ফিচার আর্টিকেল

কিভাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল প্রজাতন্ত্র দিবস?

১৮৫৮ সাল থেকে ভারতের রাজ করা ব্রিটিশ শাসনের পতন ঘটে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট। জন্ম হয় স্বাধীন ভারতের। ভারত ব্রিটিশ সরকার হাত থেকে মুক্তি পেলেও দেশের কোনো নিজস্ব সংবিধান গড়ে ওঠেনি তখনও। যার কারণে ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকারের ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’-এর সংশোধিত সংস্করণ অনুযায়ী শাসন করা হত স্বাধীন ভারতকে। তবে এরপরে দেশে দেখা দিতে শুরু করল নিজস্ব সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ঘোষণা করা হলো সংবিধান সভার কথা। নির্বাচন করা হলো সংবিধানের সভার সদস্যদের। সংবিধান সভার সদস্যদের তালিকায় ছিল ড. বিআর আম্বেদকর, জওহরলাল নেহরু, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের নিয়েই গঠন করা হয়েছিল সংবিধান সভা। 

আম্বেদকরের নেতৃত্বে ২৯ অগস্ট ১৯৪৭ সালে একটি খসড়া কমিটি গড়ে তোলা হয় ভারতে স্থায়ী সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে। সংবিধান সভায় ১৯৪৭ সালের ৪ নভেম্বর এই খসড়া কমিটি ভারতীয় সংবিধানের খসড়া জমা দিয়েছিল। 

এই প্রস্তাবিত সংবিধান নিয়ে জনগণের সাথে সরাসরি আলোচনা ও নানা চিন্তাভাবনা করতে সময় লেগেছিল প্রায় দু বছরেরও বেশি। এরপর কিছু সংশোধন, সংযোজন ও পরিবর্তন আনা হয়েছিল প্রস্তাবিত সংবিধানে। অবশেষে সংবিধান সভায় ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর ভারতীয় সংবিধানের খসড়া গৃহীত হয়েছিল।

১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি সভার ৩০৮ জন সদস্য সংবিধানের দু’টি হস্তলিখিত কপিতে সই করেন। এর মধ্যে একটি কপি ইংরেজিতে ছিল এবং আরেকটি কপি হিন্দিতে ছিল। এর ঠিক দুই দিন পর অর্থাৎ ২৬ জানুয়ারি কার্যকর হয় ভারতীয় সংবিধান। এই দিনে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে। স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ।

২৬ শে জানুয়ারিকে গণতন্ত্র দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পেছনে এই কারণটি ছাড়াও রয়েছে আরও একটি ইতিহাস। জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর মাসে লাহোরে কংগ্রেস অধিবেশনের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এই অধিবেশনে পেশ করা হয়েছিল একটি প্রস্তাব। এই অধিবেশনে ঘোষণা করা হয়েছিল যে ব্রিটিশ সরকার যদি ১৯৩০ সালে ২৬ শে জানুয়ারির মধ্যে ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা না দেয়, সেক্ষেত্রে ভারতের পূর্ণ স্বরাজ ঘোষণা করা হবে। তবে ব্রিটিশ সরকার সেই সময়সীমার মধ্যে ভারতকে ডোমিনিয়নের মর্যাদা দেয়নি। যার ফলে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের ঘোষণা করে কংগ্রেস সক্রিয় আন্দোলন শুরু করেছিল। ১৯৩০ সালে ২৬ শে জানুয়ারি এই দিনটির গুরুত্ব বজায় রাখার জন্য ১৯৫০ সালে এই দিনই ভারতের সংবিধান গৃহীত হয় এবং গণতন্ত্র দিবস হিসেবে এই দিনটি পালন করা শুরু হয়।

প্রজাতন্ত্র দিবস নিয়ে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:

ভারতের সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি সকাল ১০টা ১৮ মিনিটে কার্যকরী হয়েছিল। এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল ২ বছর, ১১ মাস এবং ১৮ দিন ।

এইদিন কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় দিল্লিতে। রাইসিনা হিল থেকে শুরু করে এই আট কিলোমিটারের কুচকাওয়াজ রাজপথ এরপর ইন্ডিয়া গেট হয়ে লালকেল্লায় এর শেষ হয়।

১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি কুচকাওয়াজ আয়োজিত হয়েছিল রাজপথের পরিবর্তে তৎকালীন ইর্ভিন স্টেডিয়াম (বর্তমানে ন্যাশনাল স্টেডিয়াম)-এ। সেই সময় চারদিকে দেওয়াল ছিল না ইর্ভিন স্টেডিয়ামের এবং সেখান থেকে পরিষ্কার দেখা যেত লালকেল্লা।

জাতীয় সংগীতের সময় থেকে শুরু হয়  সেলামি দেওয়া এবং  ৫২ সেকেন্ডের জাতীয় সঙ্গীত শেষ হওয়ার সাথে সাথে সমাপ্তি ঘটে এই সেলামি। ২১টি তোপের সেলামি দেওয়া হয় জাতীয় সংগীতের সময়ে।

এই বছরে ‘ভিক্ষিত ভারত’ এবং ‘লোকতন্ত্র কি মাতৃকা’ হবে নারী-কেন্দ্রিক কুচকাওয়াজের মূল থিম। 

প্রতিবছর ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন কুচকাওয়াজ দেখার জন্য প্রধান অতিথি হিসাবে প্রধানমন্ত্রী , রাষ্ট্রপতি সহ যে কোনও একটি দেশের শাসককে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই বছরের প্রধান অতিথি হিসাবে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ থাকবেন।

প্যারেড হল প্রজাতন্ত্র দিবসে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।  এই প্যারেড কর্মসূচিতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ বিদেশ থেকে বিশেষ অতিথিরাও আসেন অংশগ্রহণ করার জন্য। বিভিন্ন রাজ্যের ট্যাবলো প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে অংশগ্রহণ করে। ভারতীয় সেনা, নৌ ও বায়ুসেনা অংশগ্রহণ করে প্যারেডে।

এক বছর আগে থেকে জুলাই মাসে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের প্রস্তুতি শুরু হয়। প্যারেড অংশগ্রহণকারীদের তাঁদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে শেখানো হয় এবং কুচকাওয়াজের দিন ভোর ৩টার মধ্যে তাদের অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাতে হয়। তারপর তারা বেশ কিছু কসরত করে কুচকাওয়াজের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন।

বন্দুকের স্যালুট দেওয়া হয় প্যারেড চলাকালীন। স্যালুটের সময় গাওয়া হয় জাতীয় সঙ্গীতও। প্রথম গুলি চালানো হয় জাতীয় সঙ্গীতের শুরুতে এবং ৫২ সেকেন্ড পরে জাতীয় সঙ্গীতের শেষে গুলি করা হয়।

২৬ শে জানুয়ারির কুচকাওয়াজের কর্মসূচি রাষ্ট্রপতির আগমনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। প্রথমত, জাতীয় পতাকাকে রাষ্ট্রপতির দেহরক্ষী স্যালুট করেন এবং সেই সময় চলে জাতীয় সঙ্গীত। 

সেনাবাহিনীর সদস্যরা প্যারেড মার্চে দেশীয় ইনসাস রাইফেল নিয়ে অংশ নেন এবং  বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীরা ইসরায়েলি ট্যাভোর রাইফেল নিয়ে মার্চ করেন৷

Leave a Reply

Your email address will not be published.