ফিচার আর্টিকেল

খুঁজে খুঁজে হত্যা করেছিল বিজ্ঞানীদের। মোসাদ যেভাবে ইরানের মিসাইল প্রজেক্টকে ধ্বংস করেছিল

২১ জুলাই, ১৯৬২ সালের সকাল, মিশর ইসরায়েলের উদ্দেশ্যে দুটি সারফেস টু সারফেস মিসাইল আল জাফর ও আল কাহের ফায়ার করে। পরেরদিন মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল আব্দেল নাসের সাংবাদিক সম্মেলনে জানায় এই মিসাইল নির্মান করাই হয়েছে আরব বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য। মিশর ইসরায়েলে রেডিও মাধ্যমে হুমকী দেয় খুব শীঘ্রই আরও মিসাইল আক্রমনের। এরপরেই ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসদের প্রধান আইজার হ্যারেল মোসাদ এজেন্টদের কাজে লাগিয়ে দেয় মিশরের মিসাইল প্রজেক্ট সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্য। মোসাদ অনুসন্ধান করে জানতে পারে মিশরের মিসাইল প্রজেক্টের পেছনে রয়েছে জর্মান বিজ্ঞানীরা৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদি গনহত্যা বা হলোকাস্টের সাথে জড়িত বেশ কিছু নাজি বিজ্ঞানীই মিশরের মিসাইল প্রোজেক্টে সহায়তা করছিল। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গ্যুরোন আইজার হ্যারলকে নির্দেশ দেয় যেভাবেই হোক মিশরের মিসাইল প্রজেক্ট বন্ধ করতে হবে।

ইসরায়েলের রাজধানী তেল আভিবে অবস্থিত মোসাদের প্রধান কার্যালয় থেকে ইউরোপে মোসাদের দপ্তরে খবর পাঠানো হয় মিশরের মিসাইল প্রজেক্টে যুক্ত জার্মান বিজ্ঞানীদের নাম খুঁজে বার করতে এবং জার্মানিকে বোঝাতে যাতে তাদের বিজ্ঞানীরা মিশরকে সহায়তা না করে। মোসাদের এজেন্টরা ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশে মিশরের দূতাবাসে গোপনে অনুসন্ধান চালায়, অবশেষে সুইজারল্যান্ড থেকে মোসাদ জানতে পারে মিশরের মিসাইল প্রজেক্টের পিছনে মূলত দুজন বিজ্ঞানী রয়েছে ডাঃ ইউগেন সানগার এবং উলফগ্যাং পিলজ। এই দুজনেই ১৯৫৪ সালে জার্মানির স্টুটগার্টে জেট প্রোপালশন রিসার্চ ইন্সটিটিউটে কাজ করেছিলো একসাথে। সেখানে আরও একজন জার্মান বিজ্ঞানী হেন্স ক্রুগও মিশরের মিসাইল প্রজেক্টে যুক্ত হয় পরে। 

