ভারত

ভারতবর্ষের ইতিহাসে রাজপুতদের বীরত্ব স্বর্নাক্ষরে লেখা থাকবে। জানুন বিস্তারিত

ভারতবর্ষের ইতিহাসে রাজপুতদের বীরত্ব স্বর্নাক্ষরে লেখা আছে। রাজপুত রাজাদের বীরত্ব মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল। ভারতবর্ষের ইতিহাসে বহুবার বিদেশী শাসকরা পরাজিত হয়েছে রাজপুতদের কাছে। বলা হয় ইউরেশিয়া অঞ্চল থেকে ভারতে এসেছিল রাজপুতরা। 

ষষ্ঠ শতক থেকে ভারতে রাজপুতরা প্রভাবশালী হয়ে ওঠে এবং বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত উত্তর ও মধ্য ভারতের অনেক অংশ এবং বর্তমান পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে রাজত্ব করতো রাজপুতরা। রাজস্থান, গুজরাট, উত্তর প্রদেশ, হিমাচল প্রদেশে, উত্তরাখন্ড সহ আরও বেশ কয়েকটি প্রদেশে বিভিন্ন সময়ে অনেক শক্তিশালী রাজপুত রাজারা শাসন করেছে রাজস্থানের ইতিহাসে বরাবরই মেওয়ার ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী রাজপুত রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি। 

ভারতের ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী যোদ্ধা মহারানা প্রতাপও এই মেওয়ার রাজপরিবারেরই সদস্য। ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমনই এক গুরুত্বপূর্ন যুদ্ধ হচ্ছে নাগৌর যুদ্ধ যাতে মেওয়ারে রাজা মহারানা কুম্ভ শামস খানকে পরাজিত করে। 

ভারতের ইতিহাসে বহু ঐতিহাসিক যুদ্ধ হয়েছিল রাজস্থানের ভূমি দখলকে কেন্দ্র করে। আয়তনের দিক দিয়ে ভারতের সবথেকে বড় রাজ্য রাজস্থান বা অতীতের রাজপুতানাকে জয় করবার অনেক চেষ্টা করেছিল অতীতে বিদেশী শাসকরা কিন্তু রাজপুত যোদ্ধাদের সামনে সবাইকেই পরাজিত হতে হয়েছিল। মধ্যযুগীয় ইতিহাসে আরাবল্লি পর্বতমালার পশ্চিমে অবস্থিত জনবসতিপূর্ন এলাকা গুলো নিয়ে গঠিত হয়েছিল রাজপুতানা অঞ্চল। এই রাজপুতানা অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী প্রদেশ ছিল মেওয়ার যার রাজধানী ছিল চিত্তোরগড়। বর্তমান রাজস্থানের ভিলওয়ারা, চিত্তোরগর, রাজসামান্দ, উদয়পুর অঞ্চল নিয়ে মেওয়ার প্রদেশ গঠিত ছিল। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় উদয়পুর ব্রিটিশ শাসনের গুরুত্বপূর্ন প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। মেওয়ার অঞ্চলটি উত্তর পশ্চিমে আরাবল্লি পর্বতমালা, উত্তরে আজমির, দক্ষিনে গুজরাট এবং রাজস্থানের ভাগাদ অঞ্চল, দক্ষিনে মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের মালওয়া অঞ্চল এবং পূর্বে রাজস্থানের হাডোটি অঞ্চলের মধ্যে অবস্থিত। ঐতিহাসিক মেওয়ার অঞ্চলের প্রাচীন নাম ছিল মেদাপাতা। ৯৯৬- ৯৯৭ সিইতে বিজাপুরের হাতুন্দি শিলালিপিতে এই মেদাপাতা নামটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ে পাতা শব্দের অর্থ ছিল প্রশাসনিক কেন্দ্র। ঐতিহাসিক জি সি রায়চৌধুরীর কথায় মেদা পাতা নামটি এসেছে মেদা উপজাতির নামানুসারে যার উল্লেখ পাওয়া যায় বরাহমিহিরের বৃহৎ সংহিতাতে। গুহিলা রাজবংশের রাজা সমরসিংহের মাউন্ট আবু শিলালিপি থেকে যানা যায় তার পূর্বজ মহারাজ বাপ্পা রাওয়াল অষ্টম শতকে মেওয়ার বিজয় করেন এবং তখন থেকেই মেওয়ারে গুহিলা রাজবংশের শাসন শুরু হয়। 

