আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স যুক্ত মেশিনগান। ইরানের পরমানু প্রজেক্টের জনককেই হত্যা
২০০৪ সাল থেকেই ইসরায়েল সরকার ইরানের পরমানু প্রজেক্ট বন্ধ করবার নির্দেশ দেয় মোসাদকে। মোসাদ তারপর থেকেই বারবার সাইবার অ্যাটাক করতে থাকে ইরানের পরমানু কেন্দ্রগুলোতে। ২০০৭ সালের পর মোসাদ ইরানের পাঁচজন পরমানু বিজ্ঞানীকে হত্যা করে, এদের বেশীরভাগই মিঃ ফাকরিজাদের সাথে সরাসরি কাজ করছিলো। মোসাদ এসময় ইরানের মিসাইল প্রজেক্টের প্রধান জেনারেল সহ তার দলের ১৬ জন সদস্যকেও হত্যা করে। কিন্ত মোসাদ জানতো ইরানের পরমানু কর্মসূচির প্রধান হচ্ছে ডঃ মোসেন ফাকরিজাদে, তাই তাকে হত্যা করার জন্য ২০০৯ সালে তেহরানে মোসাদের কিছু এজেন্ট নির্দিষ্ট স্থানে অপেক্ষা করছিল, কিন্ত শেষ পর্যন্ত এই মিশন বাতিল করা হয় কারন মোসাদ সন্দেহ করে ইরান জনাতে পেরে গেছে তাদের মিশন সম্পর্কে।
২০১৭ সাল থেকে মোসাদ একবছর ধরে তেহরানে একটি গোপন অপারেশন করে তখনই মোসাদ জানতে পারে ইরান পরমানু বোম্ব তৈরির চেষ্টা শুরু করেছে আবারও এবং এই প্রজেক্টের প্রধান ডঃ মোসেন ফাকরিজাদে, তখনই ফাকরিজাদেকে হত্যার পরিকল্পনা শুরু হয়। তবে এবার মোসাদ এমন একটি পরিকল্পনা তৈরি করে যা কখনও কেউ চিন্তাও করেনি। এই মিশনের জন্য মোসাদ ২০ জনের বেশী সদস্যের একটি দল গঠন করে যাতে ইরানেরও বেশ কিছু লোক ছিল।
২০২০ সালে বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের প্রকোপে রয়েছে তখন মোসাদ ফাকরিজাদেকে হত্যা করবার পরিকল্পনা করছিল। ২০২০ সালের মার্চ মাসে পরবর্তী আট মাসের জন্য ফাকরিজাদের উপর নজর রাখবার নির্দেশ দেয় মোসাদ তার দলকে। আট মাস ধরে নজরদারির পর মোসেন ফাকরিজাদেকে হত্যার জন্য তেহরান থেকে অ্যাবসার্ড যাওয়ার হাইওয়েকে বেছে নেওয়া হয়। ২৭ নভেম্বর দুপুর একটার দিকে ডঃ মোসেন ফাকরিজাদে ও তার স্ত্রী তেহরান থেকে অ্যাবসার্ডে তাদের ছুটি কাটাতে রওনা দেয়। ডঃ ফাকরিজাদে তার নিসান তিয়ানা সেডান গাড়িটি চালাচ্ছিলো। ইরানের ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক ফাকরিজাদেকে সতর্ক করেছিল সম্ভাব্য আক্রমনের ব্যাপারে এবং অ্যাবসার্ডে না যেতে কিন্ত ফাকরিজাদে কোন পাত্তাই দেয়নি। তবে ইরানের বেশ কিছু সশস্ত্র সেনা আলাদা গাড়ি করে মোসেন ফাকরিজাদের গাড়িকে নিরাপত্তার জন্য সাথেই ছিল। অ্যাবসার্ড শহরকে প্রধান হাইওয়ের সাথে যুক্ত করার রাস্তাতেই মোসাদের ইরানিয়ান এজেন্টরা একটি নীল রঙের নিসান জামিয়াদ ট্রাক রেখে দিয়েছিল। এই ট্রাকে স্যাটেলাইট নিয়ন্ত্রিত বেলজিয়ামের তৈরি একটি এফএন ম্যাগ মেশিনগান রাখা ছিল। ৭.