পৃথিবী

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কখনও হতনা। এক রাজার একটি ভুলে প্রায় দুই হাজার বছর পরেও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছিল

জীবনে চলার পথে সঠিক বন্ধু নির্বাচন করা খুবই আবশ্যক। যদিও সাধারন মানুষের জীবনে একজন ভুল বা সঠিক বন্ধুত্বের প্রভাব অন্য কোনও মানুষের উপর পড়েনা, শুধু সেই মানুষটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্ত কোন দেশের শাসক বা যদি ভুল মানুষের উপর বিশ্বাস করে বা সঠিক বন্ধু নির্বাচন করতে না পারে তাহলে পরবর্তী বহু বছর সেই দেশের বা রাজ্যের প্রজাকে তার ফল ভুগতে হয়, এমনকী পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম অবধি প্রজার দুর্দশা চলতেই থাকে। যদি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলা হয় তাহলে দেখা যাবে ইউরোপ মহাদেশে হওয়া সত্ত্বেও ফ্রান্স ও জার্মানি ভিন্ন পক্ষে ছিল এবং সবসময় এদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। জার্মানি ও ফ্রান্স একে অপরের প্রতিবেশী হওয়া সত্বেও দুটি দেশ এক অপরের প্রতিপক্ষ ছিল। কিন্ত মজার ব্যাপার হল আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে এক রাজার ভুলের কারনে এই দুই দেশের মানুষ একে অপরের বিরুদ্ধে বারবার প্রানঘাতি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। যদি সেইসময় সেই রাজা সঠিক বন্ধু নির্বাচন করতে পারতো তাহলে আজ হয়ত বিশ্বের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হত, বিশ্বের মানচিত্রেও কিছু পরিবর্তন হত, হয়ত প্রানঘাতি, মহাবিনাশক যুদ্ধের সাক্ষী হতনা মানব সভ্যতা। 

সময়টা তখন ৯ এডির, যা আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগের। সেসময় রোমান সাম্রাজ্যের নতুন শাসক হয় অগাস্টাস সিজার। সিংহাসনে বসেই সিজারের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় রোমান সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং অর্থনৈতিক বিকাশ। সাধারনত সমস্ত শাসকেরই এই লক্ষ্যই থেকে থাকে। অগাস্টাস সিজারের নজরে আসে রোমান সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ জার্মানিয়াতে প্রায় সময়ই বিদ্রোহ হয়, এখান থেকে তাদের কোন অর্থ উপার্জন হয়না উপরন্তু এই প্রদেশের জন্য রোমান কোষাগার থেকে অর্থ খরচ হয় কারন বিদ্রোহ থামাতে প্রায়ই এখানে সেনা পাঠাতে হত। যদিও জার্মেনিয়া প্রদেশে বিদ্রোহ কঠোর ভাবেই দমন করা হত। জার্মেনিয়ার নাগরিকদের রোমান সম্রাট ভাড়াটে সেনা হিসাবে ব্যবহার করত প্রথমে, তারপর ধীরে ধীরে রোমান সেনায় ভর্তি করা হতে থাকে জার্মেনিয়ানদের, পরবর্তী সময়ে তাদের রোমান নাগরিকত্বও দেওয়া হয় কিন্তু তবুও এই জার্মেনিয়ান প্রদেশে কিছু সময় অন্তর অন্তর বিদ্রোহ হত। অগাস্টাস সিজার ঠিক করে এই প্রদেশ থেকে যে করেই হোক অর্থ উপার্জন করতে হবে, এই কারনে অগাস্টাস সিজার জার্মেনিয়ান প্রদেশে একজন গভর্নর নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় যে এই প্রদেশ থেকে কর