পাকিস্তানে একাধিক জঙ্গির মৃত্যুর পেছনে কাদের হাত? ভারতের প্রতিরক্ষায় র এর ভূমিকা ও র কে কেন দরকার ভারতের?
ভূরাজনীতিতে কোন দেশের প্রভাব বিস্তারে দেশটির ইনটেলিজেন্স সংস্থার একটি বড় ভূমিকা থাকে। সম্প্রতি আমেরিকা জানিয়েছে তাদের ইনটেলিজেন্স সংস্থা খবর পেয়েছে গুরপতওয়ার সিং পান্নুকে আমেরিকাতে হত্যা করবার চেষ্টা করছে ভারতীয় ইনটেলিজেন্স সংস্থা র। যদিও আমেরিকা তার এই অভিযোগের সাপেক্ষে কোনও প্রমান দেখাতে পারেনি। কিছুদিন আগে কানাডাও ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে ১৮ জুন তাদের নাগরিক নিজ্জরকে গুরু নানক শিখ গুরুদোয়ারার সামনে হত্যা করার পেছনে র রয়েছে, যার কারনে কানাডা ও ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক অবনতি হয়েছে। হারদীপ সিং নিজ্জর খালিস্তানি সংগঠনের নেতা ছিল এবং ভারত বিরোধী কার্যকলাপে যুক্ত ছিল। গত একবছরে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে যাতে পাকিস্তানে ও ইংল্যান্ডে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের শত্রুতা করা বেশ কিছু ব্যক্তির হঠাৎ মৃত্যু হয়। যেমন ২০২২ সালেও করাচিতে এক অজানা ব্যক্তি জাহুর মিস্ত্রিকে গুলি করে হত্যা করে। জাহুর মিস্ত্রি ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু থেকে ভারতীয় বিমান আইসি ৮১৪ এর হাইজ্যাকিংএ যুক্ত ছিল। ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়াতে বোম্বিংএ অভিযুক্ত রীপুদমন সিং মালিককে ইউকে গতবছর অজানা ব্যক্তি হত্যা করে। ২০২১ সালে পাঞ্জাবের মোহালিতে পুলিশের মুখ্য কার্যালয়ে আরপিজি আক্রমন করা হারবিন্দর সিং সান্ধু পাকিস্তানের এক হসপিটালে অতিরিক্ত মাত্রায় মাদক সেবনের কারনে মারা যায় সম্প্রতি। পাকিস্তানের সন্ত্রাসী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদ্দীনের কম্যান্ডার বাসির আহমেদ পীরকে রাওয়ালপিন্ডিতে গত ২০ ফেব্রুয়ারী অজানা ব্যক্তি হত্যা করে। পাকিস্তানের আরও এক সন্ত্রাসী সংগঠন সৈয়দ খালিদ রাজাকে করাচিতে তার ঘরেই গত ২৭ ফেব্রুয়ারী অজানা ব্যক্তি হত্যা করে। এরকম আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে গত একবছরে। তবে এসব কোনও ঘটনার সাথেই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র এর জড়িত থাকার কোনও প্রমান পাওয়া যায়নি সুতরাং সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা সম্ভব নয়।
ভারতের যেন র রয়েছে, ঠিক তেমনি প্রত্যেক সামরিক শক্তিশালী দেশেরই নিজস্ব ইনটেলিজেন্স সংস্থা রয়েছে যারা নিজ দেশের শত্রুদের গোপনে শেষ করার জন্য নিরলস কাজ করে চলেছে। এই তালিকায় প্রথমেই রয়েছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং আমেরিকার সিআইএ।
১৯৬৮ সালে র বা রিসার্চ এন্ড অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং তৈরি করা হয়। র এর প্রথম প্রধান হন আর এন কাও যাকে ভারতের স্পাই মাস্টার বলা হয়। ১৯৬২ তে ভারত চীন যুদ্ধের পর থেকেই র এর মতোন সংগঠন তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয়। কারন ভারত সরকার বুঝে যায় এমন একটি সংগঠন দরকার যাতে কোনও দেশ ভারতে আক্রমন করার আগেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পর্যাপ্ত তথ্য চলে আসে এবং ভারত প্রস্তুত থাকতে পারে। র প্রথমে তৈরি করা হয়েছিল পাকিস্তান ও চীনের উপর নজর রাখবার জন্য। বলা হয় র কে একটা সময় সিআইএও সাহায্য করেছিল। এছাড়া যেহেতু ইসরায়েল ভারতের সবচেয়ে ভালো বন্ধু তাই মোসাদের থেকেও সহায়তা পায় র।