১৩২৬ সালে গুহিলা রাজবংশেরই এক সদস্য হামির সিং মেওয়ারে সিসোদিয়া রাজবংশের শাসন শুরু করেন। সিসোদিয়া মূলত গুহিলা রাজবংশেরই একটি বিভাগ। হামির সিং দিল্লির তুঘলক সুলতানকে পরাস্ত করে পুনরায় মেওয়ার রাজ্যের শক্তিমত্তার প্রদর্শন করেন। এই সিসোদিয়া বংশেরই একজন শক্তিশালী শাসক হলেন মহারানা কুম্ভ যিনি মহারানা মোকাল সিং এর পুত্র ছিলেন। মহারানা কুম্ভের কারনেই মেওয়ার সেসময় উত্তর ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী অঞ্চল হয়ে ওঠে। ১৪৩৩ সালের পর থেকে ১৪৬৮ সাল অবধি মহারানা কুম্ভ ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক। রাজস্থানের ইতিহাসে মহারানা কুম্ভের নাম স্বর্নাক্ষরে লেখা রয়েছে। মেওয়ারের ৮৪ টি দুর্গের মধ্যে ৩২ টিই মাহারানা কুম্ভ তৈরি করেছিলেন যার মধ্যে কুম্ভলগড়ের দুর্গ সবচেয়ে বড় ছিল। রাজস্থানের সবচেয়ে উচ্চতম (১,০৭৫ উচ্চ) দুর্গ এই কুম্ভলগড়ের দুর্গ যার দেওয়াল ৩৮ কিলোমিটারের বেশী লম্বা। ১৪৩৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মেওয়ারের সিংহাসনে বসেন কুম্ভকর্ন সিং, যিনি পরে মহারানা কুম্ভ নামেই বেশী পরিচিত হন। এত ছোট বয়সে সিংহাসনে বসার পরও তিনি অত্যন্ত দক্ষভাবে গোটা সাম্রাজ্য পরিচালনা করেন। মেওয়ারের ৪৮তম রানা হিসাবে রাজ্যাভিষেক হয়েছিল তাঁর। 

১৪৪২ সালে মহারানা কুম্ভ হারাওতি বিজয়ের জন্য অভিযান শুরু করেন। মেওয়ারে মহারানা কুম্ভের অনুপস্থিতির সুযোগে মালওয়ার সুলতান মাহমুদ খিলজী মেওয়ার আক্রমন করে। সুলতান মাহমুদ ১৪৪০ সালে মান্ধবগড়ের যুদ্ধে মহারানা কুম্ভের কাছে পরাজিত হওয়ার জন্য প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ খুঁজছিল কিন্ত এবারেও কিন্তু মহারানা কুম্ভের সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয় সে। এই ঘটনার চারবছর পর ১৪৪৬ সালের ১১- ১২ অক্টোবর একটি বড় সেনাবাহিনী গঠন করে আবারও মেওয়ার আক্রমনের উদ্দেশ্যে মন্ডলগড় যাচ্ছিল সুলতান মাহমুদ কিন্তু বানাস নদী অতিক্রম করার সময়েই তার উপর আক্রমন করে মহারানা কুম্ভ এবং প্রান বাঁচাতে মান্ডু পালিয়ে যায় মাহমুদ। মহারানা কুম্ভের কাছে ছয় বছরে তিনবার শোচনীয় পরাজয়ের পর পরবর্তী দশ বছর মাহমুদ খিলজী ভয়ে মহারানা কুম্ভকে আক্রমনের সাহস পর্যন্ত করতে পারেনি। এরপর বেশ কিছু বছর পুরো এলাকায় শান্তি ছিল কিন্তু ১৪৫৩ সালের পর থেকে আবার নাগৌরকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ শুরু হয় মহারানা কুম্ভ ও নাগৌরের শাসকের। সেসময় দিল্লির সুলতানের অধীনে একটি প্রদেশ ছিল নাগৌর সালতানাত। 

১৪৫৩- ৫৪ সালে নাগৌরের শাসক সুলতান ফিরোজ খানের মৃত্যু হয়। সুলতান ফিরোজ খান মূলত নাগৌরের গভর্নর ছিল। ফিরোজ খানের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার নিয়ে তার দুই ছেলে শামস খান এবং মুজাহিদ খানের মধ্যে ঝামেলা শুরু হয়। মুজাহিদ খান শামস খানকে পরাজিত করে সিংহাসন দখল করে নেয়। শামস খান পালিয়ে মহারানা কুম্ভের কাছে সাহায্যের জন্য আশ্রয় নেয়। 

