ভারত

গোয়ায় স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে আসতে কি করেছিলেন জহরলাল নেহেরু?

নিউজ ডেস্কঃ গোয়া সম্পর্কে নরম নীতির জন্য স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বহু বার সমালোচিত হতে হয়েছিলো নেহেরুকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই এই বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেলেও তাদের হাবভাবে স্পষ্ট ছিলো যে তাদের মতে গোয়া আদপে পর্তুগালেরই অংশ; যা নেহেরুকে ভীষণ ভাবেই হতাশ করেছিল। শেষ পর্যন্ত নেহেরু গোয়ার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে ট্রুপ পাঠায় সেখানে। আজ সেই গল্পই শোনাবো আপনাদের।

১৪ই আগস্ট ঘড়িতে যখন মধ্যরাত, বিশ্ব তন্দ্রাচ্ছন্ন, তখনই জীবন ও স্বাধীনতার জন্য জেগে ওঠে ভারত- গোয়া ছাড়া।

১৯৪৭ সালে, ভারত যখন ব্রিটেনের হাত থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে, গোয়া তখন ছিলো অন্য এক ঔপনিবেশিক শক্তির দখলে।  ভারতের পশ্চিম উপকূল বরাবর—গোয়া, দাদরা, নগর হাভেলি, দমন এবং দিউ ছিলো সম্পূর্ণ ভাবে পর্তুগিজদের দখলে। তাই, ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলেও পর্তুগিজ শাসনাধীন বর্তমান ভারতের এই পাঁচটি অঞ্চল তখনও রয়ে ছিলো পরাধীন। ভারতীয় ইউনিয়নের অংশ হয়ে উঠতে তাদের এখনো এক বড় পথ চলা বাকি ছিল।

পর্তুগালের কাছে গোয়া ছিলো অনেকটা ‘প্রাচ্যের রোম’ শাসনের মতোই। গোয়ার চিরন্তন শাসন এতো সহজে ছেড়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিলো না তাদের। তবে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের কাছে গোয়ায় পর্তুগালের শাসন এক অস্থায়ী উপদ্রপ ছাড়া এটা আর কিছুই ছিলো না। গোয়ার স্থানীয় নাগরিক বা সদ্য গঠিত ভারত সরকার কেউই আর গোয়াতে পর্তুগিজ শাসন চাইছিলো না। স্বাধীনতার আগেই ১৯৪৬ সালের জুন মাসে ডঃ রাম মনোহর লোহিয়া গোয়াতে পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে ডাকা এক সম্মেলনে “গোয়া ছাড়ো” প্রস্তাব পাস পেশ করে নেতৃত্ব দেন সেই আন্দোলনে। ১৯৪৯ সালের জুন মাসে গোয়ান পিপলস পার্টি এবং গোয়ান জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি উভয়েই বিদেশী শাসনের অবসান এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করে। ওই একই মাসে, ভারত পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে একটি কূটনৈতিক অফিস স্থাপন করে ভারতের উপনিবেশগুলি থেকে পর্তুগালের শাসন প্রত্যাহার নিয়ে আলোচনা শুরু করে।

কিন্তু,পর্তুগাল সরকার সরাসরি বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে অস্বীকার করে দেয়। পর্তুগালের তৎকালীন স্বৈরচারী শাসক আন্তোনিও ডি অলিভেরা স্পষ্ট জানায় গোয়া, দমন, দিউ তাদের কাছে নিছক কোনো ‘উপনিবেশ’ নয়, বরং তাদের দেশের নিজস্ব অংশ। গোয়ার অধিবাসীদের পর্তুগালের নাগরিক হিসাবে গণ্য করা হতো এমনকি পর্তুগিজ আইনসভা বা মন্ত্রিসভাতেও তারা প্রতিনিধিত্ব করতে পারত। ১৬ শতকের গোড়ার দিকে পর্তুগাল যখন এই অঞ্চলগুলো ওপর আধিপত্য বিস্তার করে তখন ভারতে কোন প্রজাতন্ত্র ছিল না বরং একটি রাষ্ট্রের বদলে এখানে ছিল কতগুলি আলাদা আলাদা রাজ্য। পর্তুগাল ১৯৫১ সালের জুন মাসে ভারত সহ অন্যান্য প্রদেশে তাদের বিদেশি উপনিবেশগুলির অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সংবিধানেও বেশ কিছু সংশোধন আনে। কিন্তু একবারের জন্যেও ভারতের হাতে ভূখণ্ডগুলি হস্তান্তরের কোনো প্রশ্নই ওঠেনি পর্তুগালে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ভারত ক্ষুব্ধ হয়। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান না হওয়ায় ১৮৫৩ সালের জুন মাসে ভারত লিসবন থেকে নিজেদের যাবতীয় কূটনৈতিক মিশন প্রত্যাহার করে নেয় এবং পর্তুগিজ উপনিবেশ এবং ভারতের মধ্যে ভিসায় নানা বিধি নিষেধ চালু করে।

১৯৫৪ সালের ২১ জুলাই, ভারতীয় এক্টিভিস্টদের একটি ছোট দল পর্তুগিজ শাসনাধীন দাদরায় প্রবেশ করে এবং সেখানকার শাসনভার গ্রহণ করে। কোনো রকম হিংসা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ ভাবে ২ আগস্ট আরও বেশ কিছু এক্টিভিস্ট নগর হাভেলিতে প্রবেশ করে। এই ঘটনাগুলোর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই ১৯৫৪ সালের ১৫ আগস্ট এক হাজারেরও বেশি সত্যাগ্রহী গোয়া ও দমনকে পর্তুগালের শাসন থেকে মুক্ত করতে সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করলে সীমান্তে থেকেই ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাদের। এর মাত্র এক বছর পরেই, ১৯৫৫ সালের ১৫ আগস্ট পুনরায় তিন হাজার সত্যাগ্রহী এই একই রকম প্রচেষ্টায় গোয়া, দমন এবং দিউতে প্রবেশ করলে, পর্তুগিজ পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে বেশকিছু সত্যাগ্রহী নিহত হন। আহতের সংখ্যাও নেহাত কম ছিলো না।

পর্তুগিজ সৈন্যকে নিন্দা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু অবিলম্বে পর্তুগালের সাথে যাবতীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ভারত গোয়াতে তার কনস্যুলেট বন্ধ করে দেয়। সেই সঙ্গে মানি অর্ডার সুবিধা কমিয়ে দিয়ে গোয়া, দমন ও দিউ-এ একপ্রকার ভাবে ভ্রমণ ও অর্থনৈতিক অবরোধ চালু করে ভারত।

বিষয়টি ক্রমে আন্তর্জাতিক রূপ নেয়।  সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন সেই সময় ভারতের অবস্থানকে সমর্থন জানিয়েছিল। অপরদিকে পর্তুগাল, নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন এর সদস্য দেশ হওয়ায় ব্রিটেন সহ অন্য সদস্য দেশগুলি সরাসরি পর্তুগালকে সমর্থন করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ থেকেও পরোক্ষভাবে একপ্রকারে স্বীকার করেই নেয় যে গোয়া আদপে পর্তুগালেরই অন্তর্ভুক্ত। যা নেহেরুকে খুবই হতাশ করে। কিন্তু, বাধাপ্রাপ্ত হয়েও ভারত শেষ পর্যন্ত পর্তুগিজ উপনিবেশ সম্পর্কে তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন আনেনি। 

ভারত বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের জন্য শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছিলো। ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, পুনরায় গোয়া এবং ভারতের মধ্যে ভ্রমণ প্রক্রিয়া চালু করা হয় এমনকি ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে, গোয়া, দমন এবং দিউ-এর সাথে বাণিজ্যর ওপরেও নিষেধাজ্ঞা সরিয়ে নেওয়া হয়। তবু, পর্তুগিজ সরকারের তরফ থেকে মেলেনি কোনো সাড়া। 

১৯৬১ সালের দ্বিতীয়ার্ধে, আফ্রিকার সদ্য-স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলি গোয়া সমস্যার সমাধানের জন্য ভারতের উপর আরও বেশি করে চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে। ১৯৬১ সালের অক্টোবরে দিল্লিতে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর আফ্রিকা আয়োজিত একটি সেমিনারে, একাধিক আফ্রিকান দেশের নেতারা আফ্রিকার চলমান স্বাধীনতা আন্দোলনের সাফল্যের জন্য গোয়ার অবিলম্ব মুক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করেন। দীর্ঘদিন গোয়ার ব্যাপারে নরম নীতি মেনে চলার পরেও পর্তুগালের তরফ থেকে কোনো প্রতিদান না মেলায় নেহেরু এই সময় জানান ‘আমরা এবার আমাদের সেনাবাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্তও নিতে পারি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং ভারতের জাতিসংঘের প্রতিনিধি দলের প্রধান ভি. কে. কৃষ্ণ মেনন, ঘোষণা করেন যে ভারত গোয়াতে শক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা এখনো ত্যাগ করেনি। দীর্ঘ ১৪ বছর অহিংসার মাধ্যমে পর্তুগালকে বোঝানোর চেষ্টা ব্যর্থ হলে সশস্ত্র সংঘাত হয়ে উঠছিল ভারতের কাছে গোয়া পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপায়।  

১৯৬১ সালের নভেম্বরের মধ্যে, পর্তুগিজরা তাদের হারানো জমি ফেরত পেতে জোরদার চেষ্টা শুরু করে। দুটি আর্টিলারি ইউনিট স্থাপন করা হয় গোয়াতে। দিনের ২৪ ঘন্টা চারটি ফ্রিগেট (ছোট, দ্রুত সামরিক জাহাজ) গোয়ার উপকূলে টহল দিতে আরম্ভ করে। এখানেই শেষ নয়। এক হাজারেরও বেশি পুলিশ অফিসার এবং সীমান্ত রক্ষার পাশাপাশি মোট পাঁচটি বাণিজ্যিক জাহাজ এবং দুটি পরিবহন বিমানের ব্যবস্থা করে পর্তুগিজ সরকার। ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রবেশ রোধ করতে গোয়া যাওয়ার রাস্তাগুলিতে খনন করা হয়।

এখনো অব্দি পরিস্থিতি ছিলো কিছুটা আয়ত্বের মধ্যে। তবে, পর্তুগিজরা গোয়ার দক্ষিণে অবস্থিত অঞ্জদীপ থেকে আগত একটি ভারতীয় স্টিমার জাহাজে বিনা প্ররোচনায় গুলি চালালে পরিস্থিতি হঠাৎই উত্তেজনাময় হয়ে ওঠে। ঘটনায় বেশ কিছু ভারতীয় জেলে আহত ও নিহত হলে ভারত অবিলম্বে গোয়ার দক্ষিণ দিকে কারওয়ার উপকূলে টহল দেওয়ার জন্য একটি ডেস্ট্রয়ার এবং ফ্রিগেট মোতায়েন করে।

১ ডিসেম্বর, ভারত গোয়া পুনরুদ্ধার এবং সেখানে নজরদারি চালানোর জন্য অনুশীলন শুরু করে। দুটি ভারতীয় ফ্রিগেট গোয়ার উপকূলে টহল দিতে শুরু করে এবং ভারতীয় নৌবাহিনী ষোলটি জাহাজকে চারটি টাস্ক গ্রুপে বিভক্ত করে।  ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্স (IAF) সেই সময় রিকনেসান্স ফ্লাইট শুরু করে যাতে প্রলুব্ধ হয়ে পর্তুগিজ ফাইটার জেট তাদের অবস্থান প্রকাশ করে ফেলে। ভারতীয় সেনাবাহিনী গোয়া, দমন ও দিউ সীমান্তের চারপাশে সেনা মোতায়েন করে। সেনাবাহিনী গোয়াকে মুক্ত করার জন্য অপারেশন বিজয়ের নেতৃত্ব দেয় যাতে নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর তরফ থেকেও পাওয়া যায় যোগ্য সমর্থন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.