ভারতবর্ষের সড়ক সমস্যা মেটাতে বিরাট পদক্ষেপ মোদী সরকারের
ভারতের সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য ভারত সরকারের একটি উচ্চাকাঙ্খী প্রজেক্ট হল ভারতমালা। এই প্রজেক্টের প্রথম ধাপে ভারতে ২৪,৫০০ কিলোমিটার সড়ক ও ন্যাশনাল হাইওয়ে ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বা এনএইচডিপির আওতায় ১০,০০০ কিলোমিটার লম্বা সড়ক তৈরির কাজ ২০১৭ সালে শুরু হয়। কোনও দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো মজবুতের জন্য সবচেয়ে আবশ্যক দেশটির সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা, রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ও জাহাজ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন কারন উৎপাদন কেন্দ্র থেকে এবং বন্দর থেকে নির্দিষ্ট কেন্দ্রে যত তাড়াতাড়ি পন্য পৌঁছাবে ততই সেই দেশটির অর্থনৈতিক ভিত মজবুত হবে কারন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে পরিবহন খরচ অনেক কমে যায়। ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পর থেকে ভারতের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা, রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, বন্দর ও জাহাজ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য একাধিক প্রজেক্ট শুরু করেছে যার মধ্যে অন্যতম এই ভারতমালা প্রজেক্ট যার মাধ্যমে শুধু ভারতের অর্থনীতিই মজবুত হবেনা বরং ভারতের আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত হবে।
বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে ভারতের যার দৈর্ঘ্য ৬২,১৫,৭৯৭ কিলোমিটার। কিন্ত এর মধ্যে ভারতের জাতীয় সড়ক মাত্র ২ শতাংশ বা ১,১০,০০০ কিলোমিটার। জাতীয় সড়কের মাধ্যমে ভারতের ৪০ শতাংশ পন্য পরিবহন হয়। ভারতমালা প্রজেক্টে জাতীয় সড়কের দৈর্ঘ্য অনেকটাই বাড়ানো হচ্ছে এবং জাতীয় সড়ক দিয়ে পন্য পরিবহন ৪০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৮০ শতাংশ করা হচ্ছে। ২০১৪ সালে হাইওয়ে নির্মানের জন্য ভারত সরকারের সড়ক পরিবহন মন্ত্রকের অধীনে এনএইচআইডিসিএল বা ন্যাশনাল হাইওয়েস এন্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড সংস্থা তৈরি করা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবর ভারতমালা প্রজেক্টের অনুমোদন দেয়। এনএইচডিপির পর ভারতমালাই ভারতের দ্বিতীয় দীর্ঘতম হাইওয়ে প্রজেক্ট। এনএইচডিপিতে ৫০,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী এই প্রজেক্টের সূচনা করেছিল। ভারতমালা প্রজেক্ট ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সড়ক তৈরির পাশপাশি সীমান্তবর্তী এলাকাতেও পন্য পরিবহন সুবিধার জন্য উপযুক্ত সড়ক তৈরি করা হচ্ছে। ভারতমালা প্রজেক্টের মাধ্যমে ভারতের ৫৫০টি জেলার সদর দপ্তরকে চার লেন বিশিষ্ট সড়ক মাধ্যমে যুক্ত করা হবে। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে ৮০ শতাংশ পন্য পরিবহন জাতীয় সড়কের মাধ্যমে হবে। প্রচুর, সেতু, টানেল, রিংরোড, বিকল্প পথ নির্মান করা হচ্ছে ভারতমালা প্রজেক্টে যাতে কোনওরকন যানজট ছাড়াই পন্য পরিবহন অনেক সহজ হয়৷ ভারতমালা প্রজেক্টে মূলত প্রত্যন্ত অঞ্চল এবং ভারতের স্যাটেলাইট শহর যেমন হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোর, পুনেকে সংযুক্ত করার কাজ চলছে। এই প্রজেক্টে মোট ৮৬,৬৭৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মানের কাজ চলছে যাতে মোট ১০.৬৩ লাখ কোটি টাকা বা ১৩০ বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে। ২০২২ সালের মার্চ মাসের তথ্য অনুযায়ী ভারতমালা প্রজেক্ট হচ্ছে ভারত সরকারের সবচেয়ে বড় সড়ক নির্মান প্রজেক্ট। এই প্রকল্পে ঠিক করা হয় প্রথমে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানাতে সড়ক নির্মান করা হবে, এরপর হিমালয় অঞ্চল যেমন জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড হয়ে উত্তরপ্রদেশ, বিহারের সীমান্তে সড়ক তৈরি করা হবে। তারপর পশ্চিমবঙ্গ, সিকিম, আসাম, অরুনাচল প্রদেশ হয়ে মনিপুর ও মিজোরামে ইন্দো মায়ানমার সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক নির্মান করা হবে। এছাড়া এই প্রজেক্টে উপজাতীয় ও অনগ্রসর এলাকা সহ দূর-দূরান্তের সীমান্ত এবং গ্রামীন এলাকায় সংযোগ স্থাপনের উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।
ভারতমালা প্রজেক্টে বিভিন্ন প্রকল্পে প্রতিদিন অন্তত একশো মিলিয়ন লোক কাজ করছে এবং এই প্রজেক্টে সরাসরি ২২ মিলিয়ন কর্মসংস্থান হচ্ছে। ভারতমালা প্রজেক্টের প্রথম ধাপে ৩৪,৮০০ কিলোমিটার সড়ক নির্মান করা হচ্ছে। এনএইচডিপি ১০,৫৭৪ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক, ৯০০০ কিলোমিটারের অর্থনৈতিক অঞ্চল, ৬০০০ কিলোমিটারের বিশেষ সড়ক, ৫০০০ কিলোমিটার জাতীয় করিডর, সীমান্তবর্তী এলাকা ও আন্তর্জাতিক সংযোগের জন্য ২০০০ কিলোমিটার সড়ক, উপকূলীয় অঞ্চল ও বন্দরে সংযোগের জন্য ২০০০ কিলোমিটার সড়ক এবং ৮০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান চলছে ভারতমালা প্রজেক্টের প্রথম ধাপে। ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ঘোষনা করেছিলেন ভারতমালা প্রজেক্টে ৩.৩ লাখ কোটি টাকায় তেরো হাজার কিলোমিটারের বেশী সড়ক নির্মান সম্পন্ন হয়েছে। ভারতমালা প্রজেক্টকে সাতটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে যখন প্রজেক্ট শুরু হয় তখন প্রতিদিন ১৮ কিলোমিটার গড়ে রাস্তা নির্মান করা হচ্ছিল। ২০১৭ সালে এই প্রজেক্ট শুরু করার সময় লক্ষ্য ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২২ এর মধ্যে প্রজেক্ট সম্পন্ন করা কিন্ত এই প্রজেক্ট সম্পন্ন হতে আরও কিছু সময় লাগবে কারন করোনা মহামারী ও জমি অধিগ্রহনের সময় লাগায় এই প্রজেক্টেও দেরী হয়েছে। ২০২৭ সালের মধ্যে ভারতমালা প্রজেক্টের প্রথম ধাপ সম্পূর্ন হয়ে যাবে।
