রাশিয়া বারংবার পরমানু হামলার হুমকী দেওয়ার পেছনে কি কারন রয়েছে?
রাজেশ রায়:— বিশ্বের সবচেয়ে বড় জিওপলিটিক্যাল ঘটনা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়ে কয়েক মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেছে কিন্তু যুদ্ধের এখনও কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। সত্যি কথা বলতে কী এখন কেউ এই ব্যাপারে কোন আগ্রহও দেখাচ্ছে না। এতদিন পর রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের কী অবস্থা, ভবিষ্যতে এই যুদ্ধ কী ফলাফল হতে পারে! এই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। সাথে এটাও বলা হবে রাশিয়া যে বারবার পরমানু হামলার হুমকী দিচ্ছে এর ফলাফল কী হতে পারে!
২৩ ফেব্রুয়ারী রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করেছিল তখন সবাই ভেবেছিল মাত্র কয়েকদিনে হয়ত ইউক্রেন দখল হয়ে যাবে। রাশিয়া বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ। রাশিয়ার বিমানবহর, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি ফোর্স, নেভি সবকিছু ইউক্রেনে তুলনায় বহুগুন এগিয়ে কিন্তু তাও ইউক্রেন দখল করতে পারেনি এখনও পর্যন্ত রাশিয়া এবং এটাই বাস্তব সত্যি। ইউক্রেন রাশিয়াকে এখনও পর্যন্ত শুধু আটকাতে সম্ভব তাই নয় বরং ২০১৪ সালে ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়াকে দখল করে নিয়েছিল রাশিয়া, ইউক্রেন এখন সেখানেও তার সেনা পাঠিয়েছে। সেজন্য রাশিয়া বাধ্য হয়েছে ক্রিমিয়াতে তার সেনা পাঠাতে। অর্থাৎ রাশিয়া এই মহূর্তে ইউক্রেনে দ্বিমুখী যুদ্ধ করছে। আমেরিকার এক স্ট্রাটেজিক এক্সপার্ট হেলেন কুপার নিউইয়র্ক টাইমসে বলেছে এই যুদ্ধে ইউক্রেন তো ধ্বংস হচ্ছেই সাথে সাথে রাশিয়ার অবস্থাও খুব খারাপ হয়ে গেছে। শুধু এটা আমেরিকারই কথা নয় রাশিয়ার মস্কো ব্যুরোর প্রধান অ্যান্টন ট্রোয়ানোভিস্কি বলেছে রাশিয়ার হাতে এই যুদ্ধের নিয়ন্ত্রন নেই।
সবচেয়ে বড় কথা আমেরিকা ও ন্যাটো যে আধুনিক অস্ত্র ইউক্রেনকে দিয়েছিল তার সামনে রাশিয়ার অস্ত্র টিকতে পারেনি। যার জন্য প্রথমে পীছুু হটলেও এখন পূর্ব ইউক্রেন সহ ক্রিমিয়ায় ইউক্রেন সেনা পুনরায় যুদ্ধ করছে। হয়ত এবছরের শেষের দিকে কোন ফলাফল বেরোতে পারে। যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি দেখে বিশেষজ্ঞদের ধারনা এই যুদ্ধের তিনটি সম্ভাব্য ফলাফল হতে পারে। প্রথমত যদি পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে ইউক্রেনে সমর্থন আসা বন্ধ হয় তাহলে রাশিয়া গোটা পূর্ব ইউক্রেন দখল করে নেবে এবং ইউক্রেন বিভক্ত হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত হয়ত যুদ্ধ এরকম কয়েক মাস চলল তাহলে কোন পক্ষই জিতলনা তাহলে উভয়ের মধ্যে সন্ধি হবে। তৃতীয়ত যদি ইউক্রেন জিততে শুরু করে তাহলে পূর্ব ইউক্রেন সহ ক্রিমিয়াও আবারও নিজেদের দখলে আনবে ইউক্রেন। তবে এই মহূর্তে যতই রাশিয়ার উপর আক্রমন করুকনা কেন ইউক্রেনের জেতার সম্ভবনা কম বরং যুদ্ধ যেভাবে এগোচ্ছে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে দু’পক্ষই সন্ধি করবে। পূর্ব ইউক্রেনের এক বিশাল অঞ্চল হচ্ছে ডনবাস অঞ্চল। এই ডনবাস অঞ্চলের মধ্যেই আসে ডনেস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চল। রাশিয়া প্রথমে এই পুরো অঞ্চল দখল করে নিয়েছিল কিন্তু পরে ইউক্রেনের কাউন্টার আক্রমনে ডনেস্ক হাতছাড়া হয়ে যায়।
