ভারত

হিন্দু এবং মুসলিমদের পবিত্র রহস্যময় স্থান বিজয়গড় দুর্গ

রাজেশ রায়:- উত্তর প্রদেশের শোনভদ্র জেলাতে অবস্থিত বিজয়গড় দুর্গের ইতিহাস মহাভারত কালের সাথে যুক্ত তবে এই দুর্গ চন্দ্রকান্তা দুর্গ নামে বেশী বিখ্যাত কারন এই দুর্গের রঙমহলে বিজয়গড়ের রাজকুমারী চন্দ্রকান্তা থাকতেন। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রাজা এখানে রাজত্ব করেছেন। কৈমুর পর্বতমালা বেষ্টিত ৪০০ ফুট উঁচু এই দুর্গ কোন এক সময়ে বিজয়গিরি নামে পরিচিত ছিল যেখানে ঋষিরা ধ্যান করতেন। বলা হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধ আক্রমনের সময় এই দুর্গতেই তার সেনাবাহিনীকে বিশ্রাম দিয়েছিলেন। বিজয়গড় দুর্গ থেকে ২৮০ কিলোমিটার দূরে মগধ অবস্থিত যা মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল, বর্তমানে এটি বিহারে অবস্থিত। মৌর্য বংশ ছাড়াও, গুপ্ত বংশ, গুর্জর প্রতিহার, মুঘল ও শেষে কাশী রাজের অধীনে এই দুর্গ ছিল। ১৮৮৮ সালে দেবকীনন্দন খাতরি দ্বারা লেখা হিন্দি উপন্যাস চন্দ্রকান্তা এই দুর্গের কাহিনীকে গোটা দেশে প্রসিদ্ধতো করেছিলই উপরন্ত ১৯৯৪-৯৬ সালে প্রসিদ্ধ সিরিয়াল চন্দ্রকান্তা বিজয়গড়ের নাম গোটা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছিল। রাজকুমারী চন্দ্রকান্তা ও নৌগড়ের ও নৌগড়ের রাজকুমার বীরেন্দ্র সিং এর প্রেম কাহিনী সত্যিই অদ্ভুত। এই দূর্গের ভিতরেই একটি গুহার সাহায্যে নৌগড়ের সাথে যোগাযোগ ছিল, যেখানে প্রচুর গুপ্তধন লুকিয়ে থাকার সম্ভবনা অনেকবার তৈরি হয়েছিল। এই দুর্গের একদিকে রয়েছে রামসাগর জলাশয় যার গভীরতা কেউ জানে না, শ্রাবন মাসে এখান থেকে জল নিয়ে মহাদেবের মাথায় অর্পন করে হিন্দু ধর্মের মানুষরা। অন্যদিকে এই দুর্গের একদিকে অবস্থিত মাজারে দূরদূরান্ত থেকে আসা মুসলিম পুন্যার্থীরা চাদর চড়ায়। আস্থা, ইতিহাস ও রহস্যে ভরপুর বিজয়গড় দুর্গ সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

উত্তর প্রদেশের শোনভদ্র জেলায় মৌকালান নামক গ্রামে এই বিজয়গড় দুর্গ অবস্থিত যা রবার্টসগন্জ থেকে ৩০ কিলোমিটার এবং বেনারস থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সরাসরি কোন গনপরিবহন এখানে যায় না। এখানে যেতে হলে রবার্টসগন্জ থেকে ব্যাক্তিগত গাড়ি অথবা অটো ভাড়া করে যেতে হয়। রবার্টসগন্জ থেকে বিজয়গড় দুর্গে পৌঁছানোর রাস্তা খুবই সুন্দর, প্রথমে একটি ড্যামের পাশ দিয়ে রাস্তা যায় তারপর যত এগোনো যায় রাস্তা সরু ও নির্জন হতো শুরু করে এবং জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে রাস্তা শুরু হয়ে শেষে বিজয়গড় দুর্গের সিঁড়িতে এসে শেষ হয়। গুগল ম্যাপে এই দুর্গে পৌঁছানো রাস্তা সম্পর্কে সঠিক ভাবে বলা নেই। দুর্গের সিঁড়ি তে পৌঁছে দুর্গে ওঠার জন্য ৪০০ ফুটের খাড়া সিঁড়ি শুরু হয়। উঠতে কষ্ট হলেও চারপাশের মোনোরম পরিবেশ মন ভরিয়ে দেয়। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই দুর্গে পৌঁছানোর প্রধান প্রবেশদ্বার সামনে আসে। দুর্গের দুদিকে দুটি প্রবেশদ্বার রয়েছে। আগেকার দিনের সব দুর্গের মতই এই দুর্গেরও প্রবেশদ্বারের মাথায় সুরক্ষা স্থান আছে এবং প্রবেশদ্বার থেকে চারদিক বেষ্ঠিত সুরক্ষা দেওয়ালও আছে। সুরক্ষা দেওয়ালের কাছেই সেনাদের থাকার জায়গা ছিল। সুরক্ষা স্থান অর্থাৎ প্রবেশদ্বারের মাথায় বেশ কিছুটা জায়গা যেখান থেকে সেনারা শত্রুপক্ষের উপর নজর রাখত, প্রয়োজনে তীর ছুড়ত। সুরক্ষা দেওয়াল থেকে আশেপাশের কৈমুর পর্বতমালা খুব সুন্দরভাবে দেখা যায়। এই পর্বত থেকেই পাথর নিয়ে এই দুর্গ নির্মান করা হয়েছে তবে বর্তমানে এই দুর্গ পুরো পরিত্যক্ত ভগ্নস্তূপ। এই দুর্গে মোট সাতটি জলাশয় রয়েছে যার মধ্যে রাম সাগর ও মীরা সাগর নামে দুটি জলাশয়ের জল যত গরমই হোক কখনও শুকোয়না। 

রাম সাগর জলাশয় সম্পর্কে লোককথা অনুযায়ী এখানে প্রাচীনকালে মানুষ যখন জল তুলতে আসত তখন জল থেকে বাসন পাওয়া যেত মানুষজন সেই পাত্রে খেয়ে আবার জলে ফেলে দিত। এটাও বলা হয় যে এই জলাশয়ের গভীরতা কতটা তা কেউ জানেনা। বিজয়গড় দুর্গ তৈরি হবার আগে এখানে সাধু মহাত্মাদের তপস্যা স্থল বিজয়গিরি পর্বত ছিল যার জন্য এখানে আজও অনেক সাধু পূজা অর্চনা করেন। পৌরানিক তথ্যসূত্র অনুযায়ী মহাভারত কালে বানাসুর এই দুর্গের নির্মান করেছিল এবং মগধ রাজ জরাসন্ধকে এখানেই বন্দি করা হয়েছিল। চতুর্থ শতাব্দী থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত এখানে গুপ্ত বংশের শাসন ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে ১০৩৬ সাল অবধি গুর্জর প্রতিহারদের শাসন ছিল এখানে। ১০৪০ সালে এক রাজপুত রাজা বিজয় পাল এই দুর্গ পুননির্মাণ করান। এরপর ১৫৫৬-১৬০৫ অবধি মুঘল সম্রাট আকবরের অধীনে ছিল এই দুর্গ। পরে মুঘলদের থেকে কাশী রাজ এই দুর্গ কেড়ে নেয় এবং ইংরেজদের আসার আগে অবধি তার বংশের অধীনেই ছিল এই দুর্গ। মহাভারত কাল থেকে শুরু করে ইংরেজ রাজত্ব পর্যন্ত অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই দুর্গ। প্রতিবছর এপ্রিল মাসে এখানে উর্স নামে বড় মেলা হয় একটি। এই দুর্গে একটি প্রাচীন গনেশ মন্দির আছে এবং দুর্গের প্রধান প্রবেশদ্বারের পাশেই হজরত মীরান শাহ বাবার মাজার রয়েছে। রাম সাগর ও মীরা সাগর জলাশয়ের মাঝে রয়েছে মহারানী চন্দ্রকান্তার মহল যাকে রং মহল বলা হয়। 

রাজকুমারী চন্দ্রকান্তার গল্প বিজয়গড়, নৌগড় ও চুনারগড় নিয়ে বিস্তৃত। নৌগড়ের রাজকুমার বীরেন্দ্র সিং তার শত্রু রাজ্য বিজয়গড়ের রাজকুমারী চন্দ্রকান্তাকে ভালবেসে ফেলে। কিন্তু বিজয়গড়ের রাজকন্যা চন্দ্রকান্তাকে বিয়ে করে রাজত্ব দখলের স্বপ্ন দেখত বিজয়গড়ের রাজা জয় সিং এর সেনাপতির ছেলে ক্রুড় সিং যার জন্য সে জয় সিংকে নৌগড়ের সাথে শত্রুতা বাড়ানোর পরামর্শ দিত। ধীরেন্দ্র সিং লুকিয়ে প্রায়ই চন্দ্রকান্তাকে চিঠি লিখত। একদিন বীরেন্দ্র সিং ছদ্মবেশে চন্দ্রাকান্তার সাথে দেখা করতে আসে যার খবর ক্রুর সিং পেয় যায় কিন্তু সেনা নিয়ে গিয়েও সে বীরেন্দ্র সিংকে খুঁজে পায়না। কিন্তু ধীরে ধীরে রাজা জয় সিং ক্রুর সিং এর দূর অভিসন্ধি সম্পর্কে জানতে পারেন এবং তাকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেয়। ক্রুর সিং চুনারগড় পালিয়ে যায় এবং সেখানকার রাজা শিব দত্তের সাথে বন্ধুত্ব করে। ক্রুর সিং এর প্ররোচনায় শিব দত্ত বিজয়গড় আক্রমন করে। চুনারগড়ের বিশাল সেনার মোকাবিলা করার জন্য বিজয়গড় নৌগড়ের সাহায্য চায় এবং এভাবে দুই শত্রু রাজ্যের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বীরেন্দ্র সিং এর সেনা চুনারগড়কে পরাস্ত করে। এই প্রেমকাহিনী ১৯৯৪-৯৬ সালের চন্দ্রকান্তা সিরিয়ালে দেখানো হয় যা সেইসময়ের সবচেয়ে বড় সিরিয়াল ছিল। এই দুর্গে প্রাচীন কালের অনেক অমূল্য মূর্তি ছিল যা বারবার আক্রমনের ফলে নষ্ট হয়ে গেছে। বলা হয় এই দুর্গের ভিতরই একটি গোপন গুহার মাধ্যমে নৌগড় এবং চুনারগড় দুর্গ পর্যন্ত যাওয়া যেত কিন্তু লোকগাথা অনুযায়ী সেই রাস্তা কোনও বিশেষ ব্যাক্তিই দেখতে পাবে এবং বিশ্বাস করা হয় এই দুর্গের সমস্ত ধন সম্পত্তি এখানেই লোকানো আছে। তবে দুঃখের বিষয় মহাভারত কালে তৈরি হওয়া এই দুর্গ আজ প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিনত হয়েছে। যদি সরকার এখনই কোন ব্যাবস্থা না নেয় তাহলে কীছু বছরের মধ্যেই এই দুর্গ ধ্বংস হয়ে যাবে পুরো। এখানকার রাস্তার উন্নয়ন করে, দুর্গকে সঠিক ভাবে রক্ষণাবেক্ষন করলে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটক কেন্দ্র হয়ে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.