৬২ ক্যালিবারের এই মেশিনগান প্রতি মিনিটে ৬০০ রাউন্ড গুলি ফায়ার করতে সক্ষম ছিল। আমেরিকার সেনাবাহিনী এবং নৌবাহিনীও এই মেশিনগান ব্যাবহার করতো। এই ট্রাকে মেশিনগান সহ একাধিক ক্যামেরা এবং রোবোটিক প্রযুক্তি ছিল। ইসরায়েল থেকে ইরানে এই মেশিনগান, রোবটিক প্রযুক্তি, ক্যামেরা মোসাদ অত্যন্ত গোপনে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে কয়েকমাস ধরে নিয়ে এসেছিল। অপারেশন হয়ে যাওয়ার পর সমস্ত প্রমান লোপাটের জন্য ট্রাকে একটি বোম্বও লাগানো ছিল। তেহরান থেকে প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার দূরে ইসরায়েলে মোসাদ ডঃ মোসেন ফাকরিজাদের প্রতিটি পদক্ষেপের উপর নজর রাখছিল।
বেলা ৩ঃ৩০ নাগাদ মোসেন ফাকরিজাদের গাড়ি প্রধান হাইওয়ে থেকে অ্যাবসার্ডের দিকের রাস্তায় ঘোরে, তখনই ট্রাকে থাকা ক্যামেরা এআই এর মাধ্যমে গাড়িকে চিনে ফেলে। ইসরায়েলে মোসাদের এজেন্টরা ট্রাকে থাকা মেশিনগান নিয়ন্ত্রন করছিলো স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। তবে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে মেশিনগান চালাতে সরাসরি মেশিনগান চলানোর থেকে ১.৬ সেকেন্ড দেরী হচ্ছিল যার কারনে মোসাদ এই মেশিনগানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম ইনস্টল করে যা এই ১.৬ সেকেন্ড দেরীকে ঠিক করে দেয়, শুধু তাই নয় এআই সিস্টেম মোসেন ফাকরিজাদের গাড়ির গতিকে বুঝে নিয়ে সেই অনুযায়ী মেশিনগানের মুভমেন্টকেও নির্দিষ্ট করে। যেই মোসেন ফাকরিজাদের গাড়ি ট্রাকের কাছাকাছি আসে সাথে সাথে মেশিনগান থেকে পরপর ১৩টি গুলি চালানো হয় যার পাঁচটি ফাকরিজাদেকে লাগে। এই মিশন এতটাই নিখুঁত ছিল যে ফাকরিজাদের থেকে মাত্র দশ ইঞ্চি দূরে পাশের সিটে বসে থাকা তার স্ত্রীকে একটিও গুলি লাগেনি। পেছনের গাড়িতে থাকা ইরানের সশস্ত্র সেনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফাকরিজাদের মৃত্যু হয় এবং সাথে সাথে ট্রাকটিও বিষ্ফোরনে ধ্বংস হয়ে যায়। মোসাদের সমস্ত এজেন্ট আগেই ইরান থেকে চলে গিয়েছিল।
মোসেন ফাকরিজাদের মৃত্যুর সাথে সাথে ইরানের পরমানু প্রজেক্টের স্বপ্নও বহু বছরের জন্য থমকে যায়। ইরান এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসরায়েল ও মোসাদকে দোষী সাব্যস্ত করে কিন্ত ইসরায়েল কোনওদিন এই ঘটনার দায় স্বীকার করেনি। মোসেন ফাকরিজাদের হত্যা প্রমান করে ইসরায়েলের প্রযুক্তিগত দক্ষতাকে।