবহার করা হয়। কোন দেশের এমন গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার অন্য কারও হাতে চলে যাওয়া রীতিমত একটি খারাপ স্বপ্নের মতন। ২০০৯ সালে আমেরিকার তাই হয়েছিল। আমেরিকার এমন গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যার ক্র্যাক -৯৯ নামে একটি ওয়েবসাইট ইন্টারনেটে যে কাউকে মাত্র ১০০০ ডলারে বিক্রি করছিল। এজিআই এর তৈরি আমেরিকান মিলিটারি ফোর্সের স্যাটেলাইট টুল কিট বা এসটিকে সফটওয়্যারটিই ইন্টারনেটে লাইসেন্স কী সহ বিক্রি করা হচ্ছিল। এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে মহাকাশে আমেরিকার সমস্ত স্যাটেলাইটের রিয়েল টাইম পজিশন জানা সম্ভব। অর্থাৎ এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে আমেরিকার স্যাটেলাইটকে এড়িয়ে আমেরিকায় মিসাইল অ্যাটাক করা সম্ভব। এই ঘটনা রীতিমতো রাতের ঘুম উড়িয়ে দেয় আমেরিকান প্রশাসনের। হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এজেন্সি এই ক্র্যাক -৯৯ ওয়েবসাইটের তদন্ত শুরু করে। কারন ইন্টারনেটে এমন হাজার হাজার চাইনিজ নকল ওয়েবসাইট ছিল। তদন্তের জন্য একটি বিশেষ দল তৈরি করা হয়।
তদন্তে এটা দেখা যায় ক্র্যাক -৯৯ কে অপারেট করা হচ্ছে চীনের সেংদু নামে একটি শহর থেকে। এই ওয়েবসাইটের রেজিস্ট্রেশন রয়েছে জিয়াং লি নামে একটি ব্যাক্তির নামে। আরও বেশী তথ্য সংগ্রহের জন্য এই টিম ঠিক করে এই ওয়েবসাইট থেকে সফটওয়্যার কেনা হবে। এরজন্য প্রথমে এই ওয়েবসাইটে দেওয়া China9981@gmail.com নামে জিমেল আইডিতে মেসেজ করে সফটওয়্যার কেনার জন্য ১০০০ ডলার দেওয়া হয়। কিছুক্ষন পর ক্র্যাক -৯৯ থেকে মেল করে ডাউনলোড লিংক সহ সফটওয়্যারটা পাঠানো হয়। আমেরিকার ওই টিম এই ডিটেইল লস এজিআই অফিসে পাঠায়। সেখানে আইটি হেড পুরো সিস্টেম নিরক্ষন করে দেখে যে এটা পুরো আসল সফটওয়্যারের মতনই। এতে এই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে এই ওয়েবসাইট নকল নয়। আমেরিকা এবার এই ওয়েবসাইটের পেছনে থাকা লোকেদের ব্যাপারে তদন্ত শুরু করে। কিন্তু এটা এত সহজ ছিল না, কারন এই ওয়েবসাইটের সাথে জড়িত ব্যাক্তিরা সব চীনে ছিল। কিন্তু বলা হয় চোর যতই চালাক হোক কোনও না কোনও ভুল করবেই। এই ওয়েবসাইটের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল এর ঠিকানায় যে ইমেল আইডি দেওয়া হয়েছিল সেটি একটি জিমেল আইডি এবং জিমেল গুগলের প্রোডাক্ট। সুতরাং এই ওয়েবসাইট ট্যাপ করে এর বিষয়ে সমস্ত তথ্য জানা যাবে। আমেরিকার ওই তদন্তকারী দল আরও দুটি সফটওয়্যার কেনে। এই পুরো ওয়েবসাইটকে ট্যাপ করা শুরু হয়। ফিলাডেলফিয়ার একটি আদালত এর জন্য গুগলকে নির্দেশ দেয়। এই ওয়েবসাইটের ইনকামিং ও আউটগোয়িং সমস্ত ইমেল চেক করে দেখা যায় মোট ১২,০০০ ইমেল রয়েছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, সিরিয়া সহ আমেরিকার অন্যতম শত্রু দেশ ইরান থেকেও এই ওয়েবসাইট ব্যবহার করে সফটওয়্যার কেনা হয়েছে এটা দেখা যায়। যার ফলে আমেরিকার প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় এই ওয়েবসাইটের পেছনে থাকা মাস্টার মাইন্ড জিয়াং লি কে কোনও ভাবে খুঁজে বের করা, যে চীনে বসে রয়েছে। আমেরিকান বিশেষ সিকিউরিটি দল পরিকল্পনা তৈরি করে জিয়াং লি কে কোনও ভাবে চীনের বাইরে আনতে হবে কারন চীনে অপারেশন করা আমেরিকার পক্ষে সম্ভব নয়। একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়। আমেরিকার একটি