আর্যরা কী প্রকৃতই ভারতবর্ষ আক্রমন করেছিল!! নাকী এটা ব্রিটিশদের অপপ্রচার!
সম্প্রতি হরপ্পা সভ্যতার স্থান হরিয়ানার রাখীগড়ী থেকে প্রাপ্ত জেনেটিক প্রমান থেকে জানা গেছে হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা ভারতের আদি বাসিন্দা ছিল যারা ধীরে ধীরে একটি শহরকেন্দ্রিক সভ্যতা তৈরি করেছিল। আজ থেকে প্রায় ৪,৬০০ বছর আগে হরপ্পা সভ্যতার রাখীগড়ী নামক স্থানে থাকা এক মহিলার ডিএনএ পরীক্ষা করে এই তথ্য জানা গেছে। এই পরীক্ষা আরও প্রমান করেছে হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীরা আর্যদের থেকে সম্পূর্ন আলাদা ছিল কারন ওই মহিলার ডিএনএর সাথে আর্য মানুষদের জিনে থাকা বিশেষ আরওয়ানএ বৈশিষ্ট্য নেই। এই পরীক্ষা আর্যদের ভারতে আসার তথ্যকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। ভারতে আর্যদের আক্রমনের তথ্য উনিশ ও বিংশ শতকে ব্রিটিশরাই প্রথম প্রচার করে। ব্রিটিশরা জানিয়েছিল হিন্দুকুশ পর্বতমালা অতিক্রম করে আর্য সম্প্রদায়ের লোকেরা ভারতবর্ষ বিশেষ করে উত্তর ভারত আক্রমন করেছিল এবং সিন্ধু সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ব্রিটিশদের প্রচার করা এই কাহিনীর বিরোধীতা হয়েছে বহুবার। অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদদের বক্তব্য ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে তাদের প্রভাব বিস্তারকে সঠিক প্রমানিত করতে এই মনগড়া কাহিনী তৈরি করেছিল। আর্যদের ভারত আক্রমনের কোনও ঐতিহাসিক ও জেনেটিক প্রমান নেই।
ভারতে আর্য আক্রমনের কথা প্রথম জানায় জার্মান ভাষাতত্ত্ববিদ এবং প্রাচ্যবিদ ম্যাক্স মুলার, তিনি সংস্কৃত ভাষা অধ্যায়ন করে জানান সংস্কৃত ভাষা ও ইউরোপীয়ান ভাষায় অনেক মিল রয়েছে। তিনি আরও জানান ভারতে বৈদিক সংস্কৃতির বিকাশ ঘটিয়েছিল আর্যরা যারা ১,৫০০ বিসিইতে ভারতে আক্রমন করে হরপ্পা সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। ভারতে আর্য আক্রমনের প্রমানের জন্য ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়ান লেখকরা প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক প্রমানও প্রকাশ করে। যেমন ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্ববিদ মর্টিমার উইলার ১৯৪৭ সালে হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে প্রাপ্ত ৩৩ টি মানুষের খুলিকে আর্যদের বলে জানিয়েছিল, এছাড়া ঋগ্বেদে বর্নিত দশ রাজার যুদ্ধকেও আর্য ও অনার্যের যুদ্ধ বলে ঘোষনা করে ব্রিটিশরা। এই যুদ্ধ ভারত জনপদের রাজা সুদাস এবং দশটি জনপদের রাজার মধ্যে রাভি নদীর তীরে হয়েছিল যাতে রাজা সুদাস বিজয়ী হয়েছিল। বলা হয় রাজা সুদাসের ভারত জনপদের নাম থেকেই ভারতবর্ষ নামকরন এসেছে যদিও ভারতবর্ষ নামকরনের পিছনে আরও কীছু কারন রয়েছে। ব্রিটিশরা রাজা সুুদাসকে আর্যদের প্রতিনিধি এবং দশ রাজাকে স্থানীয় অনার্য বলে দাবী করে। ব্রিটিশরা ভারতে আর্যদের আক্রমনের তথ্যে হিন্দু ধর্মে স্বর্গের অধিপতি দেবরাজ ইন্দ্রকে, যাকে ঋগ্বেদে পুরন্দর বলা হয়েছে, হরপ্পা সভ্যতার দুর্গগুলোকে ধ্বংসের অধিপতি বলে প্রচার করার চেষ্টা করেছে। আসলে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদরা যেসব তথ্যই দিয়েছে তার ঐতিহাসিক সত্যতা নেই, তারা অনুমান ভিত্তিক তথ্য প্রচার করেছে নিজেদের স্বার্থের জন্য। ব্রিটিশরা ভারতে শাসন করার জন্য আর্য আক্রমনের কাহিনীতে প্রচার করে উত্তর ভারতে তুলনামূলক উজ্জ্বল চামড়ার ব্যক্তিরা ইউরোপীয়ান আর্যদের বংশধর যারা ভারতে বৈদিক সভ্যাতার সূচনা করেছিল এবং দক্ষিন ভারতের অধিবাসীরা দ্রাবিড় সভ্যতার বা অনার্য। এভাবে ব্রিটিশরা উত্তর ভারত ও দক্ষিন ভারতের মানুষকে জাতপাতের মাধ্যমে, চামড়ার রঙের ভিত্তিতে ভিন্ন করে ভারতে দীর্ঘদিন শাসন করেছিল।
ব্রিটিশরা তাদের এই কাহিনীর মাধ্যমে ভারতে তাদের আর্যদের উত্তরাধিকার বলে প্রচার করে যাতে স্থানীয় মানুষ এটা মনে করে যে ব্রিটিশরা কোনও ভাবেই ভারতে শাসন করতে আসনি বরং ভারতবর্ষে সভ্যতার বিকাশ ঘটাতে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতবাসীকে এভাবে ডিভাইড এন্ড রুল নীতির মাধ্যমে উত্তর ভারতীয় ও দক্ষিন ভারতীয়দের মধ্যে ভাগ করে ব্রিটিশরা ভারতে তাদের ঔপনিবেশিক শাসন করেছে এবং ভারতীয় সম্পদ লুঠ করেছে। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার ৭৬ বছর পরেও আজও আর্যদের ভারত আক্রমন এবং উত্তর ভারতীয়রা আর্যদেরই বংশধর কীনা সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার মতোনই একইরকম নিদর্শন পশ্চিম এশিয়ার বেশ কীছু দেশেও পাওয়া গেছে যা পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেগুলো ২,৫০০ বিসিই পুরোনো। সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন শহর যেমন হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, রাখীগড়ি, কালিবঙ্গান থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মানুষের বসতির যেসব নিদর্শন পেয়েছে সেগুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে সিন্ধু সভ্যতা প্রায় ৩,০০০ থেকে ২,৫০০ বিসিই বা ৫,০০০ থেকে ৪,৭০০ বছরের পুরোনো। আবার অনেক বিদ্বানদের ধারনা ঋগ্বেদ ১,৮০০ বিসিইর সময় লেখা হয়েছিল যার অর্থ সিন্ধু সভ্যতার অনেক পরে আর্যরা ভারতে এসেছিল। অধিকাংশ ঐতিহাসিকবিদের ধারনা আর্যরা ২,০০০ থেকে ১,৫০০ বিসিইতে ভারতে এসেছিল। আর্যরা প্যাসটোরাল যাযাবর জাতি ছিল যারা কৃষিকাজ জানতোনা। ঐতিহাসিকদের মতে ইন্দো ইরানীয় জনগোষ্ঠীকে আর্য বলা হয়, তবে ইরান থেকেই আর্যদের উৎপত্তি হয়নি, বরং আর্য জাতির শিখড় রয়েছে ইউরোপে।
ইউরোপীয় ঐতিহাসিকদের মতে আর্যদের মূল জীবিকা ছিল পশুপালন। তারা কিছু সময় অন্তর অন্তর এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতো সেজন্য তাদের নাম হয় আর্য। আধুনিক ইতিহাস অনুযায়ী আর্যরা যেসময় ভারতে এসেছিল সেসময় সিন্ধু সভ্যতা খরা, বন্যা ও আবহাওয়ার পরিবর্তনে প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ঋগ্বেদেও ধ্বংসপ্রাপ্ত শহরের উল্লেখ রয়েছে। যার অর্থ আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার পতনের সময় ভারতে এসেছিল এবং তাদের সাথে সিন্ধুবাসীদের কখনওই যুদ্ধ হয়নি। ব্রিটিশরা ভারতে আর্য আক্রমনের কাল্পনিক কাহিনী প্রচার করেছিল। ব্রিটিশরা প্রচার করেছিল ভারতবর্ষের মূল নিবাসি দ্রাবিড়রা, তাদের আক্রমন করে ইন্দো ইউরোপীয় আর্যরা ভারতে সভ্যতার সূচনা করেছিল। এভাবেই ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের মানুষকে বিভক্ত করেছিল শাসন করার জন্য। জেনেটিক বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী আর্যদের ডিএনএতে ওয়াই ক্রোমোজম হ্যাপলো গ্রুপ আরওয়ানএ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ গুলো থেকে দক্ষিন এশিয়া পর্যন্ত পাওয়া যায়। এই পুরো অঞ্চল জুড়েই ইন্দো ইউরোপীয়ান ভাষার আধিক্য দেখা যায়। এই আরওয়ান এ এর একটি ভাগ হচ্ছে আরওয়ানএ এম৪১৭ যা আবার পরবর্তী কালে দুটি ভাগে বিভক্ত হয় আরওয়ানএ জেড৯৩ এবং আরওয়ানএ জেড২৮২. এই আরওয়ানএ জেড২৮২ বৈশিষ্ট্য যুক্ত ডিনএনএ পাওয়া যায় ইউরোপে এবং আরওয়ানএ জেড৯৩ ডিএনএ পাওয়া যায় মধ্য এশিয়া ও দক্ষিন আমেরিকার মানুষদের মধ্যে। জেনেটিক ডাক্তার পিটার এ আন্ডারহিলের গবেষনা অনুযায়ী ইউরোপে আর্য জনগোষ্ঠীর উত্থান হয়েছিল বর্তমান ইউক্রেন থেকে প্রায় ৫,০০০ থেকে ৩,৫০০ বিসিইতে। ইউক্রেন থেকে আর্য জনগোষ্ঠী দুটি দিকে যায়। একটি গোষ্ঠী ইউরোপের মূল ভূভাগে যায় এবং আরেকটি দল রাশিয়া হয়ে এশিয়ার বিভিন্ন দেশ হয়ে ভারতে আসে। রাখীগড়ীতে পাওয়া মানুষের জীবাশ্ম থেকে পরীক্ষা করে এটাই জানা গেছে হরপ্পা সভ্যতার মানুষের সাথে আর্যদের কোনও সম্পর্ক ছিলনা, আর্যরা ভারতে এসেছিল মধ্য এশিয়ার ইরান হয়ে কিন্তু তারা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের শেষ সময়ে এসেছিল। জেনেটিক বিজ্ঞান, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ইতিহাস এটাই বলে যে আর্যরা ভারতে বাইরে থেকে এসেছিল ঠিকই কিন্তু তারা ভারতে কোনওরকম আক্রমন করেনি বরং সময়ের সাথে ভারতের মূলস্রোতে মিশে গেছে। ভারতে আসার পর আর্যরা প্রথমে পশুপালনই করতো কিন্তু পরে তারা কৃষিকাজ শিখে নেয়। আর্যদের নাম থেকেই ভারতবর্ষের একসময় নাম ছিল আর্যাবর্ত বা আর্যদের ভূমি। পরবর্তী বৈদিক সময় বা ১০০০ বিসি থেকে ৬০০ বিসি পর্যন্ত সময়কালে উত্তরে হিমালয় পর্বত থেকে দক্ষিনে নর্মদা নদী পর্যন্ত এলাকাকে আর্যাবর্ত বলা হত। কিন্ত আর্যদের ভারতে সঠিক আগমনের সময় ঘিরে বিতর্ক রয়েছে। কারন আধুনিক ইতিহাসের মতে আর্যরা ভারতে এসেছিল হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের সময়ে বা আজ থেকে প্রায় ৩,৫০০ থেকে ৪,০০০ বছর আগে। কিন্ত ভারতীয় শাস্ত্রমতে আর্যরা যিশুখ্রীষ্টের জন্মের পাঁচ হাজার বছর আগে বিহারে এসেছিল প্রথমে অর্থাৎ এই হিসেবে আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে আর্যরা ভারতে এসেছিল। কিন্ত ঐতিহাসিকদের মতে সিন্ধু সভ্যতা শুরু হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। তাই শাস্ত্র অনুযায়ী আর্যরা সিন্ধু সভ্যতার আগেই ভারতে এসেছিল।