ফিচার আর্টিকেল

হুমায়ুনের মৃত্যুর মতো ভারতের ২৬ জানুয়ারির কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা

সদ্য অতিবাহিত হয়েছে ভারতবর্ষের ৭৫ তম প্রজাতন্ত্র দিবস, তবে এই দিনের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য এতটাই যে এই দিনটি শুধু ঐতিহাসিকই নয় পাশাপাশি প্রতিটি ভারতীয়র কাছে মনে রাখার মতো একটা দিন। ভারতবর্ষে বহু ধর্মের মানুষ বাস করে যার জন্য সারা বছর ধরেই উৎসবে মুখরিত থাকে ভারতীয়রা। কিন্তু ২৬ জানুয়ারি ও ১৫ আগস্ট এমন দুটো দিন যেদিনগুলি অত্যন্ত বিশেষ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত ভারতবাসীর কাছে। 

১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি স্বাধীন ভারতে প্রথম সংবিধান কার্যকরী করা হয়, সেই থেকেই ২৬ জানুয়ারি দিনটি প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে পালন করা হয়। ২০২৪ সালের ২৬ জানুয়ারি ৭৫ তম প্রজাতন্ত্র দিবস ছিল। এবছর দিল্লির কর্তব্যপথে প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল নারীর ক্ষমতায়ন প্রদর্শন। এবারের প্যারেডে ভারতের সেনাবাহিনী, বায়ুসেনা, নৌসেনা তিন বাহিনীর মহিলা সদস্যরা একত্রে অংশ নিয়েছে। প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেড রাষ্ট্রপতি ভবনের সামনে বিজয় চক থেকে সকাল দশটার দিকে শুরু হয়। রাষ্ট্রপতি ভবন ও ইন্ডিয়া গেটের মাঝের রাস্তাকে কর্তব্য পথ বলে, এই পথের আগে নাম ছিল রাজপথ। বিজয় চক থেকে প্যারেড বা কুচকাওয়াজ শুরু হয়ে ইন্ডিয়া গেট, তিলক মার্গ, বাহাদুর শাহ জাফর মার্গ হয়ে লাল কেল্লাতে গিয়ে এই প্যারেড শেষ হয়। এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসের থিম ছিল বিকশিত ভারত এন্ড ভারত : লোকতন্ত্র কি মাতরুকা অর্থাৎ ভারতের উন্নয়নকে এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসে তুলে ধরা হয়েছে। প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে বিভিন্ন রাজ্যের ট্যাবলো প্রদর্শন করা হয়। ২০২৪ এর প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে ট্যাবলোর জন্য ভারতের ত্রিশটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ট্যাবলোর জন্য অনুরোধ করেছিল যার মধ্যে ১৫ থেকে ১৬টি রাজ্যের ট্যাবলো নির্বাচন করা হয়েছে। এই প্রথম কর্তব্যপথে প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ শুরু করে একশোর বেশী মহিলা শিল্পী। এরপর কুচকাওয়াজে ভারতের সর্বোচ্চ শৌর্য পুরস্কার পরমবীর চক্র, অশোক চক্রের বিজেতারা অংশ নেয়। 

ফ্রান্সের ৯৫ জন এবং ফ্রান্সের ব্যান্ডের ৩৩ জন সদস্য এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছে। ভারতের সামরিক সক্ষমতাও প্রদর্শন করা হয় এবারের প্যারেডে যার মধ্যে ছিল ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী নাগ মিসাইল, টি ৯০ ভিষ্ম ট্যাঙ্ক, স্বাতী রেডার, সমস্ত ভূমিতে যাতায়াতে সক্ষম সামরিক গাড়ি, পিনাকা রকেট লঞ্চার সিস্টেম। ইসরোর চন্দ্রযান ৩ এর চাঁদে সফট ল্যান্ডিংও প্রদশর্ন করা হয় এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসের প্যারেডে। ভারতীয় বায়ুসেনার ছয়টি রাফায়েল যুদ্ধবিমান মারুত ফর্মেশনে অংশ নিয়েছিল এবার। এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসে ৭৭,০০০ মানুষ উপস্থিত ছিল যার মধ্যে ৪২,০০০ সাধারন ব্যক্তি ছিল। প্রত্যেক বছরেই ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে একজন মুখ্য অতিথি আমন্ত্রিত থাকেন যেমন এবারের প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতের মুখ্য অতিথি ছিল ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি ইমানুয়েল ম্যাক্রোন। 

