ভারতবর্ষের রাফালে এবং চীনের J-20 সীমান্তে সংঘর্ষ হলে কি হতে পারে জানেন?
নিউজ ডেস্কঃ ভারতবর্ষের হাতে রাফালে আসার পর এক লাফে ভারতের বায়ুসেনার ক্ষমতা যে বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলাই বাহুল্য। রাফালে পঞ্চম প্রজন্মের বিমান না হলেও খুব সহজেই যে পঞ্চম প্রজন্মের বিমানকে টেক্কা দিতে পারে তা বলাই বাহুল্য। পাকিস্তানের হাতে থাকা বিমান গুলি ভারতের সাথে টেক্কা দিয়ে সুবিধা করে উঠতে পারবেনা, তবে চীনের হাতে থাকা পঞ্চম প্রজন্মের বিমান জে ২০ অনেকের অনেক মতামত আছে।
কি হবে,যদি এই মুহূর্তে ভারতের রাফালে এবং চীনের J-20 সীমান্তে সম্মুখীন হয় ?
প্রশ্নটা এমনই ছিল।আর এই প্রশ্নটা এই মুহূর্তে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।কারন আবহাওয়া ঐ দিকেই সংকেত দিচ্ছে। সম্মুখীন হলে কি হবে তা সম্মুখীন হওয়ার পরেই বোঝা যাবে। কিন্তু এই দুই যুদ্ধবিমানের চারিত্রিক দিক গুলি বিশ্লেষণ করলে,তার কিছুটা আভাস পূর্বেই পাওয়া যেতে পারে।
আসলে রাফালে ও J-20 হল অনেকটা আপেল ও কমলালেবুর মতো। দুটোই অন্যান্য ফলের থেকে দামী কিন্তু একে অপরের সাথে তুলনার যোগ্য নয়। অর্থাৎ আকাশ যুদ্ধে দুটিরই কাজ ভিন্ন ভিন্ন রকমের। কিন্তু এখন জাতীয়তাবাদী ভাবধারার আকাশে এসব বোঝার সময় নেই। এই দুইয়ের মধ্যে সম্মুখীন যুদ্ধ হলে কে জিতবে? সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে
মূলত আকাশ যুদ্ধকে দুই ভাগে ভাগ করে নেওয়া যেতে পারে, একটা হল -BVR এবং অপরটি হল WVR। প্রথমটির সংক্ষিপ্ত অর্থ হচ্ছে পাইলটের চোখের সীমার বাইরে যে যুদ্ধ করতে হবে, শুধু রাডারের সাহায্যে। আর দ্বিতীয়টির মানে হচ্ছে পাইলটের দৃষ্টিশক্তির মধ্যেই এই যুদ্ধ হবে, প্রয়োজনে রাডারের ব্যবহারও করা হতে পারে। এই WVR যুদ্ধে ভারতীয় রাফালের সামনে চীনা J-20 টিকতে পারবে না। কারন WVR যুদ্ধের জন্য রাফালের কাছে অতিরিক্ত ম্যানুভারিটি ও প্রয়োজনীয় অস্ত্র রয়েছে, যা J-20 তে অনুপস্থিত। তাই WVR এর তুলনা করে লাভ নেই। আসল তুলনা করতে হবে BVR রেঞ্জে কোন যুদ্ধবিমান কি করতে সক্ষম। আর সেই দিক থেকে দুই যুদ্ধবিমানের পারফরম্যান্স বিচার করে দেখতে হবে,আর সেগুলো হল :–
● BVR মিসাইল
● রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি (RF) সিগনেচার
● AESA রাডার
● AWACS কভার
● অপটিক্যাল ডিটেকশন বা শনাক্তকরম এবং ট্র্যাকিং সিস্টেম
● ডিফেন্সিভ স্যুইট
● হিউম্যান মেশিন ইন্টারফেস (HMI)
তুলনা শুরুর আগে একটা কথা মাথায় রাখুন — রাফালে সম্পর্কে যে তথ্য এখানে দেওয়া,তার সবকটিই যুদ্ধের ময়দানে প্রমাণিত হয়েছে,অর্থাৎ কাগজ কলম থেকে হাতে কলমে করা হয়েছে। অপর দিকে J-20 এর সম্পর্কে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে,তা সবই চীনা কমিনিস্ট সরকারের দাবী। অর্থাৎ আপনারা এই তুলনা কিভাবে নেবেন,সেটা আপনাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার
BVR মিসাইল :
রাফালে এবং J-20 উভয়ের কাছেই লংরেঞ্জ এ প্রহার করার মতো অ্যাক্টিভ সিকার যুক্ত BVR মিসাইল রয়েছে। রাফালের কাছে রয়েছে মিটিওর এবং J-20 এর কাছে রয়েছে PL-15 মিসাইল। দুটোই ডুয়াল পালস প্রোপালশন যুক্ত। তবে মিটিওরে যেখানে সেকেন্ড স্টেজে র্যামজেট ব্যবহার করা হয়,সেখানে PL-15 এ রকেট ফুয়েল মোটর ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়। আর এর ফলে যেখানে লংরেঞ্জ এ মিটিওর আরো মারাত্মক হয়ে পরে যে কোন এরিয়াল টার্গেটের বিরুদ্ধে, সেখানে হাই ম্যানুভারিটি যুক্ত এরিয়াল ভেহিকেল (যেমন ফাইটার জেট) এর সামনে PL-15 লংরেঞ্জ এ কি পারফরম্যান্স করবে,তা সন্দেহের মধ্যে থাকবে।
তাই BVR মিসাইল পারফরম্যান্স এ রাফালের J-20 এর থেকে এগিয়ে থাকবে।
RF সিগনেচার :
খাতায় কলমে J-20 হল একটি পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ জেট , এটির সামনের দিক থেকে সম্পূর্ণ ভাবে স্টেলথ,অপর দিকে রাফালের সামনের দিক থেকে আংশিক ভাবে স্টেলথ। অর্থাৎ রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি সিগনেচার J-20 এর কম, অর্থাৎ একে রাডারে ধরা রাফালের তুলনায় কঠিন হবে। উভয় ফাইটার জেটেই RAM ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ RF সিগনেচার এর দিক থেকে চীনা J-20 এগিয়ে থাকবে।
খাতায় কলমে স্টেলথ টেকনোলজি তে J-20 এগিয়ে থাকবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এটা আবার সরাসরি অস্বীকার করছে ভারতীয় বায়ুসেনার অভিজ্ঞ অফিসাররা। আমেরিকা তাদের F-22 কে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ স্টেলথ ফাইটার বলে প্রচার করেছে। ২০০৯ সালের একটি এয়ারশো তে রাফালে F-22 কে রাডার লক করে। তাছাড়া ভারত-তিব্বত সীমান্তে ভারতীয় বায়ুসেনার SU-30 MKI লংরেঞ্জ থেকে চীনা J-20 কে রাডারে লক করেছে। J-20 কে অ্যারোডায়নামিক সুপিরিয়র করে তুলতে এটিতে ক্যানারড ব্যবহার করা হয়, যেটা কোন পঞ্চম প্রজন্মের বিমানে ব্যবহারর হয় না। যখনই এই ক্যানারড মাঝ আকাশে ব্যবহার হবে, তখনই J-20 এর রাডার সিগনেচার বেড়ে যাবে। তাই রাফালের রাডারের সামনে J-20 এর স্টেলথ ফিচার কতটা কার্যকরী তা,ময়দানে না নামলে বোঝা যাবে না।
AESA রাডার
খাতায় কলমে রাফালের তুলনায় J-20 এর অধিক শক্তিশালী AESA রাডার রয়েছে। J-20 এর AESA রাডারে T/R মডিউল এর সংখ্যা ২০০০-২২০০ টি,অপর দিকে রাফালের RBE2 AESA রাডারে T/R মডিউল এর সংখ্যা ১০০০। অর্থাৎ চাইনীজ জেটের রাডার সহজেই রাফালের গ্যালিয়াম আর্সেনাইড বেসড রাডারকে টেক্কা দিতে পারবে। চীনা জেটের AESA রাডারের রেঞ্জ ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ক্ষমতাও বেশি হবে।
