ফিচার আর্টিকেল

পাকিস্তানে জল সরবরাহ বন্ধ করতে চলেছে ভারত

বিশ্বে জলের ভান্ডার রয়েছে ১.৪ বিলিয়ন কিউবিক মিটার যার মধ্যে পানীয় জল রয়েছে মাত্র ২.৪ শতাংশ। বিশ্ব উষ্ণয়ন, শিল্প ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারনে বিশ্বে পানীয় জলের চাহিদা দেখা দিয়েছে। এইজন্য বলা হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কখনও হলে তা পানীয় জলের জন্যই হবে। ভারতের পরম শত্রু পাকিস্তান তার জলের চাহিদা মেটায় ভারত থেকেই। সিন্ধু নদী ও তার উপনদীগুলি ভারত হয়েই পাকিস্তানে প্রবেশ করে পরে আরব সাগরে মিশেছে। পাকিস্তান সিন্ধু নদীর উপরেই সবচেয়ে বেশী নির্ভরশীল। পাকিস্তান বারবার ভারতে নাশকতা করার চেষ্টা করা সত্ত্বেও মানবিক খাতিরে ভারত কখনও পাকিস্তানে জল সরবরাহে সমস্যা করেনি। উপরন্তু ভারতের ভাগে থাকা নদীর জলও পাকিস্তানে গেছে দীর্ঘদিন। তবে এবার জম্মু ও কাশ্মীরে চাষের জন্য পাকিস্তানের দিকে রাভি নদীর জল পাঠানো বন্ধ করতে চলেছে ভারত। সিন্ধু জল বন্টন চুক্তি অনুযায়ী রাভি নদী ভারত পেয়েছিল কিন্তু এতদিন সম্পূর্ন ভাবে রাভি নদীর জল ভারত ব্যবহার করতে পারছিলোনা, রাভি নদীর জল কিছুটা পাকিস্তানের দিকে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু রাভি নদীর উপর বাঁধ নির্মান সম্পূর্ন হওয়ায় এবার সম্পূর্ন জলই ভারতে থাকবে। সিন্ধু নদীর একটি উপনদী রাভি নদী বা ইরাবতী নদী হিমাচল প্রদেশ থেকে উৎপন্ন হয়ে পাঞ্জাব, জম্মু কাশ্মীর হয়ে তার একটি ধারা পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। এই প্রবাহধারা আটকানোর জন্যই পাঞ্জাব ও জম্মু কাশ্মীরের সীমনায় রাভি নদীর উপর সাহাপুরকান্ডি ব্যারেজ তৈরি করা হয়েছে যার কারনে রাভি নদীর জল সম্পূর্ন ভারতেই থেকে যাচ্ছে, পাকিস্তানের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে না আর। 

