ভবিষ্যতে কার্বনমুক্ত ভারত গঠনের গুরুত্বপূর্ন ধাপ ঢোলেরা সোলার পার্ক
সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুজরাট ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদক রাজ্য। গুজরাটে বর্তমানে ১৯,৪১৪.৮ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন হয় যারমধ্যে সৌর বিদ্যুৎ থেকেই ১০,১৩৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। গুজরাট সরকারের লক্ষ্য ২০২৫ এর মধ্যে ৩৮,৪৬৬ মেগাওয়াট এবং ২০৩০ এর মধ্যে ৬৮,০০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন করা গুজরাটে। সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে গুজরাট সম্প্রতি কর্নাটককে ছাড়িয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সৌর বিদ্যুৎ
উৎপাদনকারী রাজ্যে পরিনত হয়েছে। গুজরাট ভারতের মোট সৌর ক্ষমতার ১৩ শতাংশ উৎপাদন করে। পাটান জেলার চারঙ্কা সোলার পার্ককে গুজরাটের একক সর্ববৃহৎ সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বলা হয় যা এখন ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। গুজরাট সরকার কচ্ছ জেলায় এক লাখ হেক্টর জায়গাতে ৩০,০০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করতে চলেছে যেখানে বায়ুশক্তি থেকে এবং সৌরশক্তি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ২০২৩ সালে গুজরাট সরকার নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন নীতি ঘোষনা করো যাগে ২০৩০ এর মধ্যে গুজরাটে ১০০ গিগা ওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এজন্য গুজরাটে একাধিক প্রজেক্ট শুরু করা হয়েছে যার মধ্যে অন্যতম ঢোলেরা সোলার পার্ক।
আহমেদাবাদ শহর থেকে আশি কিলোমিটার দূরে ঢোলেরা স্মার্ট শহর তৈরির পাশাপাশি বিশ্বের অন্যতম বড় সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে যা ৫,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। ২০০৯ সালে ঘোষনা করা হয় ঢোলেরা গ্রীনফিল্ড স্মার্ট শহর তৈরির কথা, এরই অংশ এই ঢোলেরা সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। কোনও জায়গায় যখন আগে থেকেই পরিকাঠামো নির্মান থাকে, পরে সেই জায়গার যখন পুনর্গঠন করা হয় তাকে ব্রাউনফিল্ড প্রজেক্ট বলে। কিন্তু যখন নতুন কোনও স্থানে প্রথম থেকে নতুন শহর বা পরিকাঠামো নির্মান করা হয় তাকে গ্রীনফিল্ড প্রজেক্ট বলে। ঢোলেরাতেও একদম নতুন শহর নির্মান করা হচ্ছে যার জন্য ঢোলেরাকে গ্রিনফিল্ড প্রজেক্ট বলা হচ্ছে।
২০১৪ সালেই ভারত সরকার সোলার পার্ক উন্নয়ন প্রকল্পে গুজরাটে ১৪,৩৭৫ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছিল। গুজরাটে অনুমোদন পাওয়া ফটোভোল্টিক ক্ষমতার বিচারে ঢোলেরা সোলার পার্ক প্রথম পর্যায়ে ১,০০০ মেগাওয়াট, ঢোলেরা সোলার পার্ক দ্বিতীয় পর্যায়ে ৪,০০০ মেগাওয়াট, জিআইপওসিএল আরই পার্ক ৬০০ মেগাওয়াট, জিএসইসিএল আরই পার্ক ৩,৩২৫ মেগাওয়াট, এনটিপিসি আরই পার্ক ৪,৭৬০ মেগাওয়াট এবং রাধনেসাদা সোলার পার্ক ৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতা উৎপন্ন করতে সক্ষম।
ভারতে পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য অন্যতম বড় প্রজেক্ট এই ঢোলেরা সোলার পার্ক। নতুন নবায়নযোগ্য শক্তি মন্ত্রক ২০১৮ সালের মে মাসে ঢোলেরা সোলার পার্ক প্রজেক্ট শুরু করবার অনুমোদন দেয়, তবে এই প্রজেক্টের প্রথম পর্যায় শুরু করবার অনুমোদন পাওয়া যায় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারী মসে। ভারত সরকার ২০২২ সালের মধ্যে ভারতে ১৭৫ গিগাওয়াট অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদন করবার লক্ষ্য নিয়েছিল, ঢোলেরা সোলার পার্ক ভারত সরকারের এই কর্মসূচির গুরুত্বপূর্ন ভাগ।
গুজরাট সরকার এই সোলার পার্ক নির্মানের জন্য খাম্বাত উপসাগরের নিকটবর্তী অঞ্চলে ১১,০০০ হেক্টর জমি দিয়েছে, এই অঞ্চলের জমি সোলার পার্ক নির্মানের জন্য একদম আদর্শ। আমেদাবাদ থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঢোলেরা গ্রামে এই পাঁচ গিগাওয়াটের সোলার পার্ক প্রজেক্ট দুই দফায় তৈরি করা হবে। গুজরাট উর্জা নিগম লিমিটেড বা জিইউভিএন পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ লিমিটেড বা পিপিপি মডেলে এই প্রজেক্ট তৈরি করছে। জিইউভিএন ছাড়া আরও পাঁচটি সংস্থা গুজরাট পাওয়ার কর্পোরেশন (জিপিসিএল), গুজরাট ইলেকট্রিক ট্রান্সমিশন কর্পোরেশন (জিইটিসিও), সোলার এনার্জি কর্পোরেশন (এসইসিআই), পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া এবং সেন্ট্রাল ট্রান্সমিশন ইউনিট (সিটিইউ) এই প্রজেক্টে যুক্ত আছে। এই প্রজেক্টে মোট পাঁচ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন সোলার পার্ক তৈরি করা হবে যাতে ২৫,০০০ কোটি টাকা বা প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। এই সোলার পার্কে ১.