গতবছর ফেব্রুয়ারী মাসেই কেন্দ্রীয় সড়ক মন্ত্রক ভারতমালা প্রজেক্টের দ্বিতীয় ভাগ শুরু করবার ঘোষনা করেছিল। ভারতমাতার দ্বিতীয় ধাপে তিন ট্রিলিয়ন রুপিতে ৫,০০০ কিলোমিটার লম্বা এক্সপ্রেসওয়ে, হাইওয়ে তৈরি করা হবে। ভারত ইতিমধ্যেই বেশ কিছু বিশ্বমানের সড়ক পরিকাঠামো তৈরি করেছে যার বড় উদাহারন দিল্লি মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়ে। ১,৩৫০ কিলোমিটার লম্বা আট লেন বিশিষ্ট এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মানে নব্বই হাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আগে দিল্লি থেকে সড়কপথে মুম্বাই যেতে ২৪ থেকে ২৫ ঘন্টা সময় লাগতো কিন্ত বর্তমানে এই এক্সপ্রেসওয়েতে গড়ে ১২০ কিলোমিটার প্রতিঘন্টা গতিতে মাত্র বারো ঘন্টায় দিল্লি থেকে মুম্বাই পৌঁছানো সম্ভব। এই ধরনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মানের ফলে বহু শহরে অতিরিক্ত যানজট সমস্যার সমাধান হয়েছে, সাথে সাথে পন্য পরিবহনে আরও গতি এসেছে। ভারতে পন্য পরিবহনে অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় অনেক বেশী খরচ হয় কারন দীর্ঘক্ষন যানজটে আটকে থাকার কারনে গাড়িতে তেল বেশী খরচ হয়। কিন্ত এই ধরনের এক্সপ্রেসওয়ে, হাইওয়ে নির্মানের ফলে পন্য অতি দ্রুত বিমানবন্দর, বন্দরে পৌঁছানো সম্ভব যাতে বানিজ্যে আরও গতি আসবে। তাছাড়া এক্সপ্রেসওয়ে, হাইওয়ে নির্মান করলে পরিবহন ব্যবস্থার সুবিধার জন্য এক্সপ্রেসওয়ের আশেপাশে শিল্পাঞ্চল তৈরি হবে। প্রথমে ভারতমালা ২.০তে ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে সহ সতেরোটি করিডর যার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ৮,১০০ কিলোমিটার, যাতে ৩.৬৬ ট্রিলিয়ন রুপি খরচ হত কিন্তু আপাতত ৫,০০০ কিলোমিটার সড়ক তৈরি হচ্ছে ভবিষ্যতে আরও অন্যান্য প্রজেক্ট যুক্ত করা হবে।
ভারতমালা ২.০তে ২,৫৬০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ছয়টি এক্সপ্রেসওয়ে তৈরিতে মূল লক্ষ্য রাখা হচ্ছে। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ খড়গপুর কলকাতা এক্সপ্রেসওয়ে, ২২০ কিলোমিটার লম্বা পুনে আহমেদনগর ঔরঙ্গাবাদ এক্সপ্রেসওয়ে, ৩১০ কিলোমিটার চেন্নাই তিরুচিরাপল্লী এক্সপ্রেসওয়ে, ৫১৫ কিলোমিটার ইন্দোর মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়ে, মুম্বাই-দিল্লি এক্সপ্রেসওয়ের বাকী নির্মিয়মান অংশ, ৬৫০ কিলোমিটার বারানসী রাঁচি কলকাতা এক্সপ্রেসওয়ে এবং ৭৪৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পুনে বেঙ্গালুরু এক্সপ্রেসওয়ে তৈরির মাধ্যমে ভারতমালা ২.০ ভারতের সড়ক নেটওয়ার্ককে আরও বিশ্বমানের করে তুলবে। ভারতমালা প্রজেক্টের কেন্দ্রীয় সরকার নির্দিষ্ট বাজেট দিয়েছে, তার পাশপাশি টোল ট্যাক্স থেকে প্রাপ্ত অর্থ এবং পেট্রোল ও ডিজেলের উপর কীছু কর আরোপ করে সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ এই প্রজেক্টে দেওয়া হচ্ছে। ভারতমালা প্রজেক্টে লক্ষ্য ছিল পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতের সড়ক নেটওয়ার্কের আধুনীকরন এবং পুরোনো সমস্ত সড়ক নির্মান প্রজেক্ট সম্পন্ন করা। ভারতমালা প্রজেক্ট সম্পূর্ন হলে ভারতে সড়ক ব্যবস্থা, যাত্রী ও পন্য পরিবহন ব্যবস্থা চীন, ইউরোপের উন্নত দেশগুলোর মতোই আধুনিক হয়ে যাবে।