ফিচার আর্টিকেল

১৯৬৪ সালে শব্দের থেকে তিনগুন বেশী গতি যুক্ত বিশ্বের প্রথম ড্রোন গোয়েন্দা বিমান তৈরি করেছিল আমেরিকা, সোভিয়েত এবং চীনে গিয়ে একাধিকবার ধরা পড়েছিল

বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী বিমান বলা হয় আমেরিকার লকহিড মার্টিনের তৈরি এসআর ৭১ ব্ল্যাকবার্ডকে। এসআর ৭১ এর সর্বোচ্চ গতি ৩,৫৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা বা তিন ম্যাক। অর্থাৎ এই বিমানটি শব্দের গতির তুলনায় তিনগুন বেশী গতিতে যেতে সক্ষম ছিল। এত দ্রুতগতির বিমান হয়েও এটা নিয়ন্ত্রন করতো একজন পাইলট। এসআর ৭১ এর মুখ্য ডিজাইনার ছিল ক্লেরেন্স কেলি জনসন। আমেরিকা এই বিমান তৈরি করেছিল যাতে অন্যদেশের উপর নজর রাখা যায়। আমেরিকা ১৯৬৪ সালে এই বিমান তৈরি করেছিল, এইসময়কালে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলছিলো। উভয়দেশই নিজেদের গুপ্তচর সংস্থা ব্যবহার করে একে অন্যের গোপন প্রজেক্টের উপর নজর রাখার চেষ্টা করছিলো কারন শীতল যুদ্ধ কোনও সরাসরি যুদ্ধ ছিলনা, এটা ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ কে বেশী শ্রেষ্ঠ তা প্রমানের জন্য। সেই জন্য আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুই দেশই প্রচুর গোপন প্রজেক্টে কাজ করছিলো একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য। আমেরিকা এই জন্য সেসময় অনেক গোয়েন্দা বিমান তৈরি করেছিল যাতে এসব বিমান অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপরে গিয়ে ছবি তুলে আনে যাতে সেসব ছবি দেখে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিকল্পনা জানা যায়। 

সোভিয়েত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য অত্যন্ত গতিশীল এসব বিমান তৈরি করেছিল আমেরিকা, যার মধ্যে এসআর ৭১ও ছিল। তবে অত্যন্ত দ্রুতগতির বিমানে অনেকসময় পাইলটের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে কিন্তু দ্রুতগতির বিমান না তৈরি করলে সোভিয়েত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আঘাত করতো বিমানে। ঠিক এমনটাই হয় ১৯৬০ সালে, আমেরিকার একটি গোয়েন্দা বিমান ইউ ২কে ওড়াচ্ছিল ফ্রান্সিস গ্যারি রজার্স। যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে পৌঁছায় ফ্রান্সিস ছবি তোলার জন্য তখন ইউ ২কে গুলি করে নীচে নামায় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ফ্রান্সিসকে ধরে ফেলে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই ঘটনায় গোটা বিশ্বের সামনে আমেরিকার বদনাম হয়। সেজন্য আমেরিকা এমন এক বিমান তৈরির চিন্তাভাবনা করে যেটি অত্যন্ত দ্রুতগতির হবে এবং অনেক উঁচু থেকে নীচে থাকা স্থাপনার ছবি তুলবে এবং বিমানটিতে কোনও চালক থাকবেনা অর্থাৎ আমেরিকা একটি ড্রোন গোয়েন্দা বিমান প্রজেক্টে কাজ শুরু করে। এই প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয় প্রজেক্ট ট্যাগবোর্ড।

