ফিচার আর্টিকেল

বিশ্বের প্রথম লেজার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সার্ভিসে নিয়ে আসতে চলেছে ইসরায়েল। হামাসের বিরুদ্ধে ইহুদি রাষ্ট্রের নতুন ঘাতক অস্ত্র

গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে অতর্কিত আক্রমন করে প্যালেস্টাইন জঙ্গি সংগঠন হামাস। এই ঘটনায় প্রায় এক হাজার সাধারন ইসরায়েলি নাগরিক নিহত হয়। এরপরেই ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতেনইয়াহু হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেন। মূলত গাজাপট্টি থেকে হামাস ইসরায়েলের উপর আক্রমন চালায়। ইসরায়েল ও মিশর সীমান্তে অবস্থিত ছোট একটি অঞ্চল গাজাপট্টি যেখানে ২৩ লাখ প্যালেস্টাইন জনসংখ্যার ভিড়কে মানব ঢাল বানিয়ে হামাস এর আগেও ইসরায়েলে আক্রমন করেছে, তবে এবারের আক্রমন বিগত পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস। হামাসের আক্রমনের পর থেকেই গাজায় ইসরায়েলের বায়ুসেনা বোম্বিং করছে হামাসের গোপন আস্তানায়। এরই মধ্যে জানা যাচ্ছে ইসরায়েল হয়ত হামাসের বিরুদ্ধে আয়রন বিমের ব্যবহার করতে পারে। ইসরায়েল বহুদিন ধরেই আয়রন বিম নামের একটি লেজার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করছিলো, এটি পূর্নরূপে সার্ভিসে আসতে আরও কিছু বছর সময় লাগতো তবে বলা হচ্ছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ইসরায়েল এটা হয়ত এখনই হামাসের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে পারে। 

হামাস ইসরায়েল যুদ্ধ এই মহূর্তে চরম পর্যায়ে রয়েছে। ইসরায়েল ড্রোনের মাধ্যমে হামাসের গোপন আস্তানা খুঁজে খুঁজে সেখানে এয়ারস্ট্রাইক করছে। উত্তর গাজায় হামাসের শক্ত ঘাঁটি থাকায়, ইসরায়েল উত্তর গাজার বাসিন্দাদের নির্দেশ দিয়েছে যেন দক্ষিন গাজায় চলে যায়। এখনও পর্যন্ত এই যুদ্ধে ইসরায়েলের ১৪০০ জনের অধিক এবং প্যালেস্টাইনের ৩৫০০ এর অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এরই মধ্যে ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য দপ্তর জানিয়েছে গাজায় আল আহলি হসপিটালে ইসরায়েলের বোম্বিংএ প্রায় ৫০০ লোক মারা গেছে এবং ৩০০ এর বেশী মানুষ আহত। তবে ইসরায়েল জানিয়েছে তারা হসপিটালে বোম্বিং করেনি হামাসের রকেটই ইসরায়েলে না গিয়ে হসপিটালে আঘাত হেনেছে ভুল করে। ইসরায়েল দুজন হামাস সন্ত্রাসীর কথোপকথন প্রকাশ করে জানিয়েছে এই ঘটনার পেছনে হামাসই দায়ী। তবে এরই মাঝে হামাস আবারও রকেট ছোঁড়ে ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিভ লক্ষ্য করে যদিও ইসরায়েলের শক্তিশালী আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা আয়রন ডোম সমস্ত রকেটই ধ্বংস করে দিয়েছে। তবে ইসরায়েল আয়রন ডোমের থেকেও আধুনিক অস্ত্র আয়রন বিম ব্যবহার করতে চলেছে বলে ধারনা করা হচ্ছে। আয়রন বিম মূলত লেজার এয়ার ডিফেন্স বা আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেম। হিব্রু ভাষায় আয়রন বিমকে বলা হয় ম্যাগেন বা লাইট শিল্ড। আয়রন বিম একটি ডাইরেক্ট এনার্জি ওয়েপনস বা ডিইডব্লুউ। একটি ডাইরেক্ট এনার্জি ওয়েপনস তার টার্গেটকে লেজার, মাইক্রোওয়েভ, পার্টিকেলস বিমস অথবা উচ্চ শব্দের মাধ্যমে ধ্বংস করে। ডিইডব্লুউ সিস্টেমে কোন মিসাইল ব্যবহার করা হয়না আকাশ প্রতিরক্ষার জন্য। ইসরায়েলের রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম এই আয়রন বিম সিস্টেম তৈরি করছে। ২০১৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারী  সিঙ্গাপুর এয়ারশোতে প্রথম আয়রন বিমকে জনসমক্ষে আনা হয়। এর আগে এই রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম ইসরায়েলের বিখ্যাত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম আয়রন ডোমও তৈরি করেছে। আয়রন বিম সিস্টেম ফাইবার লেজার পদ্ধতিতে লেজার বিম তৈরি করে যা টার্গেটকে ধ্বংস করে। আর্টিলারি শেল, কামানের গোলা, ড্রোন, স্বল্প পাল্লার রকেট ধ্বংস করতে সক্ষম এই সিস্টেম। আয়রন বিম সিস্টেমের রেঞ্জ সাত থেকে দশ কিলোমিটার। ইসরায়েলের প্রধান শত্রু হামাস এবং লেবাননের সন্ত্রাসী সংগঠন হিজবুল্লাহ। দক্ষিন ইসরায়েলে হামাস এবং উত্তর ইসরায়েলে হিজবুল্লাহ মাঝে মধ্যেই ইসরায়েল লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়ে। এই হামাস এবং হিজবুল্লাহকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা দেয় ইরান। হিজবুল্লাহ এবং হামাসের রকেট আয়রন বিম খুব সহজেই ধ্বংস করতে পারবে। ইসরায়েলের প্রধান এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হচ্ছে আয়রন ডোম কিন্তু আয়রন ডোমের প্রতিটি তামির ইন্টারসেপ্টার মিসাইলের খরচ প্রায় ৪০,০০০ – ৬০,০০০ ডলার। অন্যদিকে হামাস ও হিজবুল্লাহ এর আনগাইডেড রকেট খুবই কম দামের। যার কারনে এতদিন পর্যন্ত হামাস ও হিজবুল্লাহের রকেট আক্রমন ঠেকাতে ইসরায়েলের যথেষ্ট খরচ হত কিন্ত আয়রন বিম সার্ভিসে এলে সেই খরচ অনেক কমে যাবে কারন আয়রন বিমে একবার টার্গেট ধ্বংস করতে খরচ মাত্র ২০০০ ডলার। 