নদীকে মানব সভ্যতার মেরুদণ্ড বলা হয়। মানব সভ্যতার আদিকাল থেকেই নদীকে কেন্দ্র করে সমস্ত সভ্যতা গড়ে উঠেছে। ঋগ্বেদের নদী সুক্তাতে পূর্বে গঙ্গা থেকে পশ্চিমে কুভা পর্যন্ত একুশটি নদীর কথা জানা যায়। কাবুল নদীকেই ঋগ্বেদে কুভা বলা হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এমনই একটি গুরুত্বপূর্ন নদী হল সিন্ধু, বাল্মিকী রামায়নে যাকে মহানদী বলা হয়েছে এবং জৈন গ্রন্থে জম্বুদ্বীপ প্রয়াপ্তি বলা হয়েছে। সিন্ধু নদীকে প্রাচীন গ্রীক ভাষায় সিনঘোস বলা হয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা মহেঞ্জোদারোর কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই সিন্ধু নদী। তিব্বতের কৈলাশ পর্বতের বোখার চু হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়েছে সিন্ধু নদী। বোখার চু হিমবাহের কাছেই হিন্দু ধর্মের অতি পবিত্র মানস সরোবর রয়েছে যেখান থেকে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ন নদী ব্রহ্মপুত্র ও শতুদ্র উৎপন্ন হয়েছে। তিব্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে ২,৮৮০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে সিন্ধু নদী আরব সাগরে গিয়ে মিশেছে। ভারতে সিন্ধু নদীর দৈর্ঘ্য ১,১১৪ কিলোমিটার। সিন্ধু নদীকে তিব্বতে সেনগি চু বা সিংহ নদী অথবা সিনগি খামবাই বা সিংহের মুখ নামে ডাকা হয়। তিব্বতে ৩২০ কিলোমিটার প্রবাহিত হওয়ার পর এই নদী লাদাখ হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। ডেমচক নামক জায়গা হয়ে ভারতে প্রবেশের পর সিন্ধু নদী কারাকোরাম উপত্যকা ও লাদাখ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কার্গিল হয়ে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে প্রবেশ করেছে। পাকিস্তানের করাচি হয়ে সিন্ধু নদী আরব সাগরে গিয়ে মিশেছে। সিন্ধু নদী পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় নদী এবং এই নদীকে পাকিস্তানের জাতীয় নদীও বলা হয়। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় নদী হওয়ায় পাকিস্তানের জনজীবন সিন্ধু নদীর উপর সবচেয়ে বেশী নির্ভরশীল। তিব্বত থেকে উৎপন্ন হয়ে সিন্ধু নদী ভারত হয়ে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের দিকে যাওয়ায় এই নদী দুই দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। জম্মু কাশ্মীর সহ পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে জলের প্রধান উৎস এই সিন্ধু নদী ও তার উপনদী গুলিই। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জম্মু কাশ্মীর সিন্ধু নদী ও তার উপনদীগুলির ব্যবহার নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যা তৈরি হয়। এই কারনে ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আয়ুব খানের মধ্যে করাচিতে সিন্ধু জল চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই জল বন্টনকে সবচেয়ে সফল চুক্তি বলা হয়। সিন্ধু নদীর জল বন্টনকে কেন্দ্র করে হওয়া এই চুক্তি অনুযায়ী পূর্বদিকের তিনটি নদী বিয়াস বা বিপাশা, রাভি বা ইরাবতী এবং শতলুজ বা শতদ্রু নদী ভারতকে এবং পশ্চিম দিকের তিনটি নদী সিন্ধু, চন্দ্রভাগা বা চেনাব ও ঝিলাম বা বিতস্তা নদীকে পাকিস্তানকে দেওয়া হয়। বিপাশা, রাভি ও শতদ্রু নদী থেকে প্রতিবছর ৪১ বিলিয়ন কিউবিক মিটার জল পাওয়া যায়। কিন্তু ভারত প্রতিবছর এতটা জল ব্যবহার করতে পারতোনা, কারন নদীর জল সম্পূর্নভাবে ব্যবহারের জন্য বাঁধ নির্মান প্রয়োজন যা এতদিন পর্যন্ত ছিলনা। এই কারনে পূর্বাঞ্চলীয় নদীর গুলির বিশেষ করে রাভি নদীর বেশ কিছুটা জল পাকিস্তানের দিকে চলে যেত। পশ্চিমের নদীগুলি থেকে প্রতিবছর ৯৯ বিলিয়ন কিউবিক মিটার জল পাওয়া যায়। কিন্ত পশ্চিমের তিনটি নদী সিন্ধু, চেনাব ও ঝিলাম ভারত হয়ে পাকিস্তানে গেছে, এই কারনে সিন্ধু জলবন্টন চুক্তি অনুযায়ী ভারত এই তিনটি নদীর ৩০ শতাংশ জল ব্যবহার করতে পারবে কৃষিকাজ, পরিবহন বা জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে কিন্তু জলের প্রবাহকে ধরে রাখতে পারবেনা। বাকী ৭০ শতাংশ জল পাকিস্তান ব্যবহার করে। এই ঝিলাম নদীর উপরই তৈরি করা হয়েছে কিষানগঙ্গা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এই ঝিলাম নদীকে ঋগ্বেদে বিতস্তা বলা হয়েছে। গ্রীক সাহিত্যে এই নদীকে হাইদেসপেস বলা হয়। 