১৯৫৯ সালে জার্মানি মিশরকে মিসাইল তৈরির জন্য বিজ্ঞানীদের একটি দল দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল আব্দেল নাসের এই প্রস্তাবে সাথে সাথে রাজি হয়ে যায়। গামাল আব্দেল নাসের এই প্রজেক্টের দায়িত্ব দেয় মিশরের বায়ুসেনার ইনটেলিজেন্স বিভাগের প্রধান ইসাম আলদিন মহম্মদ খালিলকে। ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে জার্মান বিজ্ঞানীরা মিশর আসে এবং ১৯৬১ সালে মিশরের ৩৫ জন বিশেষ ব্যক্তিকে এই প্রজেক্টের জন্য নির্বাচন করা হয়। ১৬ আগস্ট, ১৯৬২ সালে আইজার হ্যারেল প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গ্যুরোনকে একটি গোপন ফাইল দেয়, এই ফাইল মোসাদের এজেন্টরা মিশরের ইনটেলিজেন্স বিভাগকে ফাঁকি দিয়ে সংগ্রহ করেছিল। এই ফাইলে জার্মান বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পিলজের নির্দেশ লেখা ছিল। উলফগ্যাং পিলজ ৯০০ মিসাইল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ইউরোপ থেকে মিশরে আনিয়েছিল যা দিয়ে মিশর ইসরায়েলে আক্রমন করতো। এই তথ্য পাওয়ার সাথে সাথেই ডেভিড বেন গ্যুরোন আইজার হ্যারলকে নির্দেশ দেন যেভাবেই হোক মিশরকে থামাতে হবে তাতে জার্মান বিজ্ঞানীদের হত্যা করেই হোক কিংবা অপহরন করেই হোক। আইজার হ্যারল ইউরোপে এসে পৌঁছায় মিশনের জন্য। মোসাদ প্রথম টার্গেট করে ডঃ হেন্স ক্রুগকে। জার্মানির মিউনিখে ডঃ হেন্স ক্রুগের বাড়িতে একজন মোসাদ এজেন্ট মিশরের বায়ুসেনার ইনটেলিজেন্স বিভাগের প্রধান মহম্মদ খলিলের বিশেষ লোকের পরিচয়ে দেখা করে। সেই এজেন্ট ডঃ হেন্স ক্রুগকে জানায় পরের দিনে মহম্মদ খলিল নিজে জার্মানিতে আসবে তার সাথে বৈঠকের জন্য। বৈঠকের জন্য অ্যালবাসেডর হোটেলকে ঠিক করা হয়। পরেরদিন আবারও সেই মোসাদ এজেন্ট হেন্স ক্রুগের বাড়িতে যায় সেখান থেকে হেন্স ক্রুগের নতুন মার্সেডিজ গাড়িতে তারা দুজন রওনা হয় অ্যামবাসেডর হোটেলের উদ্দেশ্যে। কিছুসময় পর তারা একটি বড় বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হয়। হেন্স ক্রুগকে জানানো হয় বৈঠকের স্থান পরিবর্তন হয়েছে। হেন্স ক্রুগ কিছু সন্দেহ না করেই সেই বাড়িতে প্রবেশ করে। সাথে সাথে ভিতরে থাকা মোসাদ এজেন্টরা গ্রেফতার করে হেন্স ক্রুগকে এবং তাকে বিশেষ ইনজেকশন প্রয়োগে অজ্ঞান করা হয়। হেন্স ক্রুগকে নিয়ে মোসাদ ফ্রান্স সীমান্তের দিকে রওনা হয় এবং সীমান্ত অতিক্রম করে ফ্রান্সের মার্সেইলিতে উপস্থিত হয়। মার্সেইলের বিমানবন্দরে ফ্রান্সের পুলিশকে নকল পাসপোর্ট ও নকল মেডিক্যাল রিপোর্ট দেখিয়ে বিমানে করে ইসরায়েল নিয়ে আসা হয় হেন্স ক্রুগকে। অন্যদিকে মোসাদ হেন্স ক্রুগের ছদ্মবেশ ধারন করিয়ে এক ব্যক্তিকে হেন্স ক্রুগের পাসপোর্ট নিয়ে তাকে দক্ষিন আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়। মোসাদ এটা করে যাতে পরে যখন মিশরের ইনটেলিজেন্স সংস্থা হেন্স ক্রুগকে খুঁজতে আসবে তখন তারা যাতে ভাবে হেন্স ক্রুগ মিশরের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে তাদের ধোঁকা দিয়ে দক্ষিন আমেরিকা পালিয়ে গেছে। ইসরায়েলে পৌঁছেই হেন্স ক্রুগকে জেলে ভরে দিয়ে বিশেষ জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে মোসাদ। হেন্স ক্রুগ বাধ্য হয় মিশরের মিসাইল প্রজেক্ট সম্পর্কে সমস্ত তথ্য মোসাদকে জানিয়ে দিতে। মিশরের মিসাইল প্রজেক্টে কতজন বিজ্ঞানী কাজ করে, তাদের নাম সমস্ত তথ্য চলে আসে মোসাদের হাতে। হেন্স ক্রুগ মোসাদকে প্রস্তাব দেয় সে তাদের হয়ে কাজ করবে এবং মিশরের মিসাইল প্রজেক্ট ধ্বংস করতে সহায়তা করবে। কিন্তু মোসাদ জানতো যদি হেন্স ক্রুগ একবার জার্মানি চলে যায় তাহলে সে সব কথা মিশরকে জানিয়ে দেবে। তাই মোসাদ হেন্স ক্রুগকে হত্যা করে তার মৃতদেহ সমুদ্রে ফেলে দেয়। 

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গ্যুরোন ইসরায়েলের মিলিটারি ইনটেলিজেন্স সংস্থা আমানকে দায়িত্ব দেয় জার্মান বিজ্ঞানীদের হত্যা করার। কিন্তু আইজার হ্যারেল ডেভিড বেন গ্যুরোনকে জানায় এই কাজ মোসাদই করতে পারবে। কিন্ত ডেভিড বেন গ্যুরোন মোসাদ ও আমান দুজনকেই দায়িত্ব দেয় এই অপারেশনের। আমান ও মোসদদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় কে আগে এই অপারেশন শেষ করতে পারবে। আমান এই অপারেশনের জন্য তাদের একটি বিশেষ দল আমান ১৮৮ তৈরি করে। আমান মিশরের কায়রোতে তাদের এক এজেন্টকে কাজে লাগায়। ওই এজেন্ট এক জার্মান নাজি সেনার ছেলে ছিল কিন্তু কাজ করতো ইসরায়েলের হয়ে। ওই এজেন্টকে দেখতে পুরো জার্মানদের মতো ছিল যার জন্য আমান তাকেই নিয়োগ করে এই মিশনের জন্য। ওই এজেন্ট আমানকে মিশরের মিসাইল প্রজেক্টে যুক্ত থাকা অনেক ব্যক্তির নাম পাঠায় যাদের একে একে হত্যার পরিকল্পনা শুরু করে আমান। এই মিশনের জন্য আমান লেটার বোম্ব ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্ত আমানের কাছে সেসময় লেটার বোম্ব ছিলনা। আমানকে লেটার বোম্ব সরবরাহ করে ফ্রেঞ্চ ইনটেলিজেন্স সংস্থা। তবে তার বদলে আমান মিশরে থাকা আলজেরীয়ান বিদ্রোহীদের খবর ফ্রান্সকে দিয়েছিল। 

