ফিচার আর্টিকেল

ফেসবুক, টুইটারের মতোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিষিদ্ধ। চীনের অদ্ভুত ব্যবস্থা ও নির্বাচন

চীন নাম শুনলেই প্রথমে যে কথাটা মাথায় আসবে তা হল ভারতের পরম শত্রু দেশ। এরপর যে কথাটা মনে হবে তা হল এমন একটি দেশ যে শুধু তার প্রতিবেশীদের সাথে বিতর্কে থাকে। চীনের সাথে আফগানিস্তান, ভুটান, ভারত, কাজাখস্তান, উত্তর কোরিয়া, কিরগিজস্তান, লাওস, মঙ্গোলিয়া, মায়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, রাশিয়া, তাজিকিস্তান এবং ভিয়েতনাম এই চোদ্দটি দেশের স্থল সীমানা রয়েছে যাদের মধ্যে পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া এবং লাওস বাদে বাকী এগারোটি দেশের সাথেই সীমানা নিয়ে সমস্যা আছে। চীনের ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন এবং তাইওয়ানের সাথে সমুদ্র সীমাও রয়েছে, এই প্রত্যেকটি দেশের সাথেই উত্তর চীন সাগর কিংবা দক্ষিন চীন সাগর সব জায়গাতেই সমুদ্র সীমা নিয়েও চীনের সাথে সমস্যা রয়েছে। এছাড়া চীনের নাম শুনলে আরও একটা কথা মাথায় আসবে তাহল ঝাঁ চকচকে শহর, মজবুত অর্থনীতির পাশপাশি চীনের জনগনের উপর সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রন। কিন্ত এসব ছাড়াও চীনের আরও একটি গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার হচ্ছে তার অনন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও নির্বাচন পদ্ধতি যা সম্পর্কে অনেকেই জানেনা। 

চীনের রাজনৈতিক পরিকাঠামো দেখে মনে হয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কিন্তু বাস্তবে চীনে কোনও একটি বিশেষ পরিবার বা কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির শাসন নেই। স্বৈরাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় যেমন কোনও নির্বাচন হয়না কিন্তু চীনের এই অদ্ভুত রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রীতিমতো নির্বাচন হয়েই দেশের রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হয়। 

১৯৪৯ সালে মাও জে দং এর চীনের কমিউনিস্ট দল বা সিসিপি পিপলস রিপাবলিক অফ চীন গঠন করে। ১৯২৭ সাল থেকে চলা চীনের গৃহযুদ্ধে জয়লাভের পর ১৯৪৯ সালে সিসিপি চীনের ক্ষমতায় আসে। কার্ল মার্ক্স এবং ভ্লাদিমির লেনিনের আদর্শকে অনুসরন করে চীন। স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকে কিংবা তার পরিবার বংশানুক্রমে ক্ষমতায় আসে। যেমন ১৯৭৯ সালে ইরানে বিদ্রোহের পর আয়াতুল্লাহ আল খামেনি ২০২২ অবধি ইরানের ক্ষমতায় ছিল, এছাড়া উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন তার বংশানুক্রমে উত্তর কোরিয়ার শাসক হয়েছে। কিন্তু চীনের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম, চীনে কোনও একটি নির্দিষ্ট পরিবার বা ব্যক্তি ক্ষমতায় নেই বরং চীনে একটি মাত্র রাজনৈতিক দল চাইনিজ কমিউনিস্ট দল চীনের ক্ষমতায় রয়েছে। এই কমিউনিস্ট দলের ভিতরেও নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর নির্বাচন হয় যাতে কোনও একজন ব্যক্তি দীর্ঘদিন ক্ষমতায় না থাকতে পারে। চীনের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মাও জেদং ও ডেং জিওপিংই চীনের কমিউনিস্ট দলের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশী সময় ক্ষমতায় ছিল। চীনের বর্তমান রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংও দীর্ঘদিন চীনের ক্ষমতায় রয়েছে। এছাড়া চীনের প্রশাসনিক ব্যবস্থার আরও পদে নিয়োগও নির্বাচনের মাধ্যমেই হয়। যেকোনও গনতান্ত্রিক দেশে একাধিক রাজনৈতিক দল থাকে। যেমন ভারতে বহু রাজনৈতিক দল রয়েছে, আমেরিকাতে রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দুই দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু চীনের রাজনীতিতে সিসিপিই একমাত্র দল যাদের হাতে পূর্ন ক্ষমতা রয়েছে। চীনের সেনাবাহিনীকেও নিয়ন্ত্রন করে এই সিসিপি। 