J-20 এর AESA রাডার অধিক শক্তিশালী হলেও, আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায়,যে এটি রাফালে এর মতো যুদ্ধবিমানেরর বিরুদ্ধে কতটা কার্যকরি হবে? J-20 এর রাডারে হাইটেক LPI (লো প্রোবাবিলিটি অফ ইন্টারসেপ্ট) ফিচার নেই। ফলে সহজেই রাফালের মতো জেটের বিরুদ্ধে J-20 তার লংরেঞ্জ রাডারের সুবিধা নিতে পারবে না। একবার যখন J-20 তার শক্তিশালী রাডার অন করবে, তখন তার উচ্চ রেডিয়েটিং পাওয়ার এমন ভাবেই কাজ করবে, যেমনটা একটা শক্তিশালী টর্চ লাইট কঠিন অন্ধকারের মধ্যে আলো ছড়ায়। সেক্ষেত্রে টর্চ লাইট নিজে অনেক দুরে আলো ফেলতে পারলেও, নিজেও অনেক দুর থেকে নিজেকে মেলে ধরে। আর এটা জেটের সাথে হয় রাডারে ভালো LPI টেকনোলজি না থাকার কারনে। যখনই J-20 রাফালের বিরুদ্ধে তার রাডার অন করবে,সাথে সাথে সেও রাফালের RF সেন্সরের মাধ্যমে নিজেও ধরা খাবে। সেক্ষেত্রে J-20 এর শক্তিশালী রাডার চতুর্থ প্রজন্মের ফাইটারের বিরুদ্ধে লংরেঞ্জ থেকে ভালো কাজ করলেও, রাফালের বিরুদ্ধে কতটা কার্যকরি হবে,তা প্রশ্ন থেকে যায়।
AWACS কভার :
চীনা বিমান বাহিনীর AWACS ভারতীয় বিমান বাহিনীর চিন্তার কারন হতে পারে। কারন ডাটা লিংক ব্যবহার করে J-20 যদি AWACS এর আন্ডারে অপারেশন করতে বেরোয়,তাহলে হতে পারে একটা বিরাট অঞ্চল জুড়ে J-20 কে রাডার ই অন করতে হল না। সেক্ষেত্রে এটা J-20 এর জন্য বড় সুবিধা হবে। অপর দিকে ভারতীয় বায়ুসেনাও একই নীতি নিতে পারে রাফালের এর সাথে। কিছু ভারতীয় বায়ুসেনার AWACS ফ্লীট সাইজ ,চীনের বিমান বাহিনীর AWACS ফ্লীটের তুলনায় ছোট হওয়ায়, ততটা কার্যকরি হবে না, যতটা চীনারা সুবিধা পাবে। তাই ভারতীয় বায়ুসেনার এই ব্যাপারে দ্রুত কাজ করা উচিত।
অপটিক্যাল ডিটেকশন এবং ট্র্যাকিং
J-20 রয়েছে EOTS-89 ইলেকট্রো অপটিক্যাল। টার্গেটিং সিস্টেম এবং ইলেকট্রো অপটিক্যাল ডিস্ট্রিবিউটর অ্যাপারচার সিস্টেম। মনে করা হয়,চীনারা এটিকে আমেরিকার F-35 এর EOTS সিস্টেম কে নকল করে তৈরী করেছে। এটিতে একত্রে ফরোয়ার্ড লুকি ইনফ্রারেড (FLIR) এবং ইনফ্রারেড সার্চ অ্যান্ড ট্র্যাক ক্ষমতা রয়েছে।
রাফালের অপটিক্যাল ডিটেকশন এবং ট্রাকিং সিস্টেম কে OSF-IT বলা হয়। এটির প্যাসিভ লংরেঞ্জ ডিটেকশন এবং এনগেজমেন্ট এর আগে টার্গেট ডিটেকশন ক্ষমতা রয়েছে। পুরো সিস্টেম টি রাফালের এর সামনের দিকে লাগানো থাকে। এর IR ডিটেক্টর ১০০ কিলোমিটার দুরের টার্গেট কেও শনাক্ত করতে পারে, আর এর TV/IR সেন্সর/লেজার রেঞ্জার অপটিকস ৪০ কিলোমিটার দুর থেকেই টার্গেট শনাক্ত করতে পারে। J-20 যেহেতু IR স্টেলথ নয়, তাই এটি সহজেই ধরা খাবে। আর তাই অপটিক্যাল ডিটেকশন এবং ট্র্যাকিং সিস্টেম এ রাফালে এগিয়ে থাকবে।
ডিফেন্সিভ স্যুইট :
সম্ভবত অন্তত এই একটি ফিচার রাফালের এমন রয়েছে,যা দিয়ে সে J-20 কেন? পৃথিবীর অন্য যেকোন যুদ্ধবিমানকে গুনে গুনে দশ গোলে হারাতে পারবে। সামরিক বিশেষজ্ঞের মতে,রাফালে ক্রয় করার পেছনে এটিই সবচেয়ে বড় কারন, আর তা হল রাফালের স্পেক্ট্রা ডিফেন্সিভ স্যুইট।এই স্পেক্ট্রা রাফালেকে ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার এ দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স দেয়। এটি রাফালে কে মাল্টি স্পেকট্রাল থ্রেট ওয়ার্নিং ক্ষমতা দেয়।
