ইরানের পরমানু প্রজেক্টের জনককে যেভাবে হত্যা করেছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দারা-প্রথম খণ্ড
৩০ এপ্রিল, ২০১৮, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহু একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষনা করেন ইরান গোপনে পরমানু বোম্ব তৈরি করছে। বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহু ইরানের গোপন পরমানু প্রজেক্ট সম্পর্কে সমস্ত তথ্য বিদেশী সাংবাদিকদের সামনে প্রকাশ করেন। তিনি আরও জানান ইরানের এই গোপন পরমানু প্রজেক্টের নেতা ডঃ মোসেন ফাকরিজাদে। ইরানের পরমানু প্রজেক্টের জনক বলা হয় এই ডঃ মোসেন ফাকরিজাদেকে, ২০০৭ সাল থেকেই ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের হিট লিস্টে ছিল তার নাম। বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহুর এই বক্তৃতার তিন মাস আগে ৩১ জানুয়ারির রাতে মোসাদের এজেন্টরা ইরানের রাজধানী তেহরানে অবস্থিত ইরানের গোপন তথ্যকেন্দ্র থেকে ইরানের পরমানু পোগ্রামের সমস্ত তথ্য নিয়ে আসে, ইরানের গোয়েন্দা সংস্থা টেরও পায়নি। বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহুর বক্তৃতার দুই বছরের মধ্যে মোসাদ ডঃ মোসেন ফাকরিজাদেকে হত্যার এক বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করে মোসাদ। মোসাদ ডঃ মোসেন ফাকরিজাদেকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই এর মাধ্যমে হত্যার পরিকল্পনা তৈরি করে। মোসাদের এমন অসাধারন অপারেশনে ইরান সহ ইসরায়েলের সব শত্রুরা পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে যায়।
১৯৫৮ সালে ইরানে কোয়াম শহরে জন্ম হয় মোসেন ফাকরিজাদের। ১৯৮৭ সালে শাহিদ বেহেসতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে ডিগ্রি লাভ করার পর ইস্ফাহান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিউক্লিয়ার রেডিয়েশন ও কসমিক রে এর উপর পিএইচডি করে মোসেন ফাকরিজাদে। এরপর ১৯৯১ সালে ইমাম হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করে ফাকরিজাদে। ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলেশনারী গার্ড কর্পস বা আইআরজিসিরও সদস্য ছিল ফাকরিজাদে। কিন্ত ২০০৭ সালে আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ জানায় ডঃ মোসেন ফাকরিজাদের ইমাম হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসাবে কাজ করা একটা ছদ্মবেশ আসলে সে ইরানের পরমানু প্রজেক্টের প্রধান ছিল।
আমেরিকা ও ইসরায়েলের তথ্য অনুযায়ী ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০৩ অবধি চলা ইরানের গোপন পরমানু প্রজেক্ট আমাদের প্রধানও ছিল এই মোসেন ফাকরিজাদে। এই কারনে ফাকরিজাদেকে ইরানের পরমানু কার্যক্রমের জনক হিসাবে মানতো ইসরায়েল ও পশ্চিমা দেশ গুলো।
২০০৮ সালে জাতিসংঘে ইরানের পরমানু কার্যক্রমে জড়িত থাকার কারনে মোসেন ফাকরিজাদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। আমেরিকা ও ইসরায়েল ইরানের পরমানু কার্যক্রম যেকোনও উপায়ে বন্ধ করবার চেষ্টা করে এখনও। কারন আমেরিকা ও ইসরায়েল বিশ্বাস করে ইরান সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সাহায্য করে। সিআইএ এবং মোসাদের তথ্য অনুযায়ী ইরান ইয়ামেনের হুথী বিদ্রোহীদের, প্যালেস্টাইনে হামাস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহ নামক সংগঠনক গুলোকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করে। এই সংগঠন গুলোকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে মানে আমেরিকা, ইসরায়েল ও পশ্চিমা বিশ্ব। যদি ইরান পরমানু বোম্ব তৈরি করে ফেলে তাহলে সেই প্রযুক্তি এসব সন্ত্রাসী সংগঠনের কাছে চলে যাবে। আমেরিকার অর্থনীতিতে এখনও তেলের ব্যাপক প্রভাব আছে। বিশ্বের বেশীরভাগ তেল রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। এখানে পারস্য উপসাগর, হরমুজ প্রনালী ও ওমান উপসাগর হয়ে বিশ্বের ৩০ শতাংশ তেল রপ্তানি হয়, পরমানু শক্তি অর্জন করতে পারলে ইরান হরমুজ প্রনালী বন্ধ করে দিতে পারে যা আমেরিকার জন্য বিরাট ক্ষতি। ইসরায়েলের দাবি ইরান হামাস ও হিজবুল্লাহকে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমনে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করে, সিরিয়াতেও ইরানের প্রভাব রয়েছে, সৌদি আরবও অভিযোগ করেছে ইয়ামেনে হুথী বিদ্রোহীদের তাদের বিরুদ্ধে সহায়তা করে ইরান। যার কারনে ইরান পরমানু ক্ষমতা অর্জন করলে গোটা মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। তাছাড়া ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় শত্রুও এই ইরান। ইরানের রাজনীতিবিদরা প্রায়ই ইসরায়েলকে হুমকী দেয়, পরমানু ক্ষমতা অর্জন করলে তারা যে ইসরায়েলের উপর হামলা করবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। অন্যদিকে পরমানু বোম্ব তৈরির মাধ্যমে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব বাড়াতে চায়।
ইসরায়েল ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে দুটি সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সৌদি আরব ও ইরান। কয়েক দশক ধরে এই দুটি দেশের মধ্যে বিবাদ রয়েছে। দুই দেশই চায় হরমুজ প্রনালীতে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে কারন হরমুজ প্রনালী হয়েই মধ্যপ্রাচ্যের ৯০ শতাংশ তেল রপ্তানি হয়। ইরান নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য পরমানু বোম্ব তৈরিকেই বেছে নিয়েছে। যেকোনও পরমানু বোম্ব তৈরির তিনটি ধাপ রয়েছে, প্রথম ধাপে বোম্ব তৈরির জন্য উপযুক্ত ইউরেনিয়াম প্রয়োজন, দ্বিতীয় ধাপে ইউরেনিয়ামকে ওয়ারহেডের মধ্যে রাখা হয় এবং তৃতীয় ধাপে ওয়ারহেডকে নির্দিষ্ট মিসাইলের সাথে ইনস্টল করা হয়।
২০২০ সালে ইরানের নাতনজ পরমানু কেন্দ্রে আগুন লাগিয়ে কেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, এর পেছনেও মোসাদ ছিল। এখানে পরমানু বোম্ব তৈরির প্রথম ধাপ ইউরেনিয়ামের উপর কাজ হত। পরমানু বোম্ব তৈরির তৃতীয় ধাপের দায়িত্ব ছিল ইরানের জেনারেল কাশেম সুলেমানির উপর, ইরাকের বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে তাকেও হত্যা করে সিআইএ। প্রিডেটর ড্রোন থেকে হেলফায়ার মিসাইল ফায়ার করে ২০২০ সালের ৩ জানুয়ারি কশেম সুলেমানিকে হত্যা করা হয়। ডঃ মোসেন ফাকরিজাদে ছিল ইরানের পরমানু প্রজেক্টের দ্বিতীয় ধাপ ওয়ারহেড তৈরির দায়িত্বে, পরমানু বোম্ব তৈরির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ধাপ এটি। তাই মোসেন ফাকরিজাদেকে যেকোনও উপায়ে হত্যা করতেই হত ইসরায়েলেকে।