চীনে আরও আটটি দল রয়েছে তবে এরা সিসিপির সাথে যুক্ত, এদের কাজ সিসিপিকে সহায়তা করা, এদের সরকার বিরোধী হওয়ার অধিকার নেই। চীনে বিভিন্ন সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না মার্কিস্ট- লেনিনিস্ট,  কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়না ওয়ার্কারস এন্ড পিসান্টস, ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ চায়না নামে একাধিক দল নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল কিন্তু সিসিপি সব দলকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। চীনের সিসিপি দলের গঠন প্রনালী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের থেকে আলাদা। চীনের সিসিপির প্রধান ক্ষমতা জেনারেল সেক্রেটারির হাতে থাকে,  সিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনের মাধ্যমে জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত করে। সিসিপির জেনারেল সেক্রেটারিই দেশটির রাষ্ট্রপতি হয়। 

বর্তমানে চীনের সিসিপির জেনারেল সেক্রেটারি শি জিনপিং। এরপর সিসিপির সবচেয়ে শক্তিশালী কমিটি হচ্ছে পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটি যাতে সাত থেকে নয় জন সদস্য থাকে। চীনের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন পদ এই কমিটির সদস্যরাই পায়, শি জিনপিংও এই কমিটির সদস্য। এরপর আসে সিসিপির পলিটব্যুরো যাতে পঁচিশ জন সদস্য রয়েছে। বিশ্বের সমস্ত কমিউনিস্ট দলেই পলিটব্যুরো রয়েছে কিন্ত স্ট্যান্ডিং কমিটি একমাত্র চীনের সিসিপিতেই রয়েছে। পলিটব্যুরোর পর সিসিপিতে রয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি যাতে তিনশো সদস্য রয়েছে। সিসিপির একদম নীচের তলায় রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাশনাল কংগ্রেস যাতে ২,৩০০ সদস্য রয়েছে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাশনাল কংগ্রেস কেন্দ্রীয় কমিটির ৩০০ জন সদস্যকে নির্বাচন করে এবং এই কেন্দ্রীয় কমিটিই পলিটব্যুরো, স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত করে। ভারতে যেমন সংসদ ভবনে সমস্ত আলোচনা হয়, বিল পাশ হয় তেমন চীনে রয়েছে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস বা এনপিসি। এনপিসিতে ২,৯২৪ সদস্য রয়েছে যা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী সদস্য বিশিষ্ট সংসদ। তবে ভারতের সংসদ ভবনে বছরে তিনটি অধিবেশন হয় কিন্ত চীনের এনপিসিতে বছরে মাত্র একটি অধিবেশন হয়। ভারতে যেমন বিচার বিভাগ রয়েছে চীনে এমন কিছু সিস্টেম নেই, চীনে এনপিসি এবং এনপিসির স্ট্যান্ডিং কমিটি বা এনপিএসসি সমস্ত বিচার ব্যবস্থার দায়িত্বে রয়েছে, এনপিসিই চীনে আইন, সংবিধান তৈরি করে। এই এনপিএসসিতে ১৭৫ জন সদস্য রয়েছে। কিন্ত এনপিসির পূর্ন নিয়ন্ত্রনও রয়েছে চীনের কমিউনিস্ট দলের হাতেই। চীনে রাষ্ট্রপতির হাতেই সমস্ত ক্ষমতা রয়েছে। এনপিসির হাতে ক্ষমতা রয়েছে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করার কিন্তু ১৯৯২ সালে চীনে নতুন আইন তৈরি করা হয় যাতে এনপিসির হাত থেকে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাচ্যুত করার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়। চীনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করে, চীনে প্রধানমন্ত্রীকে প্রিমিয়ার বলা হয়। তবে চীনের প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র চীনের প্রশাসনিক ব্যবস্থার প্রধান হয় পূর্ন ক্ষমতা থাকে রাষ্ট্রপতির হাতে। প্রধানমন্ত্রীও সিসিপির স্ট্যান্ডিং কমিটিরই সদস্য হয়। বর্তমানে লি কেকিয়াং চীনের প্রিমিয়ার। চীনের সহকারী রাষ্ট্রপতির হাতেও তেমন কোনও ক্ষমতা নেই, সহকারী রাষ্ট্রপতি শুধু রাষ্ট্রপতিকে সাহায্য করে। ভারতে যেমন মন্ত্রীপরিষদ রয়েছে চীনে রয়েছে সেন্ট্রাল পিপলস গভমেন্ট যার প্রধান হচ্ছে প্রিমিয়ার। চীনে আরও একটি রাজনৈতিক পদ রয়েছে যাকে বলা হয় সুপ্রিম লিডার বা সর্বোচ্চ নেতা। 

