ভারত

ফিলিপিন্স কেন হঠাৎ করে ভারতবর্ষের থেকে ব্রাহ্মস মিসাইল ক্রয় করতে চাইছে?

রাজেশ রায়: কিছুদিন আগেই ভারতের সাথে ফিলিপিন্সের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা চুক্তি হল। ফিলিপিন্স ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার বা ২৮০০ কোটি টাকার বিনিময়ে ভারতের সাথে ব্রাহ্মস মিসাইল কেনার জন্য চুক্তি করে। চীনকে কাউন্টার করার জন্য ফিলিপিন্স ব্রাহ্মস মিসাইল ক্রয় করেছে। ফিলিপিন্সের হঠাৎ ই ব্রাহ্মস মিসাইল কেনার দরকার কেন পড়ল? ব্রাহ্মস মিসাইল কীভাবে ফিলিপিন্স কে সাহায্য করবে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এই ব্রাহ্মস মিসাইল কী চীনের দাদাগিরি কমাতে পারবে? আজকের প্রতিবেদনে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

ফিলিপিন্সের ন্যাশানাল ডিফেন্স সেক্রেটারি ডেলফিন লরেন্জানা এই চুক্তির ব্যাপারে জানায় তার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে। গত ১৪ জানুয়ারি ডেলফিন লরেন্জানা জানান ফিলিপিন্স নেভি ভারতের থেকে তিন ব্যটারি ব্রাহ্মস মিসাইল কিনেছে। তিনি তার ফেসবুক পেজে এই চুক্তির কপিও প্রকাশ করেন যা ছিল অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল রাজেন্দ্র নেগীর নামে ছিল যিনি ব্রাহ্মস এরোস্পেস প্রাইভেট লিমিটেডের প্রতিনিধি। ফিলিপিন্স নেভিও তাদের টুইটারে এই চুক্তির ব্যাপারে জানিয়েছে। আসলে ফিলিপিন্স তাদের নেভিকে সুপারসনিক মিসাইল দিয়ে সাজানোর পরিকল্পনা ২০১৭ সাল থেকেই শুরু করে। ২০১৯ সাল থেকেই ফিলিপিন্সের নজর ছিল ব্রাহ্মস মিসাইলের উপর কিন্তু প্রথমে ফান্ডিং এর কারনে ফিলিপিন্স এই চুক্তি থেকে পিছিয়ে আসে। কিন্তু দি ডিপ্লোম্যাট নিউজ ওয়েবসাইট সেই বছরই জানায় ফিলিপিন্স আবারও এই চুক্তির ব্যাপারে কথা শুরু করেছে।

 ২০১৯ এ ফিলিপিন্স বায়ুসেনার কিছু অফিসার ভারতে এসে তেজস যুদ্ধবিমান পরীক্ষা করার সময় এব্যাপারে কথা বলে ভারতের সাথে।২০১৯ সালের ২৫ অক্টোবর ফিলিপিন্স মিডিয়া জানায় ফিলিপিন্সের সামরিক বাহিনীর উচ্চ আধিকারিকরা ভারতের শিভালিক ক্লাস ফ্রিগেটের গাইডেড মিসাইল ফ্রিগেট আইএনএস সহ্যাদ্রি পরিদর্শন করে সেখানে জাহাজে থাকা ব্রাহ্মস মিসাইলের সক্ষমতা পর্যবেক্ষণ করে। 