বিশেষ এজেন্ট ব্যাবসায়ী সেজে জিয়াং লির সাথে যোগাযোগ করে বলে ওয়েবসাইটে যে মূল্যে সফটওয়্যার বিক্রি করা হচ্ছে তার থেকে অনেক বেশী মূল্যে সফটওয়্যার সে বিক্রির ব্যবস্থা করে দেবে তবে তার জন্য জিয়াং লিকে আমেরিকায় আসতে হবে। কিন্ত জিয়াং লি স্পষ্ট জানায় সে আমেরিকা আসবে না এবং নিজের পরিচয় প্রকাশ করবে না। জিয়াং লি সেই এজেন্ট কে জানায় তার কাছে ২০ জিবি সাইজের একটি ডেটা বেস রয়েছে যাতে আমেরিকার মিলিটারি ও সিভিলিয়ান বিমানে ছবি সহ, আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন পরিচালনার সফটওয়্যার এবং একটি থ্রি ডি ইমেজ সফটওয়্যার রয়েছে যা আমেরিকার একটি সংস্থার ওয়েবসাইটকে হ্যাক করে জোগার করেছে সে। মাত্র ৩০০০ ডলারের বিনিময়ে জিয়াং লি এটি বিক্রি করে দেয় সেই এজেন্ট কে। তবে পেমেন্ট করার ২ দিনেও তার ডেলিভারি আসে না তখন আবার যোগাযোগ করা হয় জিয়াং লির সাথে, জবাবে জিয়াং লি বলে এত বড় ডেটা পাঠানো সম্ভব নয় জিমেলে, সে কুরিয়্যার করে দেবে কিন্তু তাও আসে না। তখন আমেরিকা অধৈর্য হয়ে পড়ে যেকোনও উপায়ে জিয়াং লিকে ধরবার জন্য কারন এত গোপন ডকুমেন্টস হাতছাড়া করা যায় না। এজেন্ট জিয়াং লি কে সরাসরি মিটিং এর জন্য বলে কিন্তু জিয়াং লি রাজি হয় না, এভাবেই কিছুদিন চলে যায়। হঠাৎ একদিন জিয়াং লি মেল করে জানায় চীনের কাছে সাইপ্যান দ্বীপে সে মিটিং এর জন্য রাজি আছে। এটা শুনে আমেরিকার সিকিউরিটি এজেন্সি ব্যাপক আনন্দিত হয় কারন সাইপ্যান দ্বীপ আমেরিকারই অধীনে। আমেরিকার পুরো সিকিউরিটি নেটওয়ার্ক পুটো সাইপ্যান দ্বীপ জুড়ে অ্যাক্টিভ করে দেওয়া হয়। এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে হোটেল অবধি সর্বত্র আমেরিকান এজেন্টরা নজরে রাখে। যে হোটেলে জিয়াং লির থাকবার কথা ছিল সেখানের প্রতিটি রুমে অডিও, ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইস ইনস্টল করা হয়। অবশেষে দেড় বছরের তদন্তের পর সেই দিন এসে পড়ে যখন জিয়াং লি তার পাচ বছরের ছেলে ও মায়ের সাথে সাইপ্যান দ্বীপে এসে পৌঁছায়। আমেরিকার বিশেষ এজেন্ট দ্বারা তাকে হোটেল রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর হোটেল থেকে তাকে বিশেষ একটি জায়গায় মিটিং এর জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমেরিকার এক এজেন্ট তার সাথে দীর্ঘ মিটিং শুরু করে যেখানে জিয়াং লি তার সমস্ত পরিকল্পনা, হ্যাকিং কীভাবে করে। সফটওয়্যার কিভাবে ডিকোড করতে হবক সবকিছু বিস্তারিত ভাবে স্বীকার করে। ২০ জিবি ডাটা বেসও সিডিতে দেখায়। এসমস্ত কিছুই রুমে থাকা ভিডিও ক্যামেরায় রেকর্ড হয়ে যায় যাতে পরে জিয়াং লি আমেরিকার আদালতে তার অপরাধ অস্বীকার করতে না পারে। এরপরই সেই এজেন্ট তার ফোনে একটি বাকী টিমকে মেসেজ পাঠায় এবং সঙ্গে সঙ্গে বাকী সমস্ত এজেন্ট রুমে প্রবেশ করে জিয়াং লি কে গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় লি স্বীকার করে সে এই সমস্ত সফটওয়্যার ইন্টারনেটে অন্য রাশিয়ান ও চাইনিজ হ্যাকারদের থেকে কিনত এবং তার ওয়েবসাইটে বিক্রির জন্য আপলোড করত। জিয়াং লি কে গ্রেফতারের তিন বছর পর আমেরিকার এক আদালতে জিয়াং লি তার সব অপরাধ স্বীকার করে এবং তদন্তে দেখা যায় জিয়াং লি ২০০৮ এর আগস্ট থেকে ২০১০ এর মধ্যে প্রায় ৬০০ জনকে অবৈধ ভাবে আমেরিকার গোপন সফটওয়্যার বিক্রি করেছে যার বাজারমূল্য প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার।