শেষ তিন বছরে ২,৬১২ জন ভারতীয় মৎসজীবি গ্রেপ্তার
গত তিন বছরে অন্য দেশের জলসীমায় প্রবেশের কারনে অন্তত ২,৬১২ ভারতীয় মৎসজীবিকে গ্রেফতার করেছে বিভিন্ন দেশ। ভারতের জেলেও ৭৪ জন পাকিস্তানি মৎসজীবি রয়েছে। বিভিন্ন দেশের জেলেই অন্য দেশের অনেকে মৎসজীবি বন্দি রয়েছে। এই সমস্ত মানুষ গুলো ভুল করে নিজের দেশের জলসীমা অতিক্রম করে অন্য দেশের জলসীমায় প্রবেশ করার কারনে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। মৎসজীবিদের পক্ষে দুটি দেশের মধ্যে সমুদ্রসীমা নির্ধারন করা খুবই জটিল। ভারত থেকে সমুদ্রপথে সরাসরি থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ওমান, অস্ট্রেলিয়া সহ অনেক দেশে যাওয়া সম্ভব হলেও সব দেশের সাথে ভারতের সমুদ্র সীমানা নেই। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী দুটি দেশের সমুদ্র সীমা নির্ধারন করা হয়।
নির্দিষ্ট সামুদ্রিক রেখা দুটি দেশের সামুদ্রিক অঞ্চলকে আলাদা করে। কোনও দেশের নির্দিষ্ট সামুদ্রিক সীমানা করার জন্য ১০ ডিসেম্বর, ১৯৮২ সালে জাতিসংঘে ১৫০ টির অধিক দেশ ইউএনক্লস বা ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দি ল অফ দি সী-তে সই করে। ১৯৮২ সালে সই হওয়ার পর ১৬ নভেম্বর, ১৯৯৪ সালে এই চুক্তি আন্তর্জাতিক ভাবে সামুদ্রিক আইনে পরিনত হয়। জুন, ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী ইউএনক্লসের অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ১৬৭ টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এই চুক্তি অনুযায়ী কোন দেশের সমুদ্রসীমাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে প্রাদেশিক সীমা, সংলগ্ন এলাকা এবং এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন বা ইইজেড। কোনও দেশের উপকূল ভাগ থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল বা ২২ কিলোমিটার পর্যন্ত জলভাগকে দেশটির প্রাদেশিক সমুদ্রসীমা বলা হয়। এই এলাকায় সেই দেশটির পূর্ন অধিকার থাকে, অন্য কোনও দেশের জাহাজ এই অঞ্চলে নির্দিষ্ট দেশটির অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে পারবেনা। এই এলাকায় সেই দেশটির সমস্ত আইন কাজ করে কারন এই ১২ নটিক্যাল মাইল এলাকাকে সেই দেশটির স্থলভাগেরই অংশ ধরা হয়। যেমন ভারতের উপকূল ভাগ থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকায় ভারতের সংবিধান ও আইন ব্যবস্থা কাজ করে। উপকূল ভাগ থেকে ১২ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকা অর্থাৎ কোন দেশের উপকূল ভাগ থেকে ২৪ নটিক্যাল মাইল বা ৪৪ কিলোমিটার পর্যন্ত অঞ্চলকে কন্টিগিউয়াস জোন বা সংলগ্ন এলাকা বলা হয়। এই অঞ্চলে দেশটির শুধুমাত্র বিশেষ কিছু আইন কাজ করে। কোন দেশের সংলগ্ন এলাকায় দেশটির অভিবাসন আইন, কর নীতি, পরিবেশ নীতি, কাস্টমস নীতি কাজ করে। সংলগ্ন এলাকা থেকে ১৭৬ নটিক্যাল মাইল বা উপকূল ভাগ থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল বা ৩৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকাকে নির্দিষ্ট দেশটির এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন বলা হয়। নির্দিষ্ট দেশটির ইইজেডে পেট্রোলিয়াম, মাছ, প্রাকৃতিক গ্যাস সহ সমস্ত অর্থনৈতিক উৎসের উপর সেই দেশটিরই অধিকার থাকে। কিন্ত এই অঞ্চলে কোনও দেশের স্থানীয় আইন কাজ করেনা, এখানে আন্তর্জাতিক আইন কাজ করে। কোনও দেশের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন দিয়ে অন্য কোনও দেশের জাহাজ যেতে পারে। যেমন মুম্বাই হাই পেট্রোলিয়াম ফিল্ডস ভারতের উপকূল ভাগ থেকে ৯৫ নটিক্যাল মাইল বা ১৭৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই এলাকা ভারতের ইইজেডের অধীনে যার কারনে এই