সিসিপির জেনারেল সেক্রেটারি ও জেনারেল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান এই সুপ্রিম লিডার হতে পারে। তবে বর্তমানে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংই সুপ্রিম লিডার। চীনের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডেং জিওপিং এর সময় সুপ্রিম লিডার পদ খুব শক্তিশালী পদ হিসাবে গন্য করা হত। মাও জেদং চীনে সিসিপির রাষ্ট্রপতি, জেনারল মিলিটারি কমিশনের চেয়ারম্যান ও চীনের সেনাবাহিনীর প্রধানের পদ একাই নিয়ন্ত্রন করতো। 

১৯৮০ সালে চীনে একটি নিয়ম করা হয় যাতে চীনের রাষ্ট্রপতি, প্রিমিয়ার ও সিসিপির জেনারেল সেক্রেটারি আলাদা আলাদা ব্যক্তি হবে। কিন্তু ডেং জিওপিং এর পর যারাই রাষ্ট্রপতি হয় তারা সিসিপির জেনারেল সেক্রেটারি পদও নিয়ন্ত্রন শুরু করে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মতো চীনে রয়েছে সুপ্রিম পিপলস কোর্ট যাতে ৩৪০ জন বিচারপতি রয়েছে। কিন্তু চীনের সুপ্রিম পিপলস কোর্টেরও ক্ষমতা নেই চীনের সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলার। অর্থাৎ চীনের কমিউনিস্ট পার্টি দেশের সমাজব্যবস্থা, সামরিক বাহিনী ও মিডিয়া সব কিছু নিয়ন্ত্রন করে। 

১৯৫৪ সালে চীনে প্রথম সংবিধান তৈরি করা হয়, ১৯৮২ সালে চীনে চতুর্থ সংবিধান গ্রহন করা হয় যা আজও চলছে। চীনের প্রশাসনিক ব্যবস্থা পাঁচটি স্তরে বিভক্ত প্রাদেশিক সরকার, প্রিফেকচার সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার, পৌরসভার সরকার ও গ্রাম্য সরকার। ইকোনোমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট বা ইআইইউ এর তথ্য অনুযায়ী গনতন্ত্র সূচকের বিচারে চীন পৃথিবীর সবচেয়ে কম গনতান্ত্রিক মান বিশিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে একটি। চীন নিজেকে সমাজতান্ত্রিক গনতান্ত্রিক দেশ হিসাবে ঘোষনা করলেও গোটা বিশ্ব জানে এটা সত্যি নয় কারন চীনে শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দলেরই প্রভাব রয়েছে, চীনে সরকার বিরোধী কোন দলই নেই। চীনে বাক স্বাধীনতাও কম, ফেসবুক, টুইটারের মতোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও চীনে নিষিদ্ধ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.