চীন কেন আফ্রিকাতে এত বিনিয়োগ করছে জানেন? পেছনে কি মতলব আঁটছে জিনপিং?
রাজেশ রায়:- ১৮৯২ সালে ব্রিটেনের সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন পাঞ্চে একটি কার্টুন ছাপা হয় যা ছিল একজন বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যাবসায়ী সিসিল রোডসের। কার্টুনে দেখানো হয় সিসিল রোডস হাতে টেলিগ্রাফিক লাইন নিয়ে আফ্রিকার মানচিত্রের উপর দাঁড়িয়ে আছে। বিখ্যাত কার্টুনিস্ট এডওয়ার্ড লিনলির আঁকা এই ছবিতে দেখানো হয়েছে ব্রিটেন আফ্রিকাতে তার সমস্ত কলোনীতে টেলিগ্রাফ লাইন ও রেল লাইন করতে চাইছে। ১৮৮০ সাল থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার সময় পর্যন্ত আফ্রিকার দখল নিয়ে বিভিন্ন ইউরোপীয়ান দেশ গুলোর প্রতিযোগিতা ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার অন্যতম একটি কারন এই আফ্রিকাতে সাম্রাজ্য বিস্তারের নীতিকেও বলা হয়। বর্তমানে আবারও সেই একই রকম শুরু করে তবে একবিংশ শতাব্দীতে অনেক কীছু বদলে গেছে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও স্ট্রাটেজিক কারনে আজ আফ্রিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এখন কোন ইউরোপীয়ান শক্তি আফ্রিকাতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে না বরং এশিয়ার শক্তিশালী দেশ চীন আফ্রিকা নিয়ে আগ্রহী। চীন এমনই একটা দেশ যারা কোন যুদ্ধ ছাড়াই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভূখন্ডে প্রভাব বিস্তার করছে। সত্যি কথা বলতে কী পুরো আফ্রিকাতেই চীনে যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে কিন্তু উত্তর পূর্ব আফ্রিকা নিয়েই চীনের আগ্রহ বেশী যাকে হর্ন অফ আফ্রিকাও বলা হয়। কিন্ত হর্ন অফ আফ্রিকাতে এমন কী আছে যার জন্য চীন এত আগ্রহী! আমেরিকা ও তার বন্ধু রাষ্ট্রদের এড়িয়ে চীন কী এখানে টিকতে পারবে? কিংবা এর প্রভাব বিশ্ব অর্থনীতি নিরাপত্তার উপর কেমন হবে? এইসব বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর পূর্বে অবস্থিত হর্ন অফ আফ্রিকা বিশ্বের চতুর্থ দীর্ঘতম পেনিনসুলা। কোন দেশের মূল ভূভাগ থেকে বিস্তৃত এবং চারদিকে জল দিয়ে ঘেরা অঞ্চলকে পেনিনসুলা বলা হয়। কয়েকশো কিলোমিটার লম্বা এই অঞ্চল একইসাথে ভারত মহাসাগর, এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগরে যুক্ত। হর্ন অফ আফ্রিকার চারটি প্রধান দেশ হচ্ছে জীবুতি, এরিট্রিয়া, ইথিওপীয়া এবং সোমালিয়া। এছাড়া সুদান, দক্ষিন সুদান, উগান্ডা ও কেনিয়াও হর্নের অংশ। বহু যুগ ধরেই এই দেশ গুলো নিজেদের মধ্যেই সীমান্ত নিয়ে যুদ্ধ করছে তাছাড়া দারিদ্রতা, অনাহার, রোগ এখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রয়েছে। কিন্ত তাও এই অঞ্চল স্ট্রাটেজিক্যালি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে দক্ষিন লোহিত সাগরে অবস্থিত বাব এল মান্দেব গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট যার কাছে সোমালিয়া অবস্থিত। এখান দিয়ে বিশ্বের মোট সমুদ্র বানিজ্যের ১২ শতাংশ যায়। প্রতিবছর ৪.৮ মিলিয়ন ব্যারেল পেট্রোলিয়াম সহ অন্যান্য জিনিসপত্র এখান দিয়ে পরিবহন হয়। আরবের কাছে অবস্থিত হওয়ায় তেল বানিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পথ এটা। সমুদ্র বানিজ্য ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ বন্দর, অস্ত্র ব্যাবসার কারনে বহুদিন ধরেই বিশ্বের শক্তিশালী দেশ গুলোর নজর রয়েছে এখানে। গল্ফ যুদ্ধ ও সোমালিয়াতে যুদ্ধের পর এই অঞ্চলের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেছে। ইয়ামেনে হওয়া যুদ্ধের কারনে হর্ন অফ আফ্রিকাতে বিদেশী শক্তি গুলোর উপস্থিতি চোখে পড়ার মতন। তবে এই এলাকা স্ট্রাটেজিক্যালি যতটা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভাবে ততটাই অস্থির। এই অঞ্চলের প্রত্যেকটি দেশ গত দুই দশক ধরে বিভিন্ন যুদ্ধে যুক্ত আছে। যেমন কেনিয়া ও সোমালিয়ার মধ্যে সীমান্ত নিয়ে ঝামেলা আছে।
সোমালিয়ার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ এখানে আল শাবাব নামে একটি কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠন রয়েছে যার সাথে সরকারের যুদ্ধ চলছে প্রতিনিয়ত। সুদানে মিলিটারি শাসন চলছে। ইথিওপীয়াতে গৃহযুদ্ধ চলছে। যেখানে একদিকে রয়েছে ইথিওপিয়ান মিলিটারি এবং অন্যদিকে রয়েছে টিগ্রেরিয়ান লিবারেশন ফোর্স। জাতিসংঘের মানব অধিকার সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ইথিওপীয়াতে গৃহযুদ্ধের কারনে এখনও অবধি ৫১ লক্ষ মানুষ ঘর ছাড়া রয়েছে। এর উপর এই দেশগুলোতে বৃষ্টি না হওয়ায় তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। এমনিতেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারনে মুদ্রাস্ফীতির জন্য গোটা বিশ্বেই আর্থিক মন্দা আছে তার উপর যুক্ত হয়েছে এই ধরনের সমস্য। এই অঞ্চলে প্রায় ১৮.৪ মিলিয়ন লোক খাদ্য সংকট ও অপুষ্টিতে ভুগছে৷ তাহলে এটা মনে হতেই পারে এইরকম এলাকায় চীন কেন এত আগ্রহী। ইতিহাসে বারংবার দেখা গেছে যখনই কোন দেশ অর্থনৈতিক ভাবে এবং সামরিক ভাবে শক্তিশালী হয়েছে তখনই সে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে। চীনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তবে চীন সরাসরি যুদ্ধের বদলে গরীব দেশগুলোতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। আফ্রিকাতে মূলত চারটি লক্ষ্য আছে চীনের। ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্ট, সমুদ্র, লোন এবং প্রাকৃিতিক সম্পদ। চীন এইসব দেশ গুলোকে লোনের ফাঁদে ফেলে তাদের ভূভাগ দখল করছে যাকে চীনের ডেব্ট ট্রাপ নীতি বলে। জীবুতিতে বেস তৈরি করে এবং হর্ন অফ আফ্রিকাতে উপস্থিত থেকে চীন ভারত মহাসাগরে নিজের উপস্থিতি আরও শক্তিশালী করতে চাইছে যা চীনের স্ট্রিং অফ পার্লস নীতির অংশ। এছাড়া হর্ন অফ আফ্রিকার মাধ্যমে মধ্য প্রাচ্যের রাজনীতিতে অংশ নিয়ে এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদেরও নজর রয়েছে চীনের।