১৯৫৫ সালে ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে যখন রাজপথে সর্বপ্রথম কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয় সেই বছর প্রধান অতিথি হিসাবে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মালিক গোলাম মহম্মদকে আমন্ত্রন করা হয়েছিল। ভারতের রাষ্ট্রপতি উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই এই প্যারেড শুরু করা হয়। প্যারেডে ২১ বন্দুকের স্যালুট দেওয়া হয়। আসলে ২১টি কামান থেকে গোলা ছোঁড়া হয় ভারতের স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবস, রাষ্ট্রপতি, তিন বাহিনীর সর্বোচ্চ নেতা সহ গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তিদের সম্মানে। তবে একসাথে ২১টি কামান ফায়ার করা হয়না। সাতটি কামান তিন রাউন্ড ফায়ার করে। তবে ২১টি কামানই ফায়ার করা হয় কারন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ৫২ সেকেন্ডের। এক একটি কামান ফায়ার করতে ২.২৫ সেকেন্ড সময় লাগে, এই হিসাবে ২১টি কামান ফায়ারিংএ ৫২ সেকেন্ড সময় লাগে। তবে এই ধরনের স্যালুটে যে গোলা ব্যবহার করা হয় তাতে কোনও বিস্ফোরক থাকেনা, এটি ফাঁকা থাকে শুধু ফায়ার করলে শুধু শব্দ হয় ও ধোঁয়া তৈরি হয়। এই কামান ব্যবহারের জন্য একটি বিশেষ সেনাদল থাকে যাতে ১২২ জন করে সদস্য থাকে, এই সেনাদলের মুখ্য কার্যালয় মিরাটে অবস্থিত। এই যে সাতটি কামান ব্যবহার করা হয় এগুলো ভারতীয় নৌবাহিনীর যাদের নাম ২৫ পন্ডারস, এগুলো ১৯৪১ সালে তৈরি হয়েছিল। প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ শুরু হয় সকাল দশটার সময় কিন্তু সমস্ত অংশগ্রহনকারীরা রাত দুটোর মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় এবং কর্তব্য পথে রাত তিনটের মধ্যেই এসে উপস্থিত হয়। এই পুরো প্যারেডের প্রস্তুতি আগের বছর জুলাই মাস থেকেই শুরু হয়ে যায়, ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই সমস্ত অংশগ্রহনকারী দিল্লিতে এসে উপস্থিত হয়ে যায়। ২৬ জানুয়ারি প্যারেডের আগে প্রায় ৬০০ ঘন্টা প্রশিক্ষন করে ফেলে প্যারেডে অংশগ্রহনকারীরা।  

প্রজাতন্ত্র দিবস হিসাবে পালিত ২৬ জানুয়ারি দিনটিতে ভারতীয় সংবিধান কার্যকরী হওয়া ছাড়াও বিশ্বের ইতিহাসে ২৬ জানুয়ারি দিনটি গুরুত্বপূর্ন। ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে ২৬ জানুয়ারি তারিখে ভারত সহ গোটা বিশ্বে কিছু গুরুত্বপূর্ন ঘটনা ঘটেছিল।

ভারতে ২৬ জানুয়ারি ঘটা কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা :– 

১) ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি :— ১৯৫০ সালে যখন ভারতের সংবিধান কার্যকর করা হয় তখন ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদকে স্বাধীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করা হয়। চক্রবর্তী রাজাগোপালচারী, যিনি রাজাজি নামেই পরিচিত ছিলেন, ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ছিলেন এবং শেষ গভর্নর জেনারেলও তিনি ছিলেন। ভারত বিভিক্ত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সময় তিনি পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর ছিলেন। জুন, ১৯৪৮ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে চক্রবর্তী রাজাগোপালচারীকে ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করে যান। 

২৬ জানুয়ারি, ১৯৫০ সালে ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল হিসাবে চক্রবর্তী রাজগোপালাচারী ইস্তফা দেয়। এরপর ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন।

২) ১৯৬৩ সালে এই দিনেই আলোচনা হয় ময়ূরকে ভারতের জাতীয় পাখি হিসাবে ঘোষনা করার।

৩) কচ্ছের ভূমিকম্প :— ২৬ জানুয়ারি, ২০০১ সালে গুজরাটের ভুজে সকাল ৮:৪৬ নাগাদ ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। ৭.৬  এই ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল কচ্ছ জেলার ছোবারি গ্রামের নয় কিলোমিটার দক্ষিন পশ্চিমে। এই ভয়াবহ ভূমিকম্পে ১৩,০০০ থেকে ২০,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং ১,৬৬,৮০০ জন আহত হয়েছিল। 

৪) হুমায়ুনের মৃত্যু :— ২৬ জানুয়ারি, ১৫৫৬ সালে মৃত্যু হয়েছিল মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের। ২৪ জানুয়ারি, ১৫৫৬ সালে হুমায়ুন তার লাইব্রেরির ছাদে বসেছিল, এই ভবনটিকে সেসময় দিন পানাহ বা শের মন্ডল বলা হত। সন্ধ্যার সময় পাশের মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি শুনতে পেয়ে তিনি মসজিদে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথার খুলিতে আঘাত লাগে এবং ২৬ জানুয়ারি তার মৃত্যু হয়।

৫) ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি সত্যমেব জয়তে অনুযায়ী অশোক স্তম্ভকে ভারতের জাতীয় স্তম্ভ হিসাবে ঘোষনা করা হয়। 

৬) অমর জাওয়ান জয়তি:— ১৯৭১ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে বীরগতিপ্রাপ্ত ভারতীয় সেনাদের স্মরনে ২৬ জানুয়ারি, ১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে ইন্ডিয়া গেটের সামনে অমর জাওয়ান জয়তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

৭) ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে পূর্ন স্বরাজ ঘোষনা করেছিল। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রতিবছর এই দিনটিকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস হিসাবে পালন করা হত।

২৬ জানুয়ারি বিশ্বব্যাপী ঘটা কিছু গুরুত্বপূর্ন ঘটনা:— 

১) ১৮৮৭ সালে প্যারিসের বিখ্যাত আইফেল টাওয়ার নির্মানকাজ শুরু হয়।

২) ১৩৪০ সালে এই দিনে ইংরেজ রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ডকে ফ্রান্সের রাজা ঘোষনা করা হয়।

৩) ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের মতোন অস্ট্রেলিয়াও ২৬ জানুয়ারি দিনটিকে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দিবস হিসাবে পালন করে। এই দিনে ১৭৮৮ সালে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন আর্থুর ফিলিপ সিডনি কোভে ব্রিটেনের জাতীয় পতাকা ইউনিয়ন জ্যাক উত্তোলন করে। নিউ সাউথ ওয়েলসকে এইদিন ব্রিটিশ কলোনি হিসাবে ঘোষনা করা হয়। তখন থেকে এই দিনটি অস্ট্রেলিয়ান দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।

৪) ৩১০৬ ক্যারেট ওজন বিশিষ্ট বিশ্বের সবচেয়ে বড় হীরে কুল্লিন্যানকে ১৯০৫ সালে ২৬ জানুয়ারির দিনই খুঁজে পাওয়া যায় দক্ষিন আফ্রিকাতে। 

৫) ১৯৪২ সালে ২৬ জানুয়ারি ইউরোপের উত্তর আয়ারল্যান্ডে প্রথম আমেরিকান সেনা ল্যান্ড করে। 

৬) ২০০৪ সালে ২৬ জানুয়ারি তারিখে ভারতের মতো আফগানিস্তানেরও নতুন সংবিধানে সই করেন দেশটির রাষ্ট্রপতি হামিদ কারজাই। 

Leave a Reply

Your email address will not be published.