২০২০ সালে ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রপতি ব্রাহ্মস মিসাইল কেনার জন্য প্রয়োজনীয় ফান্ডিং এর অনুমোদন দেয়। ২০২১ সালের ২ মার্চ ভারত ও ফিলিপিন্সের মধ্যে ডিফেন্স মেটেরিয়াল ও ইকুইপমেন্ট ক্রয় করার চুক্তি হয়। তখনই মোটামুটি সবাই জেনে যায় ফিলিপিন্স ভারত থেকে ব্রাহ্মস কিনতে চলেছে। এর ঠিক ১০ মাস পর গত ২৮ জানুয়ারি এই চুক্তি হয়। ফিলিপিন্স নেভি তাদের জন্য যে ব্রাহ্মস মিসাইলের চুক্তি করেছে সেগুলি শোর বেসড যার অর্থ এই ব্রাহ্মস মিসাইলগুলি কোন যুদ্ধজাহাজে ইনস্টল করা হবে না। এগুলি সমুদ্রের তীরে ইনস্টল করা হবে। ফিলিপিন্স মোট তিন ব্যাটারি ব্রাহ্মস মিসাইল কিনেছে, প্রত্যেক ব্যটারিতে চারটি লঞ্চার রয়েছে এবং প্রত্যেক লঞ্চারে তিনটি করে ব্রাহ্মস মিসাইল রয়েছে যার অর্থ প্রত্যেক ব্যাটারিতে ১২ টি করে ব্রাহ্মস মিসাইল রয়েছে। অর্থাৎ তিন ব্যাটারি লঞ্চার থেকে একসাথে ৩৬ টি ব্রাহ্মস মিসাইল লঞ্চ করা সম্ভব। ফিলিপিন্স ব্রাহ্মস মিসাইল গুলো কিনছে সেগুলোর রেঞ্জ ২৯০ কিলোমিটার যা ২০০ কিলোগ্রাম ওয়ারহেড বহন করতে সক্ষম। ব্রাহ্মসের গতি ৩ ম্যাক যা কিলোমিটারে প্রকাশ করলে হয় ৩৭০০ কিলোমিটার /ঘন্টা অর্থাৎ এক মিনিটে ব্রাহ্মস ৬১ কিলোমিটার পথ যেতে সক্ষম। একবার ব্রাহ্মস ফায়ার করা হলে টার্গেটে পৌঁছাতে ব্রাহ্মসের পৌনে পাচ মিনিট সময় লাগে। ব্রাহ্মস সী ড্রাইভ টেকনোলজি যুক্ত যার জন্য একে শনাক্ত করা খুব কঠিন। শত্রুর বুঝে ওঠার আগেই ব্রাহ্মস তাকে ধ্বংস করে দেবে। 

ফিলিপিন্স ব্রাহ্মস মিসাইল ক্রয় করেছে চীনের জন্য। দক্ষিন চীন সাগরে চীনের দাদাগিরি বেড়েই চলেছে। ফিলিপিন্সের সাথে চীনের ঝামেলা লেগেই আছে তবে চীনের সাথে ফিলিপিন্সের এই ঝামেলা আজকের নয় বহুদিনের। আমেরিকার ডিজিটাল লাইব্রেরিতে এই ব্যপারে একটি প্রতিবেদন রয়েছে। ক্রিপিং অ্যাসারটিভনেস — চায়না, দি ফিলিপিন্স এন্ড দি সাউথ চায়না সী ডিসপুট নামক প্রতিবেদন যা ১৯৯৯ সালে ইয়ান জেমস স্টোরে প্রকাশ করেছিল এতে বলা হয়েছে কীভাবে ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৮ এর মধ্যে ফিলিপিন্সের কাছাকাছি থাকা কিছু দ্বীপ দখল করে নেয়। চীন এখানে ডবল গেম খেলে একদিকে ফিলিপিন্সের সাথে কথাবার্তার নাটক করে অন্যদিকে দ্বীপ দখল করে। ফিলিপিন্সের সেনাবাহিনী চীনের তুলনায় দুর্বল যার জন্য চীন এই দাদাগিরি দেখায়। 

দক্ষিণ চীন সাগর পুরো চীন নিজের দখলে রাখতে চাইছে এবং এখানে অন্যান্য দেশের অধিকার গায়ের জোরে হঠিয়ে দিচ্ছে। গত ২ মাস আগেই দি ডিপ্লোম্যাটের রিপোর্ট অনুযায়ী ফিলিপিন্স নেভির বোটের উপর ওয়াটার ক্যানন হামলা করে চীনের উপকূল রক্ষীরা। ফিলিপিন্সের সেকেন্ড থমাস শোলে ফিলিপিন্স সেনাবাহিনীর জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছিল তখনই চীনের উপকূল রক্ষী বাহিনীরা বাধা দেয়। এব্যাপারে ফিলিপিন্স তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক আদালতে চীনের বিরুদ্ধে করা মামলায় ফিলিপন্স জিতে যায়। নেদারল্যান্ডসের রাজধানী দি হেগে পারমানেন্ট কোর্ট অফ আরব্রিটিউশনে এই মামলা হয় যাতে চীন হেরে যায়। দক্ষিণ চীন সাগরে শুধু ফিলিপিন্সই নয়, ব্রুনেই, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ার সাথেও চীনের ঝামেলা আছে। চীন এই প্রত্যেকটি দেশের সমুদ্রসীমা নিজেদের বলে দাবি করে নয়টি লাইন টেনে দিয়েছে যাকে বিতর্কিত নাইন ড্যাশ লাইন বলে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোন দেশের সমুদ্রের তীর থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত এলাকা হচ্ছে সেই দেশটির এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন কিন্তু চীনের নাইন ড্যাশ লাইন এসব মানছে না। দক্ষিণ চীন সাগর চীন পুরো দখল করতে চাইছে কারন দক্ষিণ চীন সাগরকে সোনার খনি বলা হয়। প্রতিবছর এখান দিয়ে প্রায় ৩.৩৭ ট্রিলিয়ন ডলারের বানিজ্য হয় এবং বিশ্বের ৪০ শতাংশ লিকুইড ন্যচারাল গ্যাস যায়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন দক্ষিণ চীন সাগর কতটা লাভজনক জায়গা। দক্ষিণ চীন সাগরে থাকা ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট দ্বীপ গুলোতে কৃত্রিম ভাবে মাটি ফেলে আয়তনে বড় দ্বীপ তৈরি করছে চীন, যার উদাহরণ স্পার্টলি দ্বীপ। এই সব দ্বীপে চীন মিলিটারি বেস তৈরি করছে। এমনকী রানওয়ে তৈরি করে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেও রেখেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে এমনই কীছু দ্বীপের নাম বলছি:–

