অ্যাডলফ হিটলার বনাম জোসেফ স্তালিনের মতো আধুনিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তিনটি বিশ্বাসঘাতকতা
মানব সভ্যতার ইতিহাস থেকেই বন্ধুত্ব ও বিশ্বাসঘাতকতা সমান্তরাল ভাবে চলে আসছে। একজন সাধারন মানুষ যখন অন্য একজন সাধারন ব্যক্তির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তখন তার প্রভাব একটি ব্যক্তির উপরই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্ত কোনও দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যখন অপর একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তখন তার প্রভাব পড়ে সেই দেশের সম্পূর্ন জনগনের উপর। ইতিহাসে এমন অনেক বিশ্বাসঘাতকতা রয়েছে যেখানে বেইমানি করেছে কোন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি কিন্তু তার প্রভাব পড়েছিল কয়েক হাজার, লাখ ব্যক্তির উপরে। আধুনিক ইতিহাসে এমনই তিনটি বিশেষ বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত রয়েছে যার কারনে অসংখ্য সাধারন মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে গেছে।
১) অ্যাডলফ হিটলার বনাম জোসেফ স্তালিন:–
১৯৩৩ সালে অ্যাডলফ হিটলার যখন জার্মানির সর্বোচ্চ নেতা হয় তখন জার্মানির অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। কারন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর ভার্সাইলের চুক্তি অনুযায়ী মিত্রশক্তি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমস্ত দায়ভার জার্মানির উপর চাপিয়ে দেয় এবং জার্মানির উপর অন্যায় শর্ত আরোপ করা হয় অনেক। চুক্তি অনুযায়ী জার্মানিকে আদেশ দেওয়া হয় নৌবহর এর সংখ্যা কম করতে, সাবমেরিন তৈরি না করতে, বায়ুসেনা না রাখতে এবং এক লাখের বেশী স্থলসেনা না রাখতে, উপরন্তু জার্মানির থেকে মোটা ক্ষতিপূরন আদায় করা হয়। যার কারনে জার্মানির অর্থব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়ে। ১৯২৯ সালে আমেরিকাতে গ্রেট ডিপ্রেশনের কারনে পুরো ইউরোপের আর্থিক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে জার্মানির উপর। এরকম অবস্থায় ১৯৩৩ সালে জার্মানি শাসনক্ষমতায় এসে হিটলার জার্মানির পূর্ন উন্নয়ন শুরু করে। হিটলার প্রথমেই ভার্সেইলের চুক্তিকে বাতিল করে দেয় এবং ১৯৩৪ সাল থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির সেনাবাহিনী, বায়ুসেনা ও নৌবহর বৃদ্ধি করে, যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন, ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয়।
১৯৩৯ সাল থেকে অ্যাডলফ হিটলার একে একে আশেপাশের দেশগুলো দখল করতে শুরু করে। হিটলার প্রথমেই অস্ট্রিয়া দখল করে, এরপর চেকশ্লোভিয়ার সুডেতানল্যান্ড দখল করে। ১৯৩৯ সালে ইউরোপে জার্মানির ব্যাপক প্রভাব বৃদ্ধি পায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রপক্ষও জার্মানির শক্তিবৃদ্ধিতে ভয় পেয়ে যায়। অ্যাডলফ হিটলারের একটা অদ্ভুত বিশ্বাস ছিল, হিটলার বিশ্বাস করতো একমাত্র জার্মানরাই ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু জাতি এবং বিশুদ্ধ আর্য যার কারনে আশেপাশের সমস্ত দেশের উপর রাজত্ব করবার অধিকার একমাত্র জার্মানদেরই আছে। বিশেষ করে হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নের লোকেদের নীচু জাতের লোক মনে করতো। ১৯৩৯ সালে ইউরোপে সবাই মনে করতো যেকোনও মহূর্তে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যুদ্ধ হবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১৯৩৯ সালের ২৩ আগস্ট জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মোলোটোভ রিবেনট্রপ চুক্তি হয় যাকে হিটলার স্তালিন চুক্তিও বলা হয়। এই চুক্তিতে ঠিক হয় জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন কখনও একে অপরকে আক্রমন করবেনা। কিন্তু এই চুক্তিতে একটি গোপন বিষয় ছিল তা হল জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমন করবে যাতে পূর্বদিক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাধা দেবেনা, সোভিয়েত ইউনিয়নও কিছু সময় পর পোল্যান্ড আক্রমন করবে এবং পোল্যান্ডকে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেবে। এই চুক্তির এক সপ্তাহ পর ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমন করে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করে। ১৭ সেপ্টেম্বর পূর্বদিক দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নও পোল্যান্ড আক্রমন করে এবং জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে পোল্যান্ডকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় চুক্তি অনুযায়ী।
১৯৪০ সাল আসতে আসতে প্রায় গোটা ইউরোপই দখল করে নিয়েছিল হিটলারের নাজি সেনা। ফ্রান্সের মতোন শক্তিশালী দেশকেও দখল করে নিয়েছিল জার্মানি। ইউরোপে ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নই বাকী ছিল শুধু। ১৯৪১ সালের ২২ জুন অপারেশন বারবারোসার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমন করে নাজি সেনা। সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি জোসেফ স্তালিন প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারেনি হিটলার চুক্তি খেলাপ করে তার সাথে এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করবে। আসলে হিটালারের কোনওদিন ইচ্ছেই ছিলনা সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি করার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি দুই দিকে যুদ্ধ করেছিল পশ্চিম দিকে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাথে এবং পূর্বদিকে রাশিয়ার সাথে। এই দ্বিমুখী যুদ্ধের কারনে জার্মানি পরাজিত হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি করেছিল যাতে জার্মানি যখন ইউরোপের বাকী দেশগুলোকে আক্রমন করবে তখন যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে। তবে হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন দখলের অভিযান ব্যার্থ হয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নও জার্মানির বিরুদ্ধে মিত্রপক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধ ঘোষনা করে।
১৯৪৫ সালে জার্মানির পরাজয়ের পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয় তখন জার্মানিকে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয় পূর্ব জার্মানির নিয়ন্ত্রন যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের হাতে এবং পশ্চিম জার্মানির নিয়ন্ত্রন যায় আমেরিকা, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের হাতে। শুধুমাত্র হিটলারের বিশ্বাসঘাতকতার কারনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
২) নেপোলিয়ন বনাম জিয়ান বাপটিস্ট জুলেস বের্নাডট:— বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ জেনারেল নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৮০৪ সালে নিজেকে ফ্রান্সের রাজা হিসাবে ঘোষনা করে এবং ফরাসি সাম্রাজ্যের বিস্তার শুরু করে। ১৮০৪ থেকে ১৮১৫ সাল অবধি ফ্রান্সের সাথে ইউরোপের বাকী দেশগুলোর একাধিক যু্দ্ধ হয় যাকে নেপোলিয়নিক যুদ্ধ বলা হয়। তবে নেপোলিয়নের ফ্রান্সের সম্রাট হওয়ার আগে ১৭৯৫ সালে ফরাসি বিদ্রোহের সময় ফ্রান্সে জিয়ান বাপটিস্ট নামে এক দক্ষ সামরিক জেনারেল ছিল যে অসাধারন দক্ষতায় ফ্রান্সের সাম্রাজ্য বিস্তারে সাহায্য করেছিল। নেপোলিয়নও জিয়ান বাপটিস্টের উপর প্রভাবিত ছিল। যার কারনে ১৭৯৯ সালে ফ্রান্সের ক্ষমতায় এসেই নেপোলিয়ন জিয়ান বাপটিস্টকে ফরাসি সেনাবাহিনীর মার্শাল বানিয়ে দেয়। নেপোলিয়নের হয়ে একাধিক যুদ্ধে অংশ নেয় জিয়ান বাপটিস্ট। ১৮০৫ সালে অস্ট্রালিজের যুদ্ধ নেপোলিয়ন জিয়ান বাপটিস্টের জন্যই জিতেছিল। নেপোলিয়নের সাথে জিয়ান বাপটিস্টের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ১৮০৬ সাল থেকে তাদের বন্ধুত্ব খারাপ হতে শুরু হয়। বেশ কিছু যুদ্ধে জিয়ান বাপটিস্টের উপর ক্ষুব্ধ হয় নেপোলিয়ন। ১৮০৯ সালে এক যুদ্ধে নেপোলিয়ন জিয়ান বাপটিস্টের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে সরাসরি ফ্রান্স ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। ১৮১০ সালে জিয়ান বাপটিস্টের ভাগ্য পরিবর্তন হয়, সুইডেনের বৃদ্ধ রাজা তৃতীয় চার্লস জিয়ান বাপটিস্টকে তার উত্তরাধিকার ঘোষনা করে। সুইডেনের দায়িত্ব পেয়েই জিয়ান বাপটিস্ট ১৮১২ সালে নেপোলিয়ন বিরোধী জোটে প্রুশিয়া, রাশিয়া, ব্রিটেন, অস্ট্রিয়ার সাথে যোগ দেয়। ১৮১৩ সালে এই জোটের সাথে লিপজিগের যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হয় এবং ফ্রান্সের সিংহাসন ছাড়তে হয় তাকে। ১৮১৮ সালে তৃতীয় চার্লসের মৃত্যুর পর সুইডেনের রাজা হয় জিয়ান বাপটিস্ট। আজও সুইডেনের রাজকীয় পরিবারে জিয়ান বাপটিস্টেরই উত্তরাধিকার রয়েছে।
৩) ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও নবাব সিরাজ উদ দৌলা :— সময়টা তখন ১৭৫৬, ভারতে তখনও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এতটা শক্তিশালী ছিলনা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন ভারতে ব্যাবসাতেই বেশী আগ্রহী ছিল। সেসময় বাংলার নবাব ছিল সিরাজ উদ দৌলা। বাংলাতে ব্রিটিশদের পাশপাশি ফরাসিরাও ছিল। সিরাজ উদ দৌলা লক্ষ্য করে ব্রিটিশ ও ফরাসিরা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য নিজেদের শক্তি বাড়াচ্ছে। সিরাজ উদ দৌলা বাংলা থেকে ব্রিটিশদের সরানোর জন্য ব্রিটিশদের উইলিয়াম দুর্গ আক্রমন করে এবং ২০ জুন, ১৭৫৬ সালে ফোর্ট উইলিয়াম দখল করে নেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের এই পরাজয়ের বদলা নেওয়ার জন্য রবার্ট ক্লাইভকে পাঠায়। রবার্ট ক্লাইভ লক্ষ্য করে সিরাজ উদ দৌলার সেনাপতি মীরজাফর সিরাজ উদ দৌলাকে হারিয়ে নিজে নবাব হতে চায়। রবার্ট ক্লাইভ গোপনে মীরজাফরের সাথে চুক্তি করে যুদ্ধে তার সেনাবাহিনী ব্যবহার না করার জন্য। ঠিক তেমনই ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মীরজাফর তার সেনাবাহিনী ব্যবহার না করে সিরাজ উদ দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। যার কারনে পলাশির যুদ্ধে সিরাজ উদ দৌলা পরাজিত হয় এবং তাকে হত্যা করা হয়। মীরজাফর বাংলার নবাব হয়ে রবার্ট ক্লাইভকে ও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রচুর উপহার দেয়। পলাশির যুদ্ধ ভারতের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ন অধ্যায় কারন এরপরেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে উপনিবেশ তৈরির স্বপ্ন দেখে এবং বনিকের মানদন্ড রাজদন্ডে পরিনত হয়। যদি পলাশির যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভ পরাজিত হত তাহলে হয়ত ভারত কোনওদিন ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিনত হতনা, মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার কারনে কোটি কোটি ভারতবাসী পরবর্তী ১৯০ বছর ধরে ইংরেজ অত্যাচার সহ্য করে।