৬ মিলিয়ন সোলার প্যানেল, ৫০০ সেন্ট্রাল ইনভার্টার এবং ২৫,০০০ কিলোমিটার লম্বা ডিসি তার ইনস্টল করা হবে। এই অঞ্চল দিয়ে পদালিও, লিলকা, উতাবলী, সুখভাদর ও কেরী এই পাঁচটি নদী গিয়েছে যা খাম্বাত উপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এই পাঁচ নদীর কারনে এই অঞ্চল কোস্টাল রেগুলেশন জোন ১ বা সিআরজেড ১ এর অন্তর্ভুক্ত। ভারতে এরকম মোট চারটি সিআরজেড অঞ্চল রয়েছে। সিআরজেড ১ পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল এলাকা, উপকূলের বাস্তুতন্ত্র বজায় রাখার জন্য এসব এলাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। নদীর নিম্ন এবং উচ্চ জোয়ার লাইনের মধ্যে এই ধরনের অঞ্চল রয়েছে। কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন দপ্তর ১৯৯১ সালে এসব এলাকায় কাজকর্ম নিয়ন্ত্রনের জন্য বিশেষ বার্তা জারি করে। সমুদ্রের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ায় এই অঞ্চলে নির্মীয়মান যে কোনও প্রজেক্টে দামী জিনিসের ব্যবহার করতে হয় যার জন্য এসব অঞ্চলে প্রজেক্টে খরচও অত্যন্ত বেড়ে যায়। ঢোলেরা সোলার পার্ক প্রজেক্ট ঢোলেরা বিশেষ বিনিয়োগ অঞ্চল বা ডিএসআইআরের অংশ যা ভারত সরকারের একটি উচ্চাকাঙ্খী প্রজেক্ট। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ডিএসআইআর ভারতের সবচেয়ে বড় উৎপাদন কেন্দ্র ও বানিজ্যিক কেন্দ্র হবে। এই প্রজেক্টের পরিকল্পনা তৈরি করেছে ব্রিটেনের বিখ্যাত কারিগরি সংস্থা হ্যালক্রো গ্রুপ এবং এল এন্ড টি পরিকাঠামো নির্মান করছে। এই ডিএসআইআর প্রজেক্ট ২০৪০ এর মধ্যে সম্পূর্ন হয়ে যাবে। এই প্রজেক্ট ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। ঢোলেরা সোলার পার্ক দুটি পর্যায়ে সম্পূর্ন করা হবে। প্রথম পর্যায়ে ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করা হবে যাতে জিপিসিএল ৬৯৫ মিলিয়ন ডলার বা পাঁচ বিলিয়ন রুপি খরচ করবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে বাকী ৪০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করবে এসইসিআই যাতে ২.৭ বিলিয়ন ডলার বা ২০ বিলিয়ন রুপিস খরচ হবে। এই প্রজেক্টে ব্যবহৃত ১১,০০০ হেক্টর জমিকে পরবর্তী ত্রিশ বছরের জন্য প্রতি হেক্টর প্রতি দশ হজার টাকার লিজে দেওয়া হয়েছে। সম্পূর্ন এলাকাকে এগারোটি ভাগে ভাগ করা হবে প্রতি ভাগে ১০০ মেগাওয়াট, ১৬০ মেগাওয়াট এবং ২০০ মেগাওয়াটের ২৭টি অংশ থাকবে। পরিবেশগত ভাবে সংবেদনশীল এলাকা হওয়ায় ফ্লোরা ও ফনার কোনওরকম ক্ষতি যাতে না হয় সেবিষয়ে বিশেষ নজর রাখা হচ্ছে এই প্রজেক্টে। প্রথম পর্যায়ে উৎপন্ন বিদ্যুৎ শক্তির দায়িত্ব থাকবে জিইটিসিওর কাছে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে উৎপন্ন বিদ্যুৎ শক্তির দায়িত্ব থাকবে ভারতের পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনের কাছে। ঢোলেরা সোলার পার্ক থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎ শক্তিকে ৪৯ কিলোমিটার লম্বা ৩৩ কিলোওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এক্সএলপিই তার দিয়ে সাবস্টেশনে নিয়ে যাওয়া হবে। বিদ্যুৎ পরিবাহী পোলগুলোকে এমন ভাবে তৈরি করা হবে যাতে ১৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিবেগে বাতাসেও এগুলোর কোনও ক্ষতি না হয়। ঢোলেরা সোলার পার্কে পলি ক্রিস্টেলাইন সিলিকন প্রযুক্তি যুক্ত ফটোভল্টিক কোষ ব্যবহার করা হবে। সর্বাধুনিক এই কোষ অত্যন্ত খারাপ আবহাওয়াতেও কাজ করবে। এই কোষে বিশেষ সিলিকন রাবার যুক্ত থাকবে যাতে বন্যাতেও কোনও ক্ষতি হবেনা। এই সোলার পার্ককে কেন্দ্র করে সড়ক ব্যবস্থা, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, সংযোগ ব্যবস্থাতেও বিশেষ নজর দেওয়া হবে। নর্মদা নদী থেকে বিশেষ পাইপলাইনের মাধ্যমে জল এখানে পাঠানো হবে, তাছাড়া মাটির নীচে পাম্প, রিজার্ভার তৈরি করা হবে। ঢোলেরা সোলার পার্ক নির্মান ভবিষ্যতে কার্বন মুক্ত ভারত গঠনে ভারত সরকার ও গুজরাট সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ন পদক্ষেপ।