*ফিয়েরি ক্রস রিফ:- এখানে তিন কিলোমিটার লম্বা রানওয়ে রয়েছে এবং চারটি যুদ্ধবিমান থাকতে পারে এখানে। 

*গাভেন রিফ :- এখানে সেন্সর ও কমিউনিকেশন সিস্টেম রয়েছে এবং উইন্ড টারবাইন রয়েছে যা বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। 

*হুজেস রিফ:- এখানে প্রশাসনিক ভবন রয়েছে এবং সেন্সর ও কমিউনিকেশন সিস্টেম রয়েছে। 

*সুবি রিফ:- এখানে আন্ডার গ্রাউন্ড স্টোরেজ ফেসিলিটি রয়েছে এবং সেন্সর সিস্টেম রয়েছে। 

*মিসচেফ রিফ:- এখানে সেন্সর কমিউনিকেশন সিস্টেমের পাশাপাশি আন্ডারগ্রাউন্ড স্টোরেজ ফেসিলিটি রয়েছে। এখানে আটটি যুদ্ধবিমান থাকতে পারে। এখানে তিন কিলোমিটার লম্বা রানওয়ে রয়েছে। 

*কিউটেরন রিফ ও জনসন রিফ:- এখানে প্রশাসনিক ভবন, সোলার প্যানেল, সেন্সর রয়েছে। 

চীনের এই দাদাগিরি গোটা বিশ্বের সামনে স্পষ্ট হয়ে গেছে। যার জন্য ফিলিপিন্স ভারত থেকে ব্রাহ্মস মিসাইল কিনছে, এরা কোন কাউন্টার সিস্টেম চীনের কাছেও নেই। এইজন্য চীন ফিলিপিন্স কে কিছু বলার আগে অন্তত দশ বার ভাববে। আপনাদের আগেই জানিয়েছিলাম যে কোন দেশের সমুদ্র তীর থেকে ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব কে সেই দেশটির এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন বলে, যদি একে কিলোমিটারে প্রকাশ করি তা দাঁড়ায় ৩৭০ কিলোমিটার। এবার ব্রাহ্মসের রেঞ্জ ২৯০ কিলোমিটার। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে ফিলিপিন্স কেনো ব্রাহ্মস কিনছে। ফিলিপিন্সের একটি জনপ্রিয় মিডিয়া চ্যানেল এএনসি ২৪/৭, এখানে ক্রিশ্চিয়ান এসগুয়েরা নামে একজন উপস্থাপক জনপ্রিয় শো আফটার দি ফ্যাক্টে গত ১৮ জানুয়ারী এশিয়ান মেরিটাইম ট্রান্সপোর্টেশনের প্রধান গ্রেগ পোলিং এর সাক্ষাৎকার নিয়েছিল যাতে গ্রেগ পোলিং জানান ব্রাহ্মস কেনা ফিলিপিন্সের জন্য গেম চেঞ্জার।

ব্রাহ্মসের মোকাবিলা করতে চীন দুবার ভাববে কারন একটি ১০০ মিলিয়ন ডলারের জাহাজ যদি ১ মিলিয়ন ডলারের একটি মিসাইল ধ্বংস করে দেয় তাহলে ক্ষতি চীনেরই। চীন কিন্তু জানত ফিলিপিন্স ব্রাহ্মস কিনবে এর কাউন্টার করতে চীন তাদের এইচ কিউ-৯ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম ওইসব দ্বীপে ইনস্টল করেছে কিন্তু এই মহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত গতির সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ব্রাহ্মসকে কাউন্টার করার ক্ষমতা কোন এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমর নেই এই কথা চীন নিজেও জানে।

আগামী বছর থেকেই ব্রাহ্মস ডেলিভারি দেওয়া শুরু হবে ফিলিপিন্সকে। শোনা যাচ্ছে ফিলিপিন্স নেভির পাশাপাশি ফিলিপিন্সের সেনাবাহিনীও দুই ব্যাটারি ব্রাহ্মস মিসাইল ক্রয় করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.