ভারত

পরমানু সাবমেরিন ভারতবর্ষ কত সালের মধ্যে সার্ভিসে নিয়ে আসছে?

যুদ্ধের সময় যদি শত্রু বিপক্ষের অবস্থান সম্পর্কেই না জানে তাহলে সবচেয়ে বেশী সুবিধা হবে বিপক্ষেরই। বিপক্ষ স্ট্রাটেজিক অবস্থানে লুকিয়ে থেকে সময় বুঝে শত্রুর উপর আক্রমন করে।  আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী উপযোগী হচ্ছে সাবমেরিন। গোপনে শত্রুর উপর আক্রমন করতে সাবমেরিনের জুরি মেলা ভার। বর্তমানে আন্তর্জাতিক স্তরে অনেক বেশী আলোচ্য বিষয় ভারতের পরমানু সাবমেরিন। আরও ভাল করে বললে ভারত রাশিয়া থেকে একটি পরমানু সাবমেরিন লিজ নিতে চলেছে যার নাম আইএনএস চক্র ৩. রাশিয়া থেকে ভারত এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কিনেছিল, এটা তার পর হতে চলা সবচেয়ে বড় চুক্তি। আরও বেশী আলোচনা হচ্ছে কারন এই মহূর্তে ইউক্রেনে আক্রমনের কারনে রাশিয়াকে বিশ্বে এক ঘরে করে দেওয়া হয়েছে, এই পরিস্থিতিতে ভারতে রাশিয়ার সাথে এই সাবমেরিন চুক্তি কতটা উচিত তা আলোচনা চলছে আন্তর্জাতিক স্তরে। এবার অনেকের মনে হবে ভারত সাবমেরিন না কিনে লিজ নিচ্ছে কেন! অনেকের এটাও মনে হবে যদি কোনও সাবমেরিন নিউক্লিয়ার মিসাইল লঞ্চ করতে পারে তাহলে তাকে হয়ত নিউক্লিয়ার সাবমেরিন বলা হয় কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল। কোন সাবমেরিন চলবার জন্য পাওয়ার কীভাবে পায় তার উপর নির্ভর করে সাবমেরিনটি কোন শ্রেনীর। নিউক্লিয়ার সাবমেরিনে শক্তি আসে নিউক্লিয়ার রিয়াক্টার থেকে। এর উপর নির্ভর করে পরমানু সাবমেরিনেরও অনেক ভাগ আছে। আজ এসমস্ত বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

প্রধানত সাবমেরিন দুই ধরনের ডিজেল ইলেকট্রিক অ্যাটাক ও নিউক্লিয়ার অ্যাটাক। এই দুই ধরনের সাবমেরিনই নিউক্লিয়ার মিসাইল বহন করতে পারে সুতরাং পরমানু সাবমেরিন মানেই যে নিউক্লিয়ার মিসাইল বহন করতে পারবে এই কথাটা ভুল। ডিজেল ইলেকট্রিক অ্যাটাক সাবমেরিনে থাকে ডিজেল ইন্জিন ও ইলেকট্রিক ব্যাটারি। কিন্তু ডিজেল ইলেকট্রিক অ্যটাক সাবমেরিনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে অক্সিজেনের সমস্যা। ৪৮ ঘন্টা অন্তর অন্তর একটি ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনকে অক্সিজেনের জন্য বাইরে আসতেই হয়। এবার যুদ্ধ কালীন পরিস্থিতিতে যদি এরকম হয় তাহলে খুব সহজেই শত্রু হাতে সাবমেরিন ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনের একটি উন্নত রূপ আছে যাতে এআইপি সিস্টেম আছে। এআইপি বা এয়ার ইন্ডিপেন্ডেন্ট প্রোপালশন যা সাবমেরিনকে বাতাস থেকে অক্সিজেন না নিয়েই জলের মধ্যে অন্তত ২-৩ সপ্তাহ থাকতে সাহায্য করে। কিন্ত নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিনে একবার ফুয়েল ভরে দিলে তা ৩০-৪০ বছর একটানা জলের তলায় থাকতে পারে। শুধু সাবমেরিনের নাবিকদের খাবারের জন্য উপরে আসতে হয়। ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিনের থেকে নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিন তৈরি ও অপারেশন অনেক বেশী খরচের। নিউক্লিয়ার পাওয়ার সাবমেরিনের দুটি ভাগ আছে এসএসবিএন এবং এসএসএন। এসএসবিএন বা সাবমারসিবেল শিপ ব্যালেস্টিক নিউক্লিয়ার সাবমেরিনে মিসাইল হিসাবে পরমানু ওয়ারহেড যুক্ত মিসাইল থাকে এবং এসএসএন বা সাবমারসিবেল শিপ নিউক্লিয়ারে মিসাইল হিসাবে ক্রুজ মিসাইল থাকে কিন্তু উভয় সাবমেরিনেই নিউক্লিয়ার রিয়াক্টার থাকে। ভারত রাশিয়া থেকে যে আইএনএস চক্র ৩ সাবমেরিন লিজে নিতে চলেছে তা ১০ বছরের জন্য এবং এতে খরচ হবে ৩ বিলিয়ন ডলার বা প্রায় সাড়ে বাইশ হাজার কোটি টাকার!! তাহলে ভাবুন যদি ভাড়া নিতেই এত খরচ হয় তবে তৈরি করতে কত খরচ।