আলজেরিয়া সেসময় ফ্রান্সের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছিলো এবং বিদ্রোহের প্রধান নেতারা মিশরে ছিল। তাই ফ্রান্সের মিশরে থাকা আলজেরিয়ান বিদ্রোহী নেতাদের তথ্য দরকার ছিল। আমানের প্রথম লক্ষ্য হয় অ্যালোয়িস ব্রুনার যে একজন নাজি ছিল। ব্রুনার হিটলারের ইহুদি গনহত্যা বা হলোকাস্টে প্রধান সহযোগী অ্যাডলফ আইখম্যানের সহযোগী ছিল। ফ্রান্সে হিটলারের কনসেনট্রেশান ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিল এই ব্রুনার যেখানে প্রায় এক লাখ ত্রিশ হাজার ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রুনার সিরিয়া পালিয়ে গিয়েছিল সেখানে সিরিয়ার ইনটেলিজেন্স সংস্থার হয়ে কাজ করছিলো সে। সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাসে ডাকের মাধ্যমে ব্রুনারের ঠিকানায় একটি লেটার বোম্ব পাঠায় আমান। চিঠি খুলতেই তীব্র বিস্ফোরন হয় যাতে ব্রুনারের চোখ, ও কিছু আঙুল নষ্ট হয়ে যায় এবং মুখের অনেকাংশ পুড়ে যায় কিন্তু প্রানে বেঁচে যায় ব্রুনার। এরপর মোসাদ লেটার বোম্ব পাঠায় জার্মানির বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পিলজকে যে মিশরের মিসাইল প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান সহায়ক ছিল। কিন্তু পিলজের বদলে এই চিঠি তার সেক্রেটারি খোলায় বিস্ফোরনের নিশানা হয় তার সেক্রেটারি কিন্তু সেক্রেটারিও এবারেও প্রানে বেঁচে যায় তবে তার চোখ এবং পায়ের  বেশ কিছু আঙুল নষ্ট হয়ে যায়। এসব ঘটনার পর মিশরের ইনটেলিজেন্স বিভাগ জার্মান বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেয় এবং এক জার্মান অফিসার হারম্যান অ্যাডলফকে নিয়োগ করে। হারম্যান অ্যাডলফ প্রথমেই নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করে। মোসাদ তাদের পরবর্তী নিশানা করে জার্মান বিজ্ঞানী হ্যান্সি ক্লেনওয়াচারকে। 

হ্যান্সি সেসময় সুইজারল্যান্ডে থাকতো এবং তার ল্যাবেই মিশরের মিসাইলের উপর কাজ হত যার কারনে তাকে হত্যা করবার জন্য সুইজারল্যান্ডে তিনজন মোসাদ এজেন্টকে পাঠানো হয়। সুইজারল্যান্ডের বাসেল শহরে থাকতো হ্যান্সি ক্লেনওয়াচার। মোসাদ এজেন্টরা বেশ কয়েকদিন ধরে হ্যান্সি ক্লেনওয়াচারের গতিবিধির উপর নজর রাখে। মোসাদ দেখতে পায় প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় একা ঘুরতে বেরোয় হ্যান্সি, এইসময়কেই অপারেশনের জন্য বেছে নেয় মোসাদ। 

১৯৬৩ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে হ্যান্সি ক্লেনওয়াচারকে হত্যার চেষ্টা করে মোসাদ কিন্তু কোনওরকমে বেঁচে যায় সে। এরপর মোসাদের আরও বেশ কিছু অপারেশন ব্যার্থ হয় যার কারনে ১৯৬৩ সালের ২৫ মার্চ মোসাদের প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় আইসার হ্যারেলকে এবং মোসাদের নতুন প্রধান করা হয় আমানের প্রধান মীর আমিটকে। ইসরায়েলের ইতিহাসে মীর আমিট একমাত্র ব্যক্তি যে একসাথে মোসাদ এবং আমানের দায়িত্ব নিয়েছিল। মীর আমিটের একের পর এক অপারেশনে ইরানের মিসাইল প্রজেক্ট পুরো ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল, যার কারনে আজও ইরান সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সাহস করেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.