১৯৭১ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর বাংলাদেশ গঠনের পেছনেও র এর গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রয়েছে। চীন ও পাকিস্তানের দিকে নজর রাখার জন্য র কে তৈরি করা হলেও সময়ের সাথে বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তন হয়, যার ফলে র এর দায়িত্বও বেড়ে যায়। পাকিস্তান ভারতের কাছে যুদ্ধে বারংবার পরাজিত হওয়ার পর ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ শুরু করে। একের পর এক সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করে ভারতে বিভিন্ন সময়ে নাশকতার অশুভ চেষ্টা শুরু করে পাকিস্তান এবং চীন পাকিস্তানকে অর্থ ও অস্ত্র সহায়তা করতে থাকে। এরকম অবস্থায় র এর কাজের পরিধি বেড়ে যায়, আজ র এর জন্যই পাকিস্তান ভারতে বড় কোনও নাশকতা করতে পারেনি। ইনটেলিজেন্স সংস্থার কাজ শুধু শত্রু দেশের উপর নজর রাখাই নয় বরং বন্ধু দেশের উপরেও দৃষ্টি রাখা কারন বিশ্বরাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব বা চিরস্থায়ী শত্রুতা বলে কিছু হয়না। যেমন ভারতের সবচেয়ে ভালো বন্ধু দেশগুলো যেমন ফ্রান্স ও রাশিয়ার দিকেও নজর রাখা প্রয়োজন কারন রাশিয়া, ফ্রান্স থেকে ভারত যেমন বিলিয়ন ডলারের সমরাস্ত্র কেনে ঠিক তেমনি এই দেশগুলো পাকিস্তান ও চীনকেও প্রযুক্তি ও অস্ত্র বিক্রি করে। সুতরাং ভূরাজনীতির ক্ষেত্রে শত্রু ও বন্ধু সবার উপর নজর রাখা প্রয়োজন যারকারনে র এর মতোন শক্তিশালী সংগঠনের খুবই প্রয়োজন ভারতের।
২০১৫- ১৭ এর দিকে ভারতে আইএসআইএস সন্ত্রাসী সংগঠনের নাশকতার পরিকল্পনাও ভেস্তে দেয় র। ভারতের প্রথম পরমানু পরীক্ষন অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধা বা পোখারান ১ এর সময়ে সিআইএ এবং ব্রিটেনের ইনটেলিজেন্স সংস্থা এমআইসিক্সকে কিছু টের পেতেও দেয়নি র। র এর গঠন আমেরিকার সিআইএর মতোনই। র কোনও গুরুত্বপূর্ন অপারেশন করবার আগে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নেয়, র এর সেক্রেটারির সাথে সরাসরি যোগাযোগ থাকে এনএসএ বা ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজারের। র এর সেক্রেটারিকে র এর প্রধান বলা হয়।
র এর প্রধান নিযুক্ত করা হয় সাধারনত এমন ব্যক্তিকে যে পাকিস্তান বা চীন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ। বিভিন্ন সময়ে আমেরিকা, ব্রিটেন, ভারত ও ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থার সদস্যরা একসাথেই প্রশিক্ষন করে কারন কুটনৈতিক স্তরে প্রত্যেকটি ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক একে অপরের সাথে যুক্ত। যেমন আমেরিকার কোনও শত্রু পাকিস্তানে বা আফগানিস্তানে আত্মগোপন করে থাকলে তার সম্পর্কে তথ্য র সিআইএকে দিতে পারবে ঠিক তেমনই সিআইএও তার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে র কে জরুরী তথ্য দেয়। এভাবেই সিআইএ র কে ভারতে আইএসআইএসের সম্ভাব্য আক্রমনের পরিকল্পনা জানিয়েছিল, এক্ষেত্রে সিআইএ তাদের মধ্যপ্রাচ্যের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেছিল। বিদেশী শত্রুদের থেকে ভারতকে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি ভারতের মধ্যে লুকিয়ে পাকিস্তান ইনটেলিজেন্স সংস্থা আইএসআই এর এজেন্টদেরও খুঁজে বের করে র।