অঞ্চলে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস ভারত আরোহন করে। এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের আগে সমুদ্রপথকে আন্তর্জাতিক সমুদ্র বা গভীর সমুদ্র বলা হয়। ইউএনক্লস অনুযায়ী আন্তর্জাতিক সমুদ্রে সমস্ত দেশ স্বাধীন ভাবে যাতায়াত করতে পারে এবং গবেষনা করতে পারে, মাছ ধরতে পারে। চীন ইউএনক্লসের বিরুদ্ধে গিয়ে দক্ষিন চীন সাগরে কৃত্রিম দ্বীপ তৈরির মাধ্যমে সেখানে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করছে এবং নিজের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের দৈর্ঘ্য বাড়াচ্ছে। যদি দুটি দেশের মধ্যে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনের মধ্যে একে অন্যের সাথে জড়িয়ে যায় তাহলে সেই দুটি দেশের মধ্যে সামুদ্রিক সীমা নির্ধারন হয়। যেমন ভারতের সাথে ওমান, অস্ট্রেলিয়ার কোন সামুদ্রিক সীমানা নেই কিন্ত শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের সামুদ্রিক সীমানা রয়েছে ভারতের। ভারত এমন একটি দেশ যার তিন দিকেই সমুদ্র রয়েছে। ভারতের পূর্বে বঙ্গোপসাগর, দক্ষিনে ভারত মহাসাগর এবং পশ্চিমে আরব সাগর রয়েছে। ভারতের পাকিস্তান, মালদ্বীপ, বাংলাদেশ, মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের সাথে ৩,৭১০ কিলোমিটার সমুদ্রসীমা রয়েছে।
পাকিস্তানের সাথে ভারতের ৩,৩২৩ কিলোমিটার লম্বা স্থল সীমার পাশাপাশি সমুদ্রসীমাও রয়েছে। পাকিস্তানের সিন্ধ ও ভারতের গুজরাট প্রদেশের সীমানায় রয়েছে স্যার ক্রীক নদী জলাশয় বন গঙ্গাও বলা হয়। আন্তর্জাতিক থালওয়েগ নীতি অনুযায়ী এই স্যার ক্রীকের মধ্যে দিয়ে যাওয়া রেখা ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা নির্নয় করেছে। কিন্ত পাকিস্তান এটা মানতে চায়না, পাকিস্তানের দাবী ১৯১৪ সালের সিন্ধ সরকারি আইন, যা সিন্ধ সরকার এবং কচ্ছের রাজা রাও মহারাজের মধ্যে চুক্তি হয়েছিল, অনুযায়ী স্যার ক্রীক সিন্ধের অংশ। কিন্ত এই চুক্তিরই ১০ নং প্যারা অনুযায়ী ভবিষ্যতে স্যার ক্রীকের মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে আন্তর্জাতিক সীমানা হতে পারে। জনমানবশূন্য স্যার ক্রীক জলাশয় নিয়ে পাকিস্তানের এত বিতর্ক তৈরির প্রধান কারন হচ্ছে স্যার ক্রীক গিয়ে মিশেছে আরব সাগরে। পুরো স্যার ক্রীক পাকিস্তানের হয়ে গেলে আরব সাগরে পাকিস্তানের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন আরও বেড়ে যাবে, যেখানে অত্যাধিক পরিমান তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস থাকার সম্ভবনা রয়েছে। এই স্যার ক্রীকের নিরাপত্তায় বিএসএফ রয়েছে। পাকিস্তানের থেকেও বেশী মালদ্বীপের সাথে সমুদ্রসীমানা রয়েছে ভারতের। মালদ্বীপ ও ভারতের মধ্যে ৪৬০ কিলোমিটারের সমুদ্রসীমানা রয়েছে। প্রায় ১১০০ দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ ভারতের দক্ষিন পশ্চিম উপকূল ভাগ থেকে চারশো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মালদ্বীপ ভারতের বন্ধু দেশগুলোর মধ্যে একটি। তবে মালদ্বীপের বেশ কিছু রাজনৈতিক নেতা ভারতের মিনিকয় দ্বীপকে তাদের বলে দাবী করে কারন তাদের দাবী মালদ্বীপ ও মিনিকয়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক সামঞ্জস্য আছে। আট ডিগ্রি ও নয় ডিগ্রি চ্যানেলের মাঝে অবস্থিত মিনিকয় ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাক্ষাদ্বীপের অংশ।
১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ ভারতের অংশ হওয়ার আগে মিনিকয় কন্নরের আলি রাজাদের নিয়ন্ত্রনে ছিল। তবে সম্প্রতি মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে চীন ঘনিষ্ঠ নেতা জয়লাভ করায় ভবিষ্যতে ভারতের সাথে মালদ্বীপে কুটনৈতিক সম্পর্কে সমস্যা আসতে পারে। ভারতের দক্ষিনে শ্রীলঙ্কার সাথেও ভারতের সমুদ্রসীমা রয়েছে। ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত দূরত্ব ৫৪.৮ কিলোমিটার। ভারত ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে কচ্ছথেবু দ্বীপ নিয়ে বিতর্ক আছে।
ঐতিহাসিক ভাবে এই দ্বীপ তামিলনাড়ুর রামনাড রাজবংশের অধীনে ছিল। পরে ব্রিটিশরা এই দ্বীপ তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়। ১৯৭৪ -৭৬ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সময় শ্রীলঙ্কার সাথে সামুদ্রিক চুক্তি অনুযায়ী এই দ্বীপ শ্রীলঙ্কাকে দিয়ে দেওয়া হয়। এখানে শ্রীলঙ্কান নৌবাহিনী ভারতীয় জেলেদের উপর অনেকবার গুলি চালিয়েছে। ২০২০- ২০২২ এর সময় শ্রীলঙ্কা প্রায় পাঁচশো ভারতীয় জেলেকে গ্রেফতার করেছে এখান থেকে। পূর্ব দিকে ভারতের আরও একটি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের সাথেও ভারতের সামুদ্রিক সীমানা রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে নিউ মোরে দ্বীপ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কিছুটা বিতর্ক রয়েছে, এই দ্বীপকে দক্ষিন তালপাট্টি দ্বীপও বলা হয়।
১৯৭০ সালে ভোলা ঝড়ের পর গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র মোহনায় এই দ্বীপের জন্ম হয়। এই দ্বীপ ভারত তাদের দাবী করে যার কারনে এই দ্বীপের চারপাশে কুড়ি হাজার বর্গ কিলোমিটার এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনও ভারতের হয়ে যায়। ১৯৮১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী এখানে পতাকা উত্তোলন করে কিন্ত বাংলাদেশ এর বিরোধীতা করে। কিন্ত ২০১০ সাল আসতে আসতে সমুদ্রে জলস্তর বৃদ্ধি এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারনে নিউ মোরে দ্বীপ সমুদ্রে আবারও ডুবে যায়। ভারতের আরেক প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারের সাথে কোকো চ্যানেল, আন্দামান সাগর হয়ে ভারতের ৭৪০ কিলোমিটার সমু্দ্র সীমানা রয়েছে। কোকো দ্বীপ নিয়ে দুই দেশের সামুদ্রিক বিতর্ক রয়েছে কিছুটা। কোকো দ্বীপ আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ৬০ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। একটা সময় এই দ্বীপ ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জেরই অংশ ছিল কিন্ত ব্রিটিশরা মায়ানমারকে এই দ্বীপ লিজে দিয়ে দেয়। এই দ্বীপে চীন এয়ারস্ট্রিপ ও রেডার ইনস্টল করেছে যেখান দিয়ে আন্দামানের উপর নজর রাখে চীন। ভারত ও থাইল্যান্ডের সমুদ্র সীমা ভারতের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ এবং থাইল্যান্ডের সিমলান দ্বীপপুঞ্জের মাঝে রয়েছে।
১৯৭৮ সালের ভারত থাইল্যান্ড চুক্তির সময় এই সীমানা নির্ধারন করা হয়েছে। গত ৭৫ বছর ধরে ভারত ও থাইল্যান্ডের সমুদ্র সীমানায় কোনরকম বিতর্ক হয়নি। আন্দামান সাগর ও ভারত মহাসাগরে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে ৯০০ কিলোমিটার সামুদ্রিক সীমানা রয়েছে। ১৯৭৪ সালে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার দ্বিপাক্ষিক চুক্তির সময় এই সীমানা নির্ধারন করা হয়। এই অঞ্চলের কিছু দূরেই রয়েছে মালাক্কা প্রনালী যা আন্তর্জাতিক সমুদ্র বানিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন পথ এবং ভূরাজনীতির অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু।
ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের এই মালাক্কা প্রনালী দিয়ে চীন তার ৮০ শতাংশ কাঁচামাল ও তেল আমদানি করে। যার কারনে ইন্দোনেশিয়ার সাথে ভারতের ভালো সম্পর্ক রয়েছে কারন মালাক্কা প্রনালীতে চীনকে চাপে রাখতে ভারতের ইন্দোনেশিয়াকে দরকার।