রাশিয়া ২০২৫ এর মধ্যে ভারতকে এটি দিয়ে দেবে এমনই কথা আছে তবে বলা  হচ্ছে রাশিয়া যেহেতু ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাস্ত তাই এই চুক্তি পিছিয়ে যেতে পারে। এই সাবমেরিন যুক্ত হলে ভারতীয় নেভিতে দুটি ক্যারিয়ার ব্যাটেল গ্রুপ তৈরি হবে। ক্যারিয়ার ব্যাটেল গ্রুপ জিনিসটা কী? একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, ২-৩ টি ডেস্ট্রয়ার, একটি নিউক্লিয়ার সাবমেরিনকে নিয়ে সাধারণত একটি ক্যারিয়ার ব্যাটেল গ্রুপ তৈরি হয়। ১৯৭১ এ ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে ছিল তখন আমেরিকা তাদের একটি ক্যারিয়ার ব্যাটেল গ্রুপ বঙ্গোপসাগরে পাঠিয়ে দেয়। তখন ভারতের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের ব্যাপক ভাল সম্পর্ক ছিল যার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নও তাদের নিউক্লিয়ার সাবমেরিন ভারতের সমর্থনে পাঠায়। তখনই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ঠিক করেন নিউক্লিয়ার সাবমেরিন তৈরি করবে ভারত। এরপর ভারত নিজস্ব পরমানু বোম্ব টেস্ট করে এবং ১৯৯০ সালে ঠিল হয় ভারত পরমানু সাবমেরিন তৈরি করবে। কিন্তু পরমানু সাবমেরিন তৈরির জন্য যে নিউক্লিয়ার রিয়াক্টার দরকার তা অত্যন্ত জটিল টেকনোলজির যা ভারতের কাছে ছিল না। কারন ভারত এনপিটি বা নন প্রোলিফিরেশন অফ নিউক্লিয়ার ওয়েপনস চুক্তিতে সই করে নি। এই চুক্তিতে সই করলে ভারত কোনওদিন পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে পারত না তখন আমেরিকা ভারতকে এই টেকনোলজি দিত কিন্তু ভারতের পাশে পাকিস্তান ও চীনের মত শত্রু দেশ থাকায় ভারত এই চুক্তি করে নি। এই জন্য ভারত নিজেই নিউক্লিয়ার সাবমেরিন প্রজেক্ট শুরু করে। তবে তার পাশাপাশি ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সাবমেরিন লিজ নেবার সিদ্ধান্তও নেয়। ইতিমধ্যে জানেন ভারত আরিহান্ট ক্লাস নিউক্লিয়ার সাবমেরিন তৈরি করেছে ভারত তাহলে মনে হতেই পারে তাহলে রাশিয়া থেকে চক্র ৩ কেনার কী দরকার। দেখুন আরিহান্ট ক্লাস সাবমেরিন এসএসবিএন এবং চক্র হচ্ছে এসএসএন।

আরিহান্ট ক্লাস সাবমেরিন তৈরি করা হচ্ছে যাতে ভারত সমুদ্র থেকেও নিউক্লিয়ার মিসাইল লঞ্চ করবার সক্ষমতা অর্জন করে। কিন্তু ক্যারিয়ার ব্যাটেল গ্রুপ তৈরি করার জন্য এসএসএন দরকার। আমরা যে আরিহান্ট ক্লাস সাবমেরিন তৈরি করেছি, এর সূচনা হয় ১৯৯৮ সালে। অ্যাডভান্সড টেকনোলজি ভ্যেইকল প্রজেক্টে এই সাবমেরিন তৈরি করা হয়। ভারত এসএসবিএনের পাশাপাশি এসএসএন তৈরি তে নজর দিয়েছে। এরজন্য চক্র ৩ লিজ নেওয়া হয়েছে যাতে আগে ভাল ভাবে বুঝে নেবার জন্য। এছাড়াও লিজ নেবার অন্যতম নড় কারন পয়সা বাঁচানো, একটি চক্র ৩ তৈরিতে প্রচুর খরচ, সেই তুলনায় লিজে খুব কম খরচে পাওয়া যাবে। এতে এসএসএন তৈরিতে ভারতের অভিজ্ঞতা বাড়বে। আসলে বর্তমানে যুদ্ধের থেকে বেশী মানসিক শক্তির পরীক্ষা হয়, সেজন্য ভারত চক্র ৩ নিয়ে অন্তত সাইকোলজিক্যালি শক্ত করে রাখছে নিজেকে। ভারত ১৯৮৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে চার্লি ক্লাস সাবমেরিন কে-৪৩ লিজে নেয় যাকে ভারতীয় নেভিতে আইএনএস চক্র ১ বলা হয়। আসলে যুদ্ধ না করবার জন্যও শক্তিশলী অস্ত্র দরকার। নিউক্লিয়ার সাবমেরিন থাকার অর্থ সেই দেশের উপর অন্য দেশ চট করে আক্রমন করতে পারবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.