স্পেক্ট্রা সিস্টেম রাডার ওয়ার্নিং,লেজার ওয়ার্নিং, মিসাইল ওয়ার্নিং রিসিভার এর মাধ্যমে আগত হুমকিকে কে বিশ্লেষণ করে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে একটি ফেসড অ্যারি রাডার জ্যামার ও ডেকয় ডিসপেন্সার সিস্টেম। স্পেক্ট্রা শত্রুর RF এমিটারস কে জ্যাম করতে অথবা বোকা বানাতে পারে RBE2 AESA রাডারের সাহায্য নিয়ে। আর স্পেক্ট্রা অটোমেটিক ভাবে চীনের PL-15 মিসাইলকে বোকা বানাতে অথবা জ্যাম করতে সক্ষম। ফলে J-20 যে সুবিধা AWACS দিয়ে পেত, তার কার্যকরীতা কমে যাবে।
তাছাড়া যদি ভালো জ্যামার থাকে,ভালো ম্যানুভারিটি থাকে এবং দক্ষ পাইলট থাকে,তাহলে মিসাইলের নো স্কেপ জোন চিন্তাও ব্যর্থ হয়ে যায়। যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ বালাকোট এয়ার স্ট্রাইকের পরে ভারতীয় বায়ুসেনার SU-30 MKI এর দিকে পাকিস্তানের F-16 দের ছোড়া সাতটা AIM-120D মিসাইল ব্যর্থ হওয়া। ওপরের ঐ তিনটি বৈশিষ্ট্যর জন্য ভারতীয় SU-30 MKI কে পাকিস্তানের F-16 পাইলটরা তাদের মিসাইলের নো স্কেপ জোনে পেয়েও, কিচ্ছু করতে পারে নি। আর এক্ষেত্রে রাফালের এর কাছে ঐ তিনটি বৈশিষ্ট্য ই J-20 এর থেকে ভালো রয়েছে।
হিউম্যান মেশিন ইন্টারফেস (HMI) :
রাফালে এবং J-20 উভয়েই সিঙ্গেল সিটার ফাইটার জেট। সেক্ষেত্রে পাইলটকে একসাথে নেভীগেশনের পাশাপাশি আর্মামেন্ট ও সামলাতে হয়। সেক্ষেত্রে যার সেন্সর যত সহজে ব্যবহার করা যাবে, সেই পাইলট দ্রুত তার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আর এক্ষেত্রে অর্থাৎ BVR ব্যাটেল এ, যে আগে রাডারে মিসাইল লক করতে পারবে,জয় তার। আর তাই ককপিটের HMI যার যত সহজ, এ বেশি সুবিধা পাবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।
J-20 এর রয়েছে ফুল গ্লাস ককপিট,যাতে একটি লার্জ LCD কালার টাচ স্ক্রীন রয়েছে,যার মধ্যে তিনটি ছোট ছোট জানলা রয়েছে। তাছাড়া একটি ওয়াইড অ্যাঙ্গেল হলোগ্রাফিক হেড-আপ ডিসপ্লে রয়েছে (HUD)।
তবে রাফালের আরো ভালো HMI রয়েছে। অল্প সময়ের যুদ্ধ করার জন্য রাফালের ওয়াইড ফিল্ড অফ ভিউ হলোগ্রাফিক HUD রয়েছে। আর মধ্যবর্তী এবং দূরবর্তী যুদ্ধের সময় পর্যবেক্ষণের এর জন্য এর মাল্টি ইমেজ হাই লেভেল ডিসপ্লে (HLD) রয়েছে।
মিশনে যখন পাইলটের হাত কনট্রোল স্টিক আর চোখ HUD এবং HLD তে থাকবে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই রাফালে সুবিধা পাবে বেশি J-20 এর থেকে।
রাফালে বনাম J-20 এর এই হল টেকনিক্যাল পার্থক্য। যেখানে স্টেলথ (খাতায় কলমে) ও AWACS কভারের জন্য J-20 সুবিধা পাবে। আর বাকি সব ক্ষেত্রে রাফালে আকাশে নিজের ক্ষমতা বজায় রাখবে।