ভারত

কার্বন মুক্ত ভারত গঠন করছে ভারত সরকার

বিশ্ব উষ্ণয়নের হাত থেকে রক্ষা পেতে বিশ্বের সমস্ত দেশই কার্বনের ব্যবহার কম করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যার কারনে অপ্রচলিত বিকল্প শক্তি উৎপাদনে জোর দিয়েছে প্রায় সমস্ত দেশই। খনিজ তেল, কয়লার বিকল্প হিসাবে হাইড্রোজেনকে একটি গুরুত্বপূর্ন পরিচ্ছন্ন শক্তি উৎস হিসবে দাবি করেছে বিজ্ঞানীরা, কারন হাইড্রোজেন দহনে শুধুমাত্র জল উৎপন্ন হয় কোনও ক্ষতিকর কার্বন যুক্ত গ্যাস উৎপন্ন হয়না। আমেরিকা, দক্ষিন কোরিয়া, জাপান, জার্মানি ও চীনে ইতিমধ্যেই হাইড্রোজেন জ্বালানি যুক্ত বাস চলছে। জার্মানি, চীন হাইড্রোজেন জ্বালানি যুক্ত ট্রেন তৈরি করছে। ফ্রান্সের সরকার জানিয়েছে তারা হাইড্রোজেন শিল্পাঞ্চল ও পরিবহনে ব্যবহার করবে, এর জন্য সাত বিলিয়ন ইউরোর একটি পরিকল্পনাও তৈরি করেছে ফ্রান্স। বিশ্বের অন্যতম বড় বিমান নির্মান সংস্থা এয়ারবাস জানিয়েছে ২০৩৫ এর মধ্যে তারাও হাইড্রোজেন জ্বালানি যুক্ত পরিবহন বিমান তৈরি করবে। জাপানও ২০১৯ সালেই ঘোষনা করেছিল ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকে হাইড্রোজেন জ্বালানি যুক্ত বাস চালাবে। হাইড্রোজেন জ্বালানির পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বে হাইড্রোজেনকে কেন্দ্র করে হাইড্রোজেন অর্থনীতি নিয়েও আলোচনা চলছে। হাইড্রোজেন অর্থনীতি অর্থাৎ কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশ বা অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর অনেকাংশ নির্ভর করবে হাইড্রোজেন জ্বালানির উপর তা সে হাইড্রোজেন জ্বালানি যুক্ত পরিবহন ব্যবস্থা হোক কিংবা শিল্পাঞ্চলে হাইড্রোজেনের ব্যবহার হোক। 

সুতরাং বিশ্বজুড়ে হাইড্রোজেন একটি পরীক্ষিত পরিচ্ছন্ন শক্তি উৎস যার চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভবিষ্যতে বিশ্বউষ্ণয়ন বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবার জন্য হাইড্রোজেন ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ন।

হাইড্রোজেনকে বিকল্প জ্বালানি হিসাবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারতও পিছিয়ে নেই। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের প্রথম শহর হিসাবে দিল্লিতে হাইড্রোজেন জ্বালানি যুক্ত বাস পরিষেবা শুরু হয়। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন সংস্থা যেমন ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন, এনটিপিসি যৌথভাবে ভারতে আরও হাইড্রোজেন জ্বালানি বিশিষ্ট বাস পরিষেবার জন্য কাজ করছে। এছাড়া ভারত সরকার প্রাথমিক ভাবে ১৯,৭৪৪ কোটি টাকার জাতীয় গ্রীন হাইড্রোজেন মিশনের অনুমোদন দিয়েছে। এই মিশনের লক্ষ্য ভারতে ব্যাপক পরিমানে হাইড্রোজেন জ্বালানি উৎপন্ন করে তা বিদেশে রপ্তানি করা। যেদেশের কাছে জরুরী কাঁচামাল ও জ্বালানি প্রচুর পরিমানে রয়েছে আন্তজার্তিক রাজনীতিতে সেই দেশের প্রভাব যথেষ্ট বেশী। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছে বিশেষ করে সৌদি আরব, কাতার, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির কাছে জীবাশ্ম জ্বালানির ভান্ডার আছে, এই কারনে এই দেশগুলির ভূরাজনীতিতে যথেষ্ট ক্ষমতাশালী। রাশিয়ার কাছেও প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল, কয়লা প্রচুর পরিমানে রয়েছে, যার জন্য ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধ করার কারনে বিশ্বজুড়ে আর্থিক নিষেধাজ্ঞার পরেও রাশিয়ার অর্থনীতি তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাই ভারতও গ্রীন হাইড্রোজেনের মতোন অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। 

বিশ্ব উষ্ণয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনকে নিয়ন্ত্রন করতে ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে শূন্য কার্বন নির্গমনের লক্ষ্য নিয়েছে। এই গ্রীন হাইড্রোজেন মিশন ভারতকে শূন্য কার্বন নির্গমন দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করবে কারন গ্রীন হাইড্রোজেন তৈরিতে কোনও কার্বন নির্গমন হয়না। ২০২১ সালের স্বাধীনতা দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই গ্রীন হাইড্রোজেন মিশনের কথা ঘোষনা করেছিলেন। নতুন এবং পুনর্নবীকরনযোগ্য শক্তি মন্ত্রনালয় এই মিশনের যাবতীয় রূপরেখা তৈরি করে এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা এই মিশনের অনুমোদন দেয়। এই মিশনের জন্য অনুমোদিত ১৯,৭৪৪ কোটি টাকার মধ্যে ১৭,৪৯০ কোটি টাকা সাইট পোগ্রামেই খরচ হবে। এই সাইট পোগ্রামের আওতায় ভারত সরকার ছোট, মাঝারি, বড় সংস্থাগুলিকে হাইড্রোজেন উৎপাদনের কথা বলবে, যেসব সংস্থা হাইড্রোজেন উৎপাদন করবে তাদের বিশেষ ছাড় দেবে ভারত সরকার। এছাড়া ১,৪৬৬ কোটি টাকা বিশেষ প্রজেক্টে, গবেষনার ৪০০ কোটি টাকা বিশেষ প্রজেক্টে এবং ৩৮৮ কোটি টাকা এই মিশনের অন্যান্য খাতে খরচ হবে। ভবিষ্যতে আরও অর্থায়ন করবে কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রজেক্টে। ভারত সরকার মনে করছে এই মিশনে অন্তত আট লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগ আসবে। গ্রীন হাইড্রোজেন উৎপন্ন করা যথেষ্ট ব্যায় বহুল কিন্তু গ্রীন হাইড্রোজেন মিশনে ব্যাপক পরিমানে হাইড্রোজেন উৎপাদন করা হবে যার কারনে পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে হাইড্রোজেন উৎপাদনে খরচ অনেক কমে যাবে। 

২০২২ সালের মার্চ মাসে ভারত সরকারের তরফে জানানো হয়েছিল এই গ্রীন হাইড্রোজেন মিশনে হাইড্রোজেন উৎপাদনে দুই ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে, চার বছরের পরিকল্পনা ও দশ বছরের পরিকল্পনা যাতে ভারত অদূর ভবিষ্যতে হাইড্রোজেন উৎপাদনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সালে বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয় জানিয়েছে যেসমস্ত সংস্থা গ্রীন হাইড্রোজেন তৈরি করবে তাদের বন্দরের কাছে হাইড্রোজেন বাঙ্কারে সংরক্ষন করে রাখার অনুমোদন দেওয়া হবে। বন্দরের কাছে হাইড্রোজেন সংরক্ষন করে রাখলে সেই সংস্থাটি সহজেই হাইড্রোজেন জাহাজে করে রপ্তানি করতে পারবে। হাইড্রোজেন উৎপাদনকে সাধারনত চারটি ভাগে ভাগ করা হয় বাদামি, ধূসর, নীল ও সবুজ হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন উৎপাদনে কয়লার ব্যবহার করা হলে তাকে বাদামি হাইড্রোজেন বলা হয়, প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেলের ব্যাবহারে হাইড্রোজেন উৎপাদন করা হলে তাকে ধূসর হাইড্রোজেন বলা হয়। এই দুই ধরনের হাইড্রোজেনই ক্ষতিকারক কারন এগুলো উৎপাদনে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হয়। নীল হাইড্রোজেন উৎপাদনে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডকে সংরক্ষন করে রাখা হয়। সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ হাইড্রোজেন উৎপাদনের পদ্ধতি হচ্ছে গ্রীন বা সবুজ হাইড্রোজেন উৎপাদন কারন এটি অপ্রচলিত শক্তি উৎস থেকে যেমন সৌর শক্তি বা বায়ু শক্তি থেকে তৈরি করা হয়। এই গ্রীন হাইড্রোজেন উৎপাদনে কোনও কার্বন নির্গমন হয়না। 

ভৌগলিক কারনে ভারত প্রচুর পরিমানে গ্রীন হাইড্রোজেন, সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি উৎপাদনে সক্ষম। বিশেষজ্ঞদের মতে ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বে হাইড্রোজেনের চাহিদা পাঁচ গুন বেড়ে গিয়ে হবে ২৮ মেট্রিক টন যার মধ্যে ৮০ শতাংশই গ্রীন হাইড্রোজেনের প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই ভারত সরকার অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনের জোর দিয়েছে, ভারতে সৌর বিদ্যুৎ ও বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য একাধিক প্রজেক্ট চলছে। এবার গ্রীন হাইড্রোজেন মিশনের কারনে ভারতে আরও ১২৫ গিগাওয়াট অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদন হবে, যা ভারতের জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি কমাবে। এই মিশনের মাধ্যমে ভারত সরকার প্রতিবছর এক লাখ কোটি টাকা জ্বালানি আমদানি কমানোর লক্ষ্য নিয়েছে যার ফলে ভারতের বৈদেশিক সঞ্চয় বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া গ্রীন হাইড্রোজেন মিশনের জন্য ভারতের বার্ষিক গ্রীন হাইড্রোজেন উৎপাদন ক্ষমতা পাঁচ মিলিয়ন মেট্রিক টন হবে এবং এই বিভাগে প্রায় ছয় লাখের বেশী কর্মসংস্থান হবে। 

গ্রীন হাইড্রোজেন উৎপাদনের কারনে প্রতিবছর অন্তত মিলিয়ন মেট্রিক টন গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ হবে। গ্রীন হাইড্রোজেনের মতোন অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনের মাধ্যমে ভারত এনার্জি খাতে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপর নির্ভরতা কমবে। রিলায়েন্স সংস্থা, ইন্ডিয়ান অয়েল, এনটিপিসি, আদানি সংস্থা, জেএসডব্লু এনার্জির মতোন বেসরকারি সংস্থাগুলি গ্রীন হাইড্রোজেন উৎপাদন শুরু করেছে ব্যাপক হারে। কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব ঘোষনা করেছে ভারত হাইড্রোজেন জ্বালানি যুক্ত ট্রেন তৈরি করছে। এর জন্য হরিয়ানার জিন্দে একটি হাইড্রোজেন উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করছে ভারতীয় রেলওয়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে হরিয়ানার সোনিপথ থেকে জিন্দ পর্যন্ত ৮৯ কিলোমিটার রেলপথে ৩৫টি হাইড্রোজেন ট্রেন চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই প্রজেক্ট প্রতিবছর ভারতীয় রেলওয়ের ২৩ মিলিয়ন ডলার খরচ বাঁচাবে। 

২০২৪ এর মধ্যেই হাইড্রোজেন জ্বালানি নির্ভর ট্রেন চলাচল শুরু হয়ে যাবে। প্রাথমিক পর্যায়ে এই হাইড্রোজেন জ্বালানি নির্ভর ট্রেন দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে, নীলগিরি পর্বত রেলওয়ে, কালকা সিমলা রেলওয়ের মতোন সংরক্ষিত রেলপথে চালানো হবে। অর্থাৎ জার্মানি, চীনের মতে ভারতও হাইড্রোজেন জ্বালানি যুক্ত ট্রেনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু করতে চলেছে। ২০২২ সালের ২০ এপ্রিল অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড আসামের জোরহাটে ভারতের প্রথম গ্রীন হাইড্রোজেন উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করেছে। এখানে ৯৯.৯৯৯ শতাংশ বিশুদ্ধ গ্রীন হাইড্রোজেন তৈরি করা হবে। মাত্র তিন মাসের মধ্যে অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড এই কেন্দ্রটি তৈরি করেছে। এখানে প্রতিদিন দশ কিলোগ্রাম করে অক্সিজেন উৎপাদন করা সম্ভব, যা ভবিষ্যতে বাড়িয়ে ত্রিশ কিলোগ্রাম করা হবে। এই কেন্দ্রে গ্রীন হাইড্রোজেন উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ৫০০ কিলোওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুত কেন্দ্র রয়েছে। অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড সংস্থাটি আইআইটি গৌহাটির সাথে যৌথভাবে গ্রীন হাইড্রোজেন ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মিশ্রনের উপর কাজ করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.