আসলে জন সমর্থন ও উন্নত অস্ত্র রয়েছে ইউক্রেনের। আমেরিকার মিলিটারি হেডকোয়ার্টার পেন্টাগনের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কলিন খালের বক্তব্য এখনও পর্যন্ত ২০,০০০ রাশিয়ান সেনা মারা গেছে ও ৫০,০০০ রাশিয়ান সেনা আহত হয়েছে। মিলিটারি বিশেষজ্ঞ সেঠ জোনসের বক্তব্য এই মহূর্তে রাশিয়ার সেনাবাহিনী ক্রমশ কমে যাচ্ছে কারন অনেক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এর ফলে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এমনিতেই রাশিয়াতে জনসংখ্যা অত্যন্ত কম তার উপর মহিলাদের সংখ্যা পুরুষদের থেকে বেশী। এখন যুদ্ধে আরও যুবক মারা যাওয়ায় রাশিয়ার জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে আশঙ্কাজনক ভাবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ১৮-২৯ বছর বয়সীদের যুদ্ধে যোগ দিতে অনুরোধ করেছে। রাশিয়া ভারতের থেকে আয়তনে পাঁচ গুন বড় কিন্তু ভারতের জনসংখ্যা যেখানে ১৩৫ কোটি সেখানে রাশিয়ার মাত্র ১৪.৪১ কোটি!! একজন ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষনা করেছে যদি কোন রাশিয়ান মহিলা ১০ টি করে বাচ্চা জন্ম দিতে পারে তাহলে তাকে এককালীন ১৩ লাখ টাকা এবং প্রতি বাচ্চা পীছু মাসে ৫০০০ রুবেল বা ৬৭৫০ টাকা করে দেবে। জনসংখ্যা এতটাই কম রাশিয়ায় এছাড়া উপায় নেই আর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রচুর রাশিয়ানের মৃত্যুর পর তৎকালীন রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি জোসেফ স্তালিনও এই একই নীতি নিয়েছিল। তখন যে মা ১০ টি বাচ্চা জন্ম দিত তাকে সমাজে উচ্চ স্থান দেওয়া হত এবং মাদার হিরোইন নামে বিশেষ উপাধি দেওয়া হত।
আমেরিকা ও ইউরোপ ইউক্রেন বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য তো করছিলই তবে আমেরিকা সম্প্রতি এমন একটি বিশেষ অস্ত্র দেয় যা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আমেরিকা ইউক্রেনকে এম ১৪২ হিমারস হাই মোবিলিটি আর্টিলারি রকেট সিস্টেম সরবরাহ করেছে। এর রেঞ্জ ৩০০ কিলোমিটার। আফগানিস্তান, ইরাক ও সিরিয়াতে আমেরিকা এটা ব্যবহার করেছিল। এটা ব্যবহার করে ইউক্রেন রাশিয়ার বিভিন্ন বেসে দূর থেকেই আক্রমন করছে। রাশিয়া তার গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে, সাপ্লাই কম করে দিয়েছে। রাশিয়া চাইছে চাপে পড়ে ইউরোপ যাতে ইউক্রেনকে সমর্থন না করে। তবে ইউক্রেন রাশিয়াকে কাউন্টার আক্রমন করছে মানে এই নয় তারা জিতছে। আসলে রাশিয়া ও ইউক্রেন দুজনের অবস্থাই খারাপ। উভয়পক্ষেরই প্রচুর সেনা মারা যাচ্ছে বরং ইউক্রেনের একের পর এক শহর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। তবে এরই মধ্যে একটি বড় ঘটনা ঘটে গেছে। যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে এই প্রথমবার নিউইয়র্কে হওয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠকে ভারত রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে মোট ১৫ টি সদস্য দেশ আছে যার মধ্যে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স এই পাঁচটি দেশ স্থায়ী সদস্য এবং বাকী ১০ টি দেশকে দুই বছরের জন্য যুক্ত করা হয়। ২০২২ অবধি ভারতও এর সদস্য। এখানে একটি ভোটিং এর আয়োজন করা হয় যে রাশিয়া ইউক্রেনের ছয়মাস যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি একটি বক্তৃতা দেবে। রাশিয়া এর বিরোধীতা করে, চীন ভোট দেয় নি এবং ভারত সহ বাকী ১৩ টি দেশ ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দেয়। রাশিয়ার দাবি ছিল যদি জেলেনেস্কিকে বক্তৃতা দিতে হয় তাহলে তাকে সশরীরে নিউইয়র্কে আসতে হবে কিন্তু যুদ্ধের কারনে ভিডিও কনফারেন্স জেলেনেস্কি বক্তৃতা দেয়, রাশিয়া এর বিরুদ্ধে ছিল। তবে এটা কোন বড় ব্যাপার নয়, এর কারনে ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্কে কোন ঝামেলা হবেনা। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এসব হয়েই থাকে।
ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে সরাসরি রাশিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধ করলে রাশিয়া ইউরোপ সহ আমেরিকাকে পরমানু যুদ্ধের হুমকী দিয়েছে। রাশিয়া ও আমেরিকার যুদ্ধ হলে তা সরাসরি পরমানু যুদ্ধে পরিনত হবে এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আমেরিকা যুদ্ধে জড়িতে হলে ইউরোপও আমেরিকার পক্ষ নেবে এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক মিলিয়ন ডলার খরচ করে তথ্য জোগাড় করে একটি গবেষনা রিপোর্ট তৈরি করেছে যাতে বলা হয়েছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৮০০ কোটি। এই মহূর্তে আমেরিকা ও রাশিয়ার যুদ্ধ হলে প্রায় পাঁচ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি লোক মারা যাবে। জাতিসংঘের প্রধান অ্যান্তেনিও গুতারেস বলেছেন সব সময় ভাগ্য সহায়তা করবে না, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এমন অবস্থায় রয়েছে যে একটা ছোট ভুল থেকে বিধ্বংসী পরমানু যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। এই মহূর্তে সবচেয়ে বেশী পরমানু অস্ত্র আছে রাশিয়ার কাছে প্রায় ৫,৯৯৭ টি এবং আমেরিকার কাছে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রায় ৪,০১৮ টি পরমানু অস্ত্র আছে। সুতরাং এই দুই দেশের যুদ্ধ কতটা প্রানঘাতী হতে পারে তা বুঝতেই পারছেন। বিশ্বের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি একটি বিষয়ে গবেষনা করছে যে যদি পরমানু যুদ্ধ হয় তাহলে মানব জাতিকে কী করে বাঁচানো যাবে, পরিবেশে কী প্রভাব পড়বে। এই গবেষনায় দেখা গেছে যদি ভারত পাকিস্তানের মধ্যেই পরমানু যুদ্ধ হয় এবং উভয় দেশ ১০০ টি পরমানু অস্ত্র ব্যাবহার করে তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ২৭ মিলিয়ন বা ২ কোটি ৭০ লাখ লোক মারা যাবে। পরবর্তী ১০ বছরে অনাহারের কারনে ২০০ কোটি লোক মারা যাবে।
পরমানু বোম্ব বিস্ফোরন হলে গোটা আকাশে মাশরুমের মতন মেঘ তৈরি হয় এবং চারদিক কালো হয়ে যায় একে সুট বলে। এর প্রভাবে আশেপাশের এলাকায় সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারবে না এবং তেজস্ক্রিয়তার কারনে জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাবে এবং যে তীব্র দুর্ভিক্ষ শুরু হবে তাতে ২০০ কোটি মানুষ মারা যাবে। এটাতো একটি ছোট পরমানু যুদ্ধের উদাহারন। যদি ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে আমেরিকা ও রাশিয়ার মধ্যে পরমানু যুদ্ধ হয় তাহলে ৪৪০০ পরমানু বোম্ব ব্যবহৃত হবে যাতে ইউরোপ, আমেরিকা ও রাশিয়ায় সঙ্গে সঙ্গে ৩৬ কোটি মানুষের মৃত্যু হবে। এবং পরমানু সুটের কারনে পরে আরও ৫০০ কোটি লোক অনাহারে মারা যাবে। আমেরিকার জনসংখ্যা প্রায় ৩৪ কোটি, ইউরোপের ৭৪ কোটি এবং রাশিয়ার ১৪.৪১ কোটি, এই পুরো জনসংখ্যা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তবে বিজ্ঞানীদের দাবি ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ের মতন লাতিন আমেরিকান দেশ গুলো তুলনামূলক ভাবে সুরক্ষিত থাকবে। পরমানু যুদ্ধের ফলে অনাহারেই সবচেয়ে বেশী মানুষের মৃত্যু হবে সেজন্য বিজ্ঞানীদের দাবি এমন ধরনের শস্যর উৎপাদন বাড়াতে যাতে সূর্যের আলো এবং জল কম লাগে। জোয়ার, বাজরা, রাগী এধরনের শস্য যেখানে জল, সূর্যের আলো কম দরকার হয় এবং এগুলি অনুর্বর জমিতেও সহজে হয়। ভারত এধরনের শস্য উৎপাদনে অনেক এগিয়ে।