সংগ্রহ করে রোমান সম্রাটকে পাঠাবে। পাবলিয়াস কুইন্টিলাস ভারাস নামে এক ব্যক্তিকে জার্মেনিয়ান প্রদেশের গভর্নর করা হয়। এর আগে পাবলিয়াস ভারাস সিরিয়াতে রোমান সাম্রাজ্যের গভর্নর ছিল, সেখানে শান্তি বজায় রাখতে তার বড় ভূমিকা ছিল, ভারাস সিরিয়া থেকে প্রচুর অর্থ রোমান কোষাগারে পাঠিয়েছিল সেকারনে অগাস্টাস সিজার পাবলিয়াস ভারাসকে ভরসা করতো। তাছাড়া পাবলিয়াস ভারাস অগাস্টাস সিজারের স্ত্রীর পরিবারের লোক ছিল যার কারনে সিজার জার্মেনিয়ার দায়িত্ব তাকেই দেয়। 

পাবলিয়াস ভারাস জার্মেনিয়াতে তিনটি রোমান লিজিয়ন নিয়ে যায়। রোমান সাম্রাজ্যে রোমান নির্দিষ্ট সংখ্যক সেনাকে নিয়ে এক একটি বিভাগ তৈরি করা হত একে লিজিয়ন বলা হত। একটি রোমান লিজিয়নে ৪,২০০ সেনা এবং ৩০০ অশ্বারোহী সেনা থাকতো। সেসময় প্রায় গোটা বিশ্বে রোমান লিজিয়নদের যথেষ্ট সম্মান ছিল কারন যুদ্ধে কোন দেশের সেনাই রোমান লিজিয়নদের পরাস্ত করতে পারতোনা। রোমান লিজিয়নরা যখন সংঘবদ্ধ ভাবে মার্চ করে যুদ্ধ করতে যেত তখন অতি শক্তিশালী শত্রুরও মোনোবল ভেঙে যেত। জার্মেনিয়ানরা যখন দেখল তিনটি শক্তিশালী রোমান লিজিয়ন এসেছে তখন তারা প্রথমদিকে পাবলিয়াস ভারাসকে সহযোগীতা করে। তবে পাবলিয়াস ভারাস জার্মেনিয়ানে বেশ কিছু ভুল নীতি গ্রহন করে, পাবলিয়াস আগে সিরিয়াতে যে পদ্ধতিতে কর নিত এখানেও সেই পদ্ধতিই প্রয়োগ করে কিন্তু সমস্যা হল সিরিয়ার মানুষদের কাছে সোনা, রূপো ছিল তারা কর দিত কিন্ত জার্মেনিয়া প্রদেশ ঘন জঙ্গলে পূর্ন ছিল, সেখানকার মানুষদের কাছে এত অর্থ ছিলনা। কিছু সময় যেতেই জার্মেনিয়ানরা পাবলিয়াসের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। এখানে পাবলিয়াস আরও একটা ভুল করে যে তার সহযোগিতার জন্য আর্মেনিয়াস বলে একজন লোককে নিযুক্ত করে। আর্মেনিয়াস জার্মেনিয়ারই একজন যুবরাজ ছিল সে রোমান সেনাবাহিনীতেও কাজ করেছিলো। আর্মেনিয়াস রোমান সেনাবাহিনীতে কাজ করলেও সে স্বপ্ন দেখতো জার্মেনিয়ার শাসক হওয়ার। আর্মেনিয়াস চাইছিল জার্মান উপজাতিদের একত্র করে রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে তাহলে সে জার্মানদের সামনে নায়ক হয়ে উঠবে। পাবলিয়াস ভারাস কিছু না বুঝেই আর্মেনিয়াসকে তার সহযোগী নিযুক্ত করে ফেলেছিল। আর্মেনিয়াসের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তিনটে রোমান লিজিয়নকে কিভাবে পরাস্ত করা যায়, সে বাধ্য হয়ে সুযোগের অপেক্ষা করতে থাকে। সুযোগ আসে, একদিন পাবলিয়াস তার লিজিয়নদের নির্দেশ দেয় দক্ষিন জার্মানির উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে সেখানে রোমান সেনাবাহিনীর শীতকালীন বেস ছিল। পাবলিয়াস ভারাস আর্মেনিয়াসকে এতটাই বিশ্বাস করতে যে রোমান লিজিয়নের অশ্বারোহী সেনাদের কম্যান্ডো করে দেয় তাকে। সেসময় সেনাবাহিনীর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার সময় প্রথমে অশ্বারোহী সেনারা সেনাবাহিনীর আগে গিয়ে রাস্তা নিরাপদ কীনা পরীক্ষা করতো, তার পেছনে সেনাবাহিনী আসতো। রোমান