৩২৬ বিসিতে এই হাইদেসপেস নদীর তীরেই আলেকজান্ডার ও পুরুর যুদ্ধ হয়েছিল। পূর্ব পশ্চিম উভয় নদীর ক্ষেত্রেই পাকিস্তান নদীর নিম্নধারায় অবস্থিত যার কারনে পাকিস্তান আশঙ্কায় থাকে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারত বন্যা বা খরা তৈরি করতে পারে পাকিস্তানে। সিন্ধু জল চুক্তির সময় একটি স্থায়ী কমিশন তৈরি করা হয়েছিল যাতে উভয়দেশেরই প্রতিনিধি ছিল। এই প্রতিনিধি দল প্রতিবছর এই চুক্তি সম্পর্কিত ব্যাপার পরীক্ষা করে। ভারত পাকিস্তান বারংবার যুদ্ধের সময়েও এই চুক্তি অক্ষুন্ন ছিল। এতদিন ভারত পূর্বের তিনটি নদীর ৯৫ শতাংশ ব্যবহার করতো বাকী ৫ শতাংশ বা প্রায় ১১৫০ কিউসেক জল পাকিস্তানে চলে যেত। কিন্তু রাভি নদীর উপর ব্যারেজ নির্মামের ফলে ওই ১১৫০ কিউসেক জল দিয়ে জম্মু ও কাশ্মীরের কাঠুয়া ও সাম্বা জেলায় ৩২,০০০ হেক্টর অতিরিক্ত জমি চাষ করা সম্ভব হবে। 

রাভি নদীর জলের প্রবাহ পাকিস্তানের দিকে আটকাতে পাঞ্জাবের পাঠানকোট জেলায় রাভি নদীর উপর তৈরি করা হয়েছে সাহাপুরকান্ডি ড্যাম। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসীমা রাও এই প্রজেক্টের সূচনা করেছিলেন। কিন্ত দীর্ঘ দুই দশক ধরে বিভিন্ন সমস্যার কারনে এই প্রজেক্ট আটকে ছিল। জম্মু কাশ্মীর ও পাঞ্জাব সরকারের মধ্যে মতবিরোধ ছিল দীর্ঘদিন এই প্রজেক্টকে কেন্দ্র করে। 

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর সমস্ত সমস্যা দূর করে এই প্রজেক্ট পুনরায় শুরু করেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডঃ জিতেন্দ্র সিংও এই প্রজেক্ট শুরু করবার দায়িত্বে ছিল। অবশেষে ২০১৮ সালে এই প্রজেক্ট শুরু হয় যা এতদিনে প্রায় সম্পূর্ন হয়ে গেছে। এই প্রজেক্টে যাতে আর কোনও বাধা না আসে সেজন্য ২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই প্রজেক্টকে জাতীয় গুরুত্ব হিসাবে ঘোষনা করেন। ৩,৩০০ কোটি টাকার এই প্রজেক্টে জম্মু ও কাশ্মীরে কৃষিকাজের প্রয়োজনীয় জলে সরবরাহের পাশাপাশি ২০৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎও উৎপাদন করা হবে। রাভি নদীর উপর এর আগেও রনজিত সাগর ড্যাম তৈরি করা হয়েছে। রনজিত সাগর ড্যামের ত্রিশ কিলোমিটার নীচে অবস্থিত এই সাহাপুরকান্ডি প্রজেক্ট রনজিত সাগর ড্যাম থেকে নির্গত জল দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। তবে এই প্রজেক্টে উৎপন্ন বিদ্যুৎ পাঞ্জাবে সরবরাহ করা হবে। ২০২৫ এর মধ্যে এই বিদুৎকেন্দ্র তৈরির প্রজেক্ট সম্পূর্ন হয়ে যাবে। রনজিত সাগর ড্যামে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। তবে জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দারা সিন্ধু জল চুক্তি খুশি নয় এখনও। 

জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দাদের কথায় পাকিস্তানকে দেওয়া তিনটি নদীর উপর তাদেরও অধিকার আছে এবং এই নদী স্থানীয় মানুষদের আরও বেশী সুবিধা দিতে পারতো। পশ্চিম দিকের তিনটি নদী বিশেষ করে ঝিলাম নদীর উপর অনেক বড় বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির পরিবেশ রয়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরে ২০,০০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ তৈরির ব্যবস্থা আছে কিন্তু বর্তমানে এখানে ৩,২৬৩ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ তৈরি করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.