১৯৬২ সালে আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ এবং আমেরিকার বায়ুসেনা লকহিড মার্টিনকে নির্দেশ দেয় এমন একটি বিমান তৈরি করার যার গতি হবে ৩.৩ থেকে ৩.৫ ম্যাক, যেটি ৮৭,০০০ থেকে ৯৫,০০০ ফুট উচ্চতা থেকে নীচে থাকা স্থাপনার ছবি তুলতে পারবে এবং যার রেঞ্জ হবে ৩০০০ নটিক্যাল মাইল বা ৫,৬০০ কিলোমিটার। এসআর ৭১ ব্ল্যাকবার্ডের ডিজাইনার কেলি জনসনই এই নতুন ড্রোন বিমান তৈরির দায়িত্ব নেয়। কেলি সিআইএ ও আমেরিকার বিমানবাহিনীর চাহিদা অনুযায়ী অনুযায়ী এমন একটি বিমান তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় যেটি ছবি তোলার পর ক্যামেরা পেলোড নিজের থেকে আলাদা করে দেবে এবং বিমানটি নিজে থেকেই ধ্বংস হয়ে যাবে। ওই ক্যামেরা পেলোড আবার অন্য একটি বিমান মাঝ আকাশেই সংগ্রহ করবে। অর্থাৎ কেলি জনসন যে নতুন বিমান তৈরি করতে চলেছিলো সেটি একটি আত্মঘাতী ড্রোনের মতোন কাজ করবে। কেলি জনসন আরও ঠিক করে বিমান থেকে ক্যামেরা পেলোড আলাদা তখনই করা হবে যখন বিমানটি কোনও সমুদ্রের উপর দিয়ে যাবে কারন যদি কোনও কারনবশত অন্য একটি বিমান সেই পেলোড সংগ্রহ করতে নাও পারে তাহলে সেই পেলোড সমুদ্রে গিয়ে পড়বে এবং আমেরিকার নৌবাহিনীর একটি জাহাজ সেই পেলোড সংগ্রহ করবে। পেলোডটি যাতে সমুদ্রে না ডোবে তার জন্য তাতে বিশেষ ভাসমান ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়েছিল। এই ড্রোন বিমানের নাম দেওয়া হয় ডি ২১, তবে লকহিড মার্টিন প্রথমে একে কিউ ১২ নাম দিয়েছিল। 

এসআর ৭১ ব্ল্যাকবার্ড বিমান থেকে এই ডি ২১কে লঞ্চ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ১৯৬২ সালের অক্টোবার মাস থেকে ডি ২১ এর কাজ শুরু হয়। ১৯৬৪ সালের ২২ ডিসেম্বর এসআর ৭১ থেকে লঞ্চ করা হয় ডি ২১ থেকে কিন্তু এই পরীক্ষা ব্যর্থ হয়। এসআর ৭১ এর নাম দেওয়া হয় এম ২১ অর্থাৎ মাদার ২১ এবং ডি ২১ এর অর্থ ডটার ২১. ১৯৬৭ সালের এপ্রিল মাসে ডি ২১ এর দ্বিতীয় পরীক্ষা করা হয় এবার ডি ২১ ৩.৩ ম্যাক গতিতে উড়ে গিয়ে সরাসরি জমিতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে যায় অর্থাৎ এবারও ব্যর্থ হয় পরীক্ষা। তৃতীয় পরীক্ষার সময় ডি ২১ ক্যামেরা পেলোড বের করে দিতে সক্ষম হয়নি। চতুর্থ পরীক্ষায় সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। চতুর্থ পরীক্ষার সময় এম ২১ ব্ল্যাকবার্ড থেকে ডি ২১ লঞ্চ হয় কিন্তু সেটি আগে না গিয়ে এম ২১ এর সাথে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এতে এম ২১ বিমানটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বিমানে থাকা দুজন পাইলটের একজন রে টরিকের মৃত্যু হয়। এরপরেই প্রজেক্ট ট্যাগবোর্ডকে বন্ধ করে দেয় সিআইএ। কিন্তু কেলি জনসন তখনও হার মানেনি, তিনি ঠিক করেন এবার বিমানের উপর থেকে লঞ্চ না করে বিমানের নীচে থেকে লঞ্চ করা হবে ডি ২১ কে। এবার প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয় প্রজেক্ট সিনিয়র বোল। 

কেলি জনসন এসআর ৭১ এর বদলে বি ৫২ স্ট্রাটোফোর্ট্রেস বোম্বারের নীচে থেকে ডি ২১ লঞ্চের সিদ্ধান্ত নেন। ডি ২১এ বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয় এবং এই ভার্সনের নাম দেওয়া হয় ডি ২১বি। এবার পরীক্ষার সময় বেশ কয়েকবার সফল হয় ডি ২১বি। এরপরেই আমেরিকা ঠিক করে এবার বাস্তবে ডি ২১বি কে মিশনে পাঠানো হবে। ডি ২১বিকে সর্বমোট চারটি মিশনে পাঠানো হয়েছিল। ডি ২১বি এর প্রথম মিশন ছিল চীনের লপ নোর পরমানু কার্যক্রমের উপর নজর রাখা। গুয়ামের অ্যান্ডারসন এয়ারবেস থেকে এই মিশন শুরু করা হয় ১৯৬৯ সালের ৯ নভেম্বর। ২০ মার্চ, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই মিশনের লক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। ডি ২১বি ছবি তোলে, ছবি তোলার পর ডি ২১বিকে একটু বেঁকে সমুদ্রের উপর গিয়ে ক্যামেরা পেলোড বের করার প্রয়োজন ছিল নিজের থেকে কিন্তু ডি ২১বি কোনওদিকে না বেঁকে সোজা গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে ধ্বংস হয়ে যায়। তবে চীন কখনও ডি ২১বিকে চিহ্নিত করার দাবী করেনি। ২০ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭০ সালে ডি ২১বি এর দ্বিতীয় মিশন শুরু করা হয় চীনের ওই অঞ্চলেই। এবার ডি ২১বি ছবি তুলে ক্যামেরা পেলোড সমুদ্রের উপরে বেরও করে দেয় কিন্তু ক্যামেরা পেলোডের প্যারাসুট না খোলায় বহু উপর থেকে সোজা সমুদ্রের জলে পড়ে ক্যামেরা পেলোড ভেঙে যায় এবং এই মিশনও ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর ১৯৭১ সালেরই ৪ মার্চ ডি ২১বিকে তার তৃতীয় মিশনে পুনরায় চীনের লপ নোরে পাঠানো হয়। এবার সব কিছু ঠিকঠাক হয় প্যারসুটও খোলে ক্যামেরা পেলোডের। কিন্তু আকাশেই অন্য একটি বিমানের প্যারাসুট সংগ্রহ করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ফলে ক্যামেরা পেলোড সমুদ্রে গিয়ে পড়ে এবং ডুবে যায়। 

আমেরিকান নৌবাহিনীর একটি ডেস্ট্রয়ার অনেক চেষ্টা করেও খুঁজে পায়নি এটি। ওই মাসেই ২০ তারিখে ডি ২১বি এর চতুর্থ মিশন শুরু করা হয়। কিন্তু এবার ডি ২১বি বি ৫২ স্ট্রাটোফোর্ট্রেস থেকে আলাদা হওয়ার পর চীনের ইউনান প্রদেশের উপর হারিয়ে যায়। ২০১০ সালে চীনের স্থানীয় সংস্থা ডি ২১বি এর ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছিল যা বর্তমানে বেজিংয়ে চীনের অ্যাভিয়েশন মিউজিয়ামে রাখা আছে। বারবার মিশন ব্যার্থ হওয়ার জন্য আমেরিকা বাধ্য হয়ে ১৯৭১ সালের ২৩ জুলাই ডি ২১বি প্রজেক্ট বা প্রজেক্ট ট্যাগবোর্ড ও প্রজেক্ট সিনিয়র বোল বন্ধ করে দেয়। মোট ৩৮টি ডি ২১ ও ডি ২১বি ড্রোন তৈরি করা হয়েছিল যার মধ্যে ২১টি ড্রোনই পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়ে যায় এবং বাকী ১৭টি ড্রোন অ্যারিজোনার ডেভিস মোনথান এয়ারফোর্স বেসে রাখা হয়। 

প্রথম যে ডি ২১বি ড্রোন সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরে জানা যায় সাইবেরিয়া অঞ্চলে এটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের ইনটেলিজেন্স সংস্থা কেজিবি এটা উদ্ধার করে।

১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে কেজিবি এই ড্রোনের একটা ছোট টুকরো প্রমান হিসাবে সিআইএকে পাঠিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের টুপোলেভ ডিজাইন ব্যুরো এই ড্রোনের সোভিয়েত ভার্সন ভেরোন নামে একটি ড্রোন তৈরি করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কিন্তু কখনও তৈরি করেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published.