১৯৬৮ সালে তৈরি হওয়ার পর থেকে একাধিক গুরুত্বপূর্ন মিশনে কাজ করেছে র। বিশেষ করে ১৯৮০ এর দশকে খালিস্তানি সংগঠনের কারনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ। পাঞ্জাবে পাকিস্তান মদতপুষ্ট খালিস্তানিদের প্রতিরোধে র সেইসময় একটি গোপন মিশন শুরু করে। র দুটি দল তৈরি করে যার নাম দেওয়া হয় সিআইটি এক্স এবং সিআইটি জে। ১৯৪৭ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান তৈরি হবার সময় পাঞ্জাব প্রদেশের একটি বড় অংশ চলে যায় পাকিস্তানে। এই পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশকে আলাদা করবার জন্য আইএসআই ১৯৮০ এর দশকে ভারতীয় পাঞ্জাব প্রদেশে খালিস্তানি গতিবিধিকে সমর্থন করা শুরু করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে পূ্র্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যে বাংলাদেশ গঠন হয়েছিল পাকিস্তান তার প্রতিশোধ নিতে চাইছিলো ভারতের উপর কিন্তু বাংলাদেশ গঠনের পটভূমি পাকিস্তান নিজেই রচনা করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে রীতিমতো অত্যাচার শুরু করেছিল যার কারনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন হয়। পাকিস্তান তাই ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশকে কৃত্রিম ভাবে অশান্ত করতে চেষ্টা করেছিল। র এর দুটি দলের মধ্যে সিআইটি এক্সের দায়িত্ব ছিল পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রন করা বিশেষ করে আইএসআইকে প্রতিরোধ করা এবং সিআইটি জে দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় খালিস্তানিদের প্রতিরোধ করার। র এর এই অপারেশনে পুরো পাঞ্জাব প্রদেশ শান্ত হয়ে যায় এবং ব্যার্থ হয় আইএসআই। পাকিস্তান গোপনীয় ভাবে পরমানু বোম্ব তৈরি করছিলো তা র এর এজেন্টরাই খুঁজে বের করে। র এর এজেন্টরা কাহুটাতে পাকিস্তানের গোপন পরমানু কেন্দ্রের কাছে পাকিস্তানি বিজ্ঞানীরা যেখানে চুল কাটতে যেত সেখান থেকে চুলের নমুনা নিয়ে তা পরীক্ষা করে যাতে অতিরিক্ত প্লুটোনিয়ামের নমুনা পাওয়া যায়। যা দেখে র নিশ্চিত হয় পাকিস্তান গোপনে পরমানু বোম্ব তৈরি করছে। অপারেশন চানক্যের মাধ্যমে কাশ্মীর উপত্যকাতে আইএসআই এর নেটওয়ার্ক ভেঙে দেয় র। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একটি মজবুত স্তম্ভ হচ্ছে র। তবে র এর বাজেটকে সম্পূর্ন গোপনীয় রাখা হয়েছে। র এর মতোই আমেরিকার সিআইএ, ইসরায়েলের মোসাদ, ব্রিটেনের এমআইসিক্স, চীনের এমএসএস বিভিন্ন দেশে অপারেশন চালায়।
জাতিসংঘের ৫১ তম আইনে বলাই হয়েছে কোন দেশ আত্মরক্ষার জন্য তার বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেই পারে। সিআইএ কোরিয়ার যুদ্ধের সময় দক্ষিন কোরিয়াতে যেমন গেরিলা যোদ্ধা তৈরি করেছিল ঠিক তেমনই ভারতও ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি যোদ্ধাদের গোরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষন দিয়েছিল। ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনী, ভারতীয় বায়ুসেনা এবং ভারতীয় নৌসেনা এই তিন বাহিনী যতটা গুরুত্বপূর্ন ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ন র এর ভূমিকা। যেকোনও যুদ্ধে ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্কেরই সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকে। র নিঃশব্দে ভারতের সুরক্ষায় এতটাই সাবলীল গতিতে কাজ করে চলেছে যার অধিকাংশ সম্পর্কে হয়ত কেউ জানবেওনা কোনওদিন। বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ হিসাবে ভারতের জন্য র এর সংগঠন খুবই প্রয়োজনীয়।