২০২৫ সাল নাগাদ ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর হাতে আয়রন বিম আসার সম্ভবনা ছিল। কিন্তু বর্তমানে হামাসের সাথে যুদ্ধের কারনে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে আয়রন বিম দ্রুত সার্ভিসে আনা হবে। ইসরায়েলের অনেক স্থানীয় মিডিয়াও দাবি করেছে আয়রন বিম সার্ভিসে আনার জন্য যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে কাজ চলছে। ইসরায়েলের কাছে অ্যারো ২, অ্যারো ৩, ডেভিড স্লিং এবং আয়রন ডোম এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে এই মূহুর্তে। আয়রন বিমকে এই সমস্ত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের রেডারের সাথে সংযুক্ত করে একটি শক্তিশালী সম্মিলিত আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েছে ইসরায়েল, তবে আয়রন বিমকে সমস্ত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের রেডারের সাথে সংযুক্ত করতে কিছুটা সময় লাগতে পারে।  

ইসরায়েলের রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম নামক সংস্থা আয়রন বিমের পাশাপাশি লাইট বিম নামেও একটি লেজার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করছে। লাইট বিম আয়রন বিমের তুলনায় কম শক্তিশালী। লাইট বিম ৭.৫ কিলোওয়াট লেজার বিম তৈরি করতে পারে। লাইট বিম ছোট ড্রোন এবং ভূমিতে থাকা আইইডি ধ্বংস করতে সক্ষম। লাইট বিমের প্রথম প্রোটোটাইপ ইতিমধ্যেই তৈরি করা হয়ে গেছে। আয়রন বিম ১০০- ১৫০ কিলোওয়াট লেজার বিম তৈরি করতে সক্ষম। আয়রন বিম মাত্র চার সেকেন্ডে ড্রোন, মিসাইল ধ্বংস করতে সক্ষম। আয়রন বিম বিশ্বের প্রথম আধুনিক ডাইরেক্ট এনার্জি ওয়েপনস সিস্টেম যা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করা হতে চলেছে। আমেরিকা, ভারত, চীন, রাশিয়াও ডাইরেক্ট এনার্জি ওয়েপনস সিস্টেমের উপর কাজ করছে কিন্তু এখনও কোন দেশ যুদ্ধক্ষেত্রে এই সিস্টেম ব্যবহার করেনি। ২০১০- ২০১৫ পর্যন্ত পাঁচ বছর গবেষনার পর রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম এই আয়রন বিম তৈরি করেছে, এই প্রজেক্টর পুরো অর্থায়ন করেছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। একটি আয়রন বিম ব্যাটারিতে একটি এয়ার ডিফেন্স রেডার, একটি কম্যান্ড এবং কন্ট্রোল ইউনিট এবং দুটি হাই এনার্জি লেজার সিস্টেম রয়েছে। 

২০২২ সালে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এবং রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম জানায় আয়রন বিম সিস্টেম সফল ভাবে ড্রোন, রকেট, কামানের গোলা এবং অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল ধ্বংস করেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেফতালি বেনেট জানিয়েছিলেন তারা এক বছরের মধ্যে এই সিস্টেম সার্ভিসে আনবে, তবে অক্টোবর, ২০২২ এ রাফায়েল জানায় এই সিস্টেম সার্ভিসে আসতে আরও দুই, তিন বছর সময় লাগবে। মে, ২০২৩ সালে রাফায়েল ইসরায়েল নৌবাহিনীর জন্যও আয়রন বিম ভার্সনের নেভাল প্রোটোটাইপ সামনে আনে  যা ১০০ কিলোওয়াট ক্ষমতা উৎপন্ন করতে সক্ষম। নেভাল আয়রন বিম ড্রোন ও অ্যান্টিশিপ মিসাইল ধ্বংস করতে সক্ষম। তবে নেভাল আয়রন বিম পূর্ন সার্ভিসে আসতে আরও চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে। ইসরায়েল নৌবাহিনীর রাসেফ শ্রেনীর করভেটে এই সিস্টেম ব্যবহার করা হবে। ভবিষ্যতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে ডাইরেক্ট এনার্জি ওয়েপনস শুধু ভূমিতে এবং যুদ্ধ জাহাজেই ব্যবহার করা হবেনা বরং বিভিন্ন দেশ তাদের যুদ্ধ বিমানেও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করবে। বর্তমানে ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি করছে আমেরিকা, এই ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানে ডাইরেক্ট এনার্জি ওয়েপনস ব্যবহার করা হবে। ভারত পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান আমকা তৈরি করছে, আমকা পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান হলেও তাতে ষষ্ঠ প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের মতোন  ডাইরেক্ট এনার্জি ওয়েপনস থাকবে। 

২০২২ সালে রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম এবং আমেরিকার লকহিড মার্টিন যৌথভাবে একটি লেজার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের উপর কাজ শুরু করেছে যা আয়রন বিম প্রযুক্তির আরও উন্নত ভার্সন হবে। এই নতুন লেজার ডিফেন্স সিস্টেম ৩০০ কিলোওয়াট শক্তি উৎপন্ন করতে সক্ষম হবে এবং এটি একসাথে একের অধিক টার্গেট ধ্বংস করতে সক্ষম হবে। ইসরায়েলের আয়রন বিম সিস্টেমের প্রধান সমস্যা আয়রন বিম সিস্টেম কাজ করবার জন্য পরিষ্কার আবহাওয়া দরকার, বৃষ্টির সময় ও মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়াতে এই সিস্টেম কাজ করতে পারবেনা। আয়রন বিম সিস্টেম টার্গেটকে ধ্বংস করবার আগেই বায়ুমন্ডলে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ লেজার নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া আয়রন বিম সিস্টেমকে অন্যান্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মতোন লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়, আয়রন বিমকে কাজ করবার জন্য খোলা, পরিষ্কার জায়গায় রাখা দরকার। তবে আয়রন বিম সিস্টেম ইসরায়েলের সেনাবাহিনীতে যুক্ত হলে তা যে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.