মহারানা কুম্ভ নিজেও নাগৌর অধিকার করে বিশাল সাম্রাজ্য গঠনের স্বপ্ন দেখছিল যার কারনে তিনি রাজি হয়ে যান শামস খানকে সহায়তা করতে। শামস খান মহারানা কুম্ভকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে সিংহাসনে বসে মহারানা কুম্ভের অধীনস্থ থাকবে। মহারানা কুম্ভ বিশাল সেনা নিয়ে নাগৌর যান এবং মুজাহিদ খানকে পরাজিত করে শামস খানকে সিংহাসনে বসায়। মুজাহিদ খান গুজরাট পালিয়ে যায়। মহারানা কুম্ভকে শামস খান নাগৌরের দুর্গকে ধ্বংস না করতে প্রার্থনা করেন, শামস খান জানায় দুর্গ ধ্বংস হয়ে গেলে মুজাহিদ খানের লোকেরা তাকে হত্যা করবে, সময় হলে সে নিজেই দুর্গ ধ্বংস করে দেবে। মহারানা কুম্ভ যখন কুম্ভলগড় ফিরে আসেন তখন তিনি খবর পান শামস খান দুর্গ ধ্বংস করার বদলে দুর্গের প্রতিরক্ষা আরও শক্তিশালী করছে এবং সেনাবাহিনী তৈরি করছে। 

মহারানা কুম্ভ ১৪৫৬ সালে তার বিশাল সেনা নিয়ে নাগৌর আক্রমন করে এবং শামস খানকে পরাজিত করে পুরো নাগৌর নিজের অধীনস্থ করেন। শামস খান তার মেয়েকে নিয়ে আহমেদাবাদ পালিয়ে যায়। সেখানে সুলতান কুতুবউদ্দিন আহমেদ শাহ দ্বিতীয়র সাথে তাঁর মেয়ের বিয়ে দেন। সুলতান আহমেদ শাহ দ্বিতীয় তার একটি বড় সেনা পাঠায় নাগৌরে। কিন্তু আহমেদ শাহ দ্বিতীয়ের সেনাবাহিনীও শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয় মহারানা কুম্ভের কাছে। মহারানা কুম্ভ সম্পূর্ন নাগৌর তার সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তিনি নাগৌর দুর্গের দরজা এবং ভগবান হনুমানজীর ছবি কুম্ভলগড়ে নিয়ে এসে কুম্ভগড়ের প্রধান প্রবেশদ্বারে স্থাপন করেছিলেন। কুম্ভলগড়ের এই মুখ্য প্রবেশদ্বারের নাম দেওয়া হয় হনুমান পোল। মহারানা কুম্ভ তার সময়ে মেওয়ারকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল, সেসময় আশেপাশের কোনও রাজার ক্ষমতা ছিলনা মহারানা কুম্ভের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার। মহারানা কুম্ভ চিত্তোরে ৩৭ মিটার বা ১২১ ফুট উচ্চ একটি স্তম্ভ তৈরি করেছিলেন যার নাম দেওয়া হয় বিজয় স্তম্ভ যা বিজয়ের প্রতীক। বলা হয় এই স্তম্ভ ১৪৪৮ সালে তৈরি করা হয়েছিল কিন্ত কিছু সূত্র অনুযায়ী ১৪৫৮- ১৪৬৮ সালের মধ্যে এই স্তম্ভ তৈরি করা হয়েছিল। নয় তলা এই স্তম্ভে রামায়ন ও মহাভারতের অনেক তথ্য, দেব দেবীর ছবি ছিল। 

১৪৬৮ সালে কুম্ভলগড়ে কুম্ভাস্বামী মন্দিরের কাছে মহাদেবের উপাসনা করবার সময় মহারানা কুম্ভের ছেলে উদয় সিং প্রথম তাকে হত্যা করে। এরপর উদয় সিং প্রথম হাতিয়ারা বা খুনী নামেই কুখ্যাত হয়। উদয় সিং প্রথম নিজেও বেশীদিন সিংহাসনে থাকতে পারেনি, মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে ১৪৭৩ সালে তার মৃত্যু হয়। বলা হয় বাজ পড়ে তার মৃত্যু হয়, তবে তার মৃত্যুকেও হত্যা বলেই ধারনা করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *