ভারত

ব্রিটিশ পুলিশকে নস্যির মতো উড়ি দিয়েছিলেন রাসবিহারী বসু

ব্রিটিশদের নাকের ডগা থেকে অনবরত কাজ করে গিয়েছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য কিন্তু তাকে ধরতে অক্ষম ছিলেন দেশের উপর রাজ চালানো ব্রিটিশরা। কে ছিলেন এই মহান ব্যক্তিত্ব? তিনি আর কেউ নয় আমাদের দেশের অন্যতম মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী রাসবিহারী বসু। 

১৮৮৫ সালে ২৫ মে পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার সুবলদহে জন্মগ্রহণ করেন রাসবিহারী বসু। তাঁর পিতা ছিলেন বিনোদবিহারী বসু এবং তাঁর মা ছিলেন ভুবনেশ্বরী দেবী এবং একমাত্র বোন ছিলেন সুশীলা। তাঁর ধাত্রী মাতা ছিলেন  তিনকড়ি দাসী। তাঁর পিতামহ ছিলেন কালীচরণ বসু৷ বলা হয় যে, অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বৈঁচীতে ছিল এই বসু পরিবারের আদিবাস। পরবর্তী সময়ে  বসু পরিবার বৈঁচী থেকে প্রথমে হুগলি জেলারই সিঙ্গুরে এবং তারপরে পূর্ব বর্ধমান জেলার সুবলদহে চলে আসে৷ সর্বপ্রথম সুবলদহে বসবাস শুরু করেন তাঁদের পূর্বপুরুষ নিধিরাম বসু। সুবলদহ গ্রামে বসবাসরত কালিচরণ বসুর বিধবা ভ্রাতৃবধূ বিধুমুখীর বাড়িতে কেটেছিল রাসবিহারীর শৈশবকাল। ওই সময় চন্দননগরে  বাস করতেন  তাঁর পিতা।

রাসবিহারী  বসু নামে খ্যাত এই নামটি তাঁকে দিয়েছিলেন তাঁর পিতামহ কালীচরণ বসু। 

সুবলদহের গ্রাম্য পাঠশালায় (বর্তমানে সুবলদহ রাসবিহারী বসু প্রাথমিক বিদ্যালয়) লেখাপড়া করেন রাসবিহারী বসুর। শৈশবকালে তিনি সুবলদহ গ্রামের শুরিপুকুর ডাঙায়  শিখেছিলেন লাঠিখেলা। সুবলদহ গ্রামে তার ঠাকুরদা কালিচরণ বসু এবং তার শিক্ষকদের কাছ থেকে তিনি বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী গল্প শোনেন এবং সেই থেকে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিল বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি।

কথিত আছে যে, তিনি ব্রিটিশদের মূর্তি বানিয়ে সেই মূর্তিগুলিকে তার লাঠি খেলার কৌশলের মাধ্যমে ভেঙে ফেলতেন। ডাং-গুলি খেলতে খুব ভালোবাসতেন তিনি। ১২ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত  সুবলদহ গ্রামে ছিলেন রাসবিহারী বসু। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে আত্মগোপন করার জন্য তিনি  সুবলদহ গ্রামে এসেছিলেন।

কাজের সূত্রে তার পিতা বিনোদবিহারী বসু হিমাচল প্রদেশের সিমলায় বদলী হয়ে গিয়েছিলেন। মূলত তিনি তার পিতামহের তত্ত্বাবধানে সুবলদহ পাঠশালার পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হয়েছিলেন চন্দনগরের মর্টন স্কুল ও ডুপ্লে কলেজে।  চন্দনগরে থাকাকালীন সময় তার মধ্যে বিপ্লবী মনোভাবের জাগরণ ঘটেছিল  অধ্যাপক চারু রায়ের প্রভাবে। ওই সময় তাঁর  বিপ্লবী বন্ধুরা ছিলেন কানাই দত্ত, শ্রীশ ঘোষ, মতি রায় প্রমুখ।

তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সাথে জড়িত রয়েছেন সেই প্রমাণ প্রথম পাওয়া  গিয়েছিল আলিপুর বোমা বিস্ফোরণের সূত্রে মাধ্যমে। ওই মামলার তদন্ত করতে গিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ তার লেখা দুটি চিঠি খুঁজে পান। যার ফলে তিনি প্রথম ১৯০৮ সালে অভিযুক্ত হন, তাকে গ্রেপ্তার করে। তবে প্রমাণের অভাবে মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু সর্বক্ষণ পুলিশের নজরদারির মধ্যে ছিলেন তিনি। এরপর চন্দননগর ছেড়ে তিনি চলে যান দেরাদুনে এবং সেখানে গিয়ে তিনি যোগদান করেন ফরেস্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউটের হেডক্লার্কের পদে। ওই সময় তিনি পল্টন বাজারের কাছে ঘোসি গলিতে থাকতেন।