অশ্বারোহী সেনার বেশীরভাগই ছিল জার্মানির লোক। সেকারনে আর্মেনিয়াসের কাছে এটাই সবচেয়ে বড় সুযোগ ছিল। আর্মেনিয়াস পরিকল্পনা করে সে আগে অশ্বারোহী সেনাদের নিয়ে এগিয়ে যাবে তারপর নির্দিষ্ট জায়গা থেকে পেছনে থাকা লিজিয়নদের উপর আক্রমন করবে। আর্মেনিয়াস জানতো সোজা রাস্তায় গেলে লিজিয়নদের আক্রমন করা যাবেনা সেকারনে সে পাবলিয়াস ভারাসকে বোঝায় সোজা রাস্তায় কিছু দূরে জার্মান বিদ্রোহীরা রয়েছে সেখান দিয়ে গেলে লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর বদলে জঙ্গল দিয়ে গেলে যুদ্ধ হওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। পাবলিয়াস ও রাজি হয়ে যায় আর্মেনিয়াসের প্রস্তাবে। আর্মেনিয়াস রোমান লিজিয়নদের সাথে যুদ্ধের জন্য গোরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি বেছে নেয় কারন আর্মেনিয়াস জানতো রোমান লিজিয়নরা সংঘবদ্ধ ভাবে লড়াই করতো, সামনাসামনি লড়াইয়ে তাদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। জঙ্গলের মধ্যে আগে থেকেই জার্মান উপজাতি যোদ্ধাদের লুকিয়ে রেখেছিল আর্মেনিয়াস। অশ্বারোহী সেনাদের বেশীরভাগকেও নিজের পক্ষে করে নিয়েছিল আর্মেনিয়াস। রোমান সেনারা যেই জঙ্গলে প্রবেশ করে তখন থেকেই তাদের উপর ক্রমান্বয়ে গোরিলা আক্রমন হতে থাকে। জঙ্গলের ভিতর রোমান লিজিয়নদের কোন সংঘবদ্ধতার নীতি কাজ করেনা, কারন ঘন জঙ্গলে রোমান সেনারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। যার কারনে জার্মান বিদ্রোহীরা গোরিলা আক্রমন করে পালিয়ে যেতে শুরু করে। কয়েকদিনের মধ্যেই জঙ্গলের মধ্যেই তিনটি রোমান লিজিয়ন প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। যখন পাবলিয়াস ভারাস এই খবর পায় তখন সে বুঝতে পারে আর্মেনিয়াস তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে কিন্ত ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। পাবলিয়াস ভারাস ও কয়েকজন রোমান উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আত্মহত্যা করে বাধ্য হয়ে। বিজয়ী হয় আর্মেনিয়াস ও তার সেনা এবং জার্মেনিয়াকে রোমান সাম্রাজ্য থেকে মুক্ত করা হয়। অগাস্টাস সিজার এই খবর পাবার পর কয়েকবার রোমান সেনা পাঠায় জার্মেনিয়াতে কিন্ত প্রতিবারই তারা শোচনীয় পরাজিত হয় সেখানে। এরপর সেনা পাঠানো বন্ধ করে দেয় অগাস্টাস সিজার কারন সিজার ভয় খেয়ে গিয়েছিল এবং ভেবেছিল জার্মানরা হয়ত রোম আক্রমন করবে কিন্তু জার্মানরা কখনও রোম আক্রমন করেনি কারন রোমান লিজিয়নদের সাথে সরাসরি যুদ্ধের সামর্থ্য তাদের ছিলনা। যদি পাবলিয়াস ভারাস সেসময় আর্মেনিয়াসকে তার সহযোগী নিযুক্ত না করতো তাহলে আজ জার্মানি, ফ্রান্স, চেকশ্লোভিয়া একটি দেশ হত। যদি এমনটা হত তাহলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কখনও হতনা, এত মানুষের মৃত্যুও হতনা। পাবলিয়াস ভারাস স্বপ্নেও ভাবেনি তার একটি ভুলের কারনে পরবর্তী কয়েক হাজার বছর ধরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.