দেরাদুনে থাকাকালীন সময়ে বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন তিনি। ওই সময় তাঁর সাথে পরিচয় হয় আমীরচাঁদ, দীননাথ চট্টোপাধ্যায়, অবোধবিহারী, বালমুকুন্দ প্রমুখের। এছাড়া তার সাথে বিশেষ আন্তরিকতা গড়ে উঠেছিল যুগান্তরের অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। পরবর্তীকালে বাঘাযতীন নামে খ্যাত যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সাথে গড়ে উঠেছিল তার বিপ্লবী সম্পর্ক।

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়েছিল রাজধানী হিসাবে কলকাতার পরিবর্তে দিল্লিকে নিয়োজিত করার প্রক্রিয়া। ২৩শে ডিসেম্বর ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের আয়োজিত করা হয়েছিল দিল্লিতে তৎকালীন ভাইসরয় সর্ড হার্ডিঞ্জকে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠান। ওই সময় বসন্ত বিশ্বাস নামক এক ১৬ বছরের যুবক মহিলার ছদ্মবেশ ধারণ করে চাঁদনি চকের এক বাড়ি থেকে বোমা নিক্ষেপ করেন হাতিতে বসা ভাইসরয়ের দিকে। ওই হামলায় আহত হন হার্ডিঞ্জ। রাসবিহারী বসু  ছিলেন এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী। বোমা তৈরি করতেও সাহায্য করেছিলেন তিনি। বিস্ফোরণের পরেদিনই দেরাদুনে ফিরে যান তিনি এবং সেখানে পুনরায় শুরু করেন তার স্বাভাবিক কাজকর্ম করা। তিনি এই হামলার সাথে কোনো রকম জড়িত ছিলেন না , সেটা প্রমাণ করার জন্য, তিনি কয়েক মাস পর আয়োজিত করেছিলেন হার্ডিঞ্জকে স্বাগত জানিয়ে এক অনুষ্ঠানের। বহুদিন পর্যন্ত পুলিশ বুঝতে পারেনি যে এই মামলার সাথে রাসবিহারী বসু মিলিত ছিলেন ।

২৪ শে জানুয়ারি ১৯১৩ সালে ঘোষণা করে যে হার্ডিঞ্জের উপর হামলাকারীকে ধরিয়ে দিলে তাকে লক্ষ টাকার পুরস্কার দেওয়া হবে। তবে হত্যাকারী সন্ধান খুঁজে পান না পুলিশ। এরপর ১৭ই মে বসন্ত দাস  ‌’বিষিন দাস‌’ নামক এক শ্রমিকের ছদ্মবেশ ধারণ করে লাহোরের লরেন্স গার্ডেন্স- অবস্থিত পুলিশ ক্লাবে বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন। তার এই হামলার লক্ষ্য ছিল সিলেটের প্রাক্তন এসডিও এবং তৎকালীন পাঞ্জবের সহকারী পুলিশ কমিশনার গর্ডন। তিনি এই হামলায় রক্ষা পেলেও নিহত হয়েছিল একজন চাপরাশি ।

১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই-আগষ্ট মাসে দামোদর নদের প্রবল জলোচ্ছাসের কারনে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়েছিল বর্ধমানে। ওই সময় বন্যা বিধ্বস্ত বর্ধমানে ত্রাণকাজের জন্য রাসবিহারী ফিরে আসেন সুবলদহ গ্রামে। ওই সময় এই ত্রাণ কার্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন)। বাঘা যতীন আহবান জানান সমস্ত জেলার বিপ্লবী নেতা-কর্মীদের বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। এই ত্রাণকাজের ফাঁকে তিনি গোপন বৈঠকে বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের মাটি থেকে ব্রিটিশদের তাড়ানোর জন্য পরবর্তী কর্মপন্থা ঠিক করে নেন। ওইসময় যতীনকেই সর্বাধিনায়ক হিসাবে নির্বাচিত করেন নিষিদ্ধ সশস্ত্র বিপ্লবী দলগুলো। সেই সূত্রেই তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে রাসবিহারীর সঙ্গে। বছর শেষের দিকে রাসবিহারী বসু  উত্তর ভারত থেকে এসে সংগঠনের কাজ সম্পর্কে কিছু নির্দেশ দেন সর্বাধিনায়ক বাঘ যতীনকে। ওই সময় এই বিপ্লবী পরিকল্পনার সাথে যুক্ত হন শচীন স্যানাল। এই বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডগুলির পিছনে যে রয়েছে রাসবিহারী বসুর হাত তখনও পর্যন্ত তা  পুলিশের কল্পনা করার বাইরে ছিল। তবে  ক্রমাগত প্রচেষ্টা চালানোর পর অবশেষে  একটি সূত্র অনুসরণ করে, পুলিশ শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল রাসবিহারী বসুকে বিপ্লবী হিসেবে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *