অপারেশন স্টার্লিং। যেভাবে তৈরি হল পৃথিবীর সবথেকে ঘাতক গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ
১৯৫২ সালে একজন বিখ্যাত ফ্রাঙ্কো জার্মান চিত্রকলা শিল্পী চার্লস ডুভাল প্রায়ই বিভিন্ন দেশে তার চিত্রকলার প্রদর্শন করতো। সবসময় হাতে সিগার নিয়ে থাকা এই চার্লস ডুভালের চিত্রকলা মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে মিশরে খুব বিখ্যাত ছিল। মিশরের সাংস্কৃতিক মন্ত্রীর সাথে খুবই ভালো পরিচয় ছিল চার্লস ডুভালের।
১৯৫২ সালে একদিন মিশরে প্রদর্শনীর জন্য যায় চার্লস এবং মিশরে সে এতটাই বিখ্যাত ছিল যে কায়রোতে মিশরের সাংস্কৃতিক মন্ত্রীর বাড়িতেই থাকতো চার্লস, তার সামনেই অনেকসময় সরকারি গুরুত্বপূর্ন কাজের আলোচনা হত। মিশরে হওয়া প্রদশর্নীতে মিশরের সাংস্কৃতিক মন্ত্রী স্বয়ং চার্লসের দুটি ছবি কেনে যা কায়রোর জাতীয় মিউজিয়ামে আজও রাখা আছে। প্রায় ছয় মাস মিশরে থাকার পর ১৯৫২ সালেরই একরাতে মিশরের সাংস্কৃতিক মন্ত্রীর বাড়িতে আলোচনার সময় হঠাৎ চার্লসের কাছে খবর আসে প্যারিসে তার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে, সাথে সাথে সে ফ্রান্স রওনা হয়। অদ্ভুত ব্যাপার হল ফ্রান্সে পৌঁছানোর পর পুরোনো কয়েকটি বন্ধুকে মিশরে কয়েকটি চিঠি লিখেছিল চার্লস কিন্ত তারপর আর তাকে কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। মিশরের সাংস্কৃতিক মন্ত্রী সহ বড় বড় ব্যবসায়ী অনেক খোঁজার চেষ্টা করেছে কিন্তু চার্লস যেন বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছিল। আসলে চার্লস ডুভাল নামে কোনওদিন কোনও ব্যাক্তি ছিলইনা, তার আসল নাম ছিল শ্লোমো কোহেন যে ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদের একজন এজেন্ট ছিল। মিশরে গোপন মিশনে তাকে পাঠানো হয়েছিল।
১৯২১ সালে জার্মানির হ্যামবার্গ শহরে জন্ম হয় শ্লোমো কোহেনের। কিন্তু জার্মানিতে নাজি দলের উত্থানের কারনে এবং ইহুদি বিদ্বেষের কারনে তার পরিবার প্রথমে ফ্রান্স যায় এবং সেখান থেকে পরে প্যালেস্টাইন চলে আসে। ছোট থেকে চিত্রকলা তৈরিতে অসাধারন পারদর্শী ছিল শ্লোমো কোহেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল দেশ গঠনের পর তার উপর নজর পরে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ করে ডেভিড বেন গ্যুরোনের যিনি পরবর্তীকালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হন। বেন গ্যুরোন শ্লোমো কোহেনকে ইসরায়েলের গুপ্তচর হিসাবে তৈরি করে এবং নকল পরিচয় দেন চার্লস ডুভাল। মোসাদই চার্লস ডুভালকে প্যারিস সহ মধ্যপ্রাচ্যে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। বেন গ্যুরোন শ্লোমো কোহেনকে মিশর পাঠায় কারন তিনি জানতে চাইছিলেন মিশরকে রকেট তৈরির প্রযুক্তি কে দিচ্ছে। শ্লোমো কোহেন ছয় মাস ধরে কায়রোতে থেকে অনুসন্ধান করেন, বিখ্যাত চিত্রকলা শিল্পী হওয়ার ছদ্মবেশে বহু মিশরীয় ব্যবসায়ী, কুটনীতিবিদদের সাথে মেলামেশা করে তিনি জানতে পারেন মিশরকে রকেট তৈরিতে সহায়তা করছে নাজি বিজ্ঞানীরা। শুধু মিশরই নয় বরং সিরিয়া, জর্ডান সহ ইসরায়েল বিরোধী দেশগুলোকে অস্ত্র বিক্রিও করছিল নাজিরা। নাজি জার্মানরা পরম শত্রু ছিল ইহুদিদের, এই নাজিরাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের গনহত্যা করেছিল যা ইতিহাসে হলোকাস্ট নামে কুখ্যাত। নাজিসেনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে নিষ্ঠুর ভাবে ইহুদিদের গনহত্যা করেছিল। যেমন ১৯৪২ সালে নাজিবাহিনী দুই প্যালেস্টাইনি আরব হাসান সালামি ও আমিনুল হুসেমিকে নিয়োগ করে তাদের হয়ে কাজ করার জন্য। জেরুজালেমে থাকা হাসান সালামি ও আমিনুল হুসেমিকে জার্মানিতে প্রশিক্ষন দেওয়া হয় ইহুদিদের হত্যা করার উদ্দেশ্যে। নাজিসেনা হাসান ও আমিনুলকে নির্দেশ দেয় প্যালেস্টাইনে থাকা ইহুদি অঞ্চলগুলোকে চিহ্নিত করার এবং সেইসব ইহুদি অঞ্চলে জলের সরবরাহ লাইনে বিষ মিশিয়ে দেওয়ার জন্য। নাজিসেনা এই মিশনের নাম দেয় অপারেশন অ্যাটলাস। সেইমতো হাসান ও আমিনুল ইহুদিদের জল সরবরাহ লাইনে বিষ মিশিয়ে দেয় যাতে অনেক ইহুদির মৃত্যু হয়। সেসময় ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হয়নি তবে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জন্য একটি প্যারামিলিটারি দল ছিল যার নাম হাগানাহ, এই দলের প্রধান ছিল ডেভিড বেন গ্যুরোন।
১৯২০ সালে এই হাগানাহ দলটি তৈরি করা হয়েছিল এবং ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল তৈরি হওয়ার পর হাগানাহকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেন গ্যুরোন ইহুদিদের মৃত্যুর তদন্ত করে জানতে পারে এই ঘটনার পেছনে দায়ী হাসান সালামি ও আমিনুল হুসেমি। সাথেসাথে বেন গ্যুরোন সিদ্ধান্ত নেয় তাদের হত্যা করা হবে। তবে এরইমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায় এবং ব্রিটিশরা প্যালেস্টাইনের দায়িত্ব জাতিসংঘকে দিয়ে দেয়। জাতিসংঘ সিদ্ধান্ত নেয় প্যালেস্টাইনকে দুভাগে ভাগ করা হবে যার একটা ভাগ ইহুদিদের এবং অন্যভাগ আরবদের দিয়ে দেওয়া হবে। জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করে আরব দেশগুলো। তবে এসবের মাঝেও বেন গ্যুরোন হাসান ও আমিনুলকে হত্যার কথা ভোলেনি। বেন গ্যুরোন তার বন্ধু আইজার হ্যারলকে ডাকে হাসান ও আমিনুলকে হত্যার জন্য। আইজার হ্যারল অপারেশন স্টার্লিং এর কথা জানায় বেন গ্যুরোনকে। অপারেশন স্টার্লিং এর দুটো লক্ষ্য ছিল হাসান ও আমিনুলকে হত্যা করা এবং এই দুজনের সাথে যুক্ত আরব রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা।
হাগানাহের মধ্যে শাহি নামে একটি বিশেষ বিভাগ তৈরি করা হয়, আইজার হ্যারলকে এই বিভাগের প্রধান করা হয়। ১৯৪৮ সালের জুন মাসে হাসান সালামি ও আমিনুল হুসেমিকে হত্যা করে শাহি। এরপর শুরু হয় অপারেশন স্টার্লিং এর দ্বিতীয় ভাগ হাসান সালামি ও আমিনুল হুসেমির সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করা। এরজন্য হাগানাহকের মধ্যে আরও একটি গোপন বিভাগ তৈরি করা হয় যার নাম দেওয়া হয় আরব প্লাটুন। এই বিভাগে প্যালেস্টাইন আরবদের সাথে যেসব ইহুদিরা বসবাস করতো তাদের নিয়োগ করা হয় কারন তারা আরবদের আদবকায়দা সম্পর্কে জানতো। এসব ইহুদিদের প্রশিক্ষন দিয়ে মিশর, জর্ডান, সিরিয়া, সৌদি আরব সহ ইসরায়েলের শত্রু সমস্ত আরবদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যাতে তারা আরবদের মধ্যেই ছদ্মবেশে লুকিয়ে থেকে ইহুদিদের বিরুদ্ধে হওয়া সমস্ত পরিকল্পনার তথ্য বেন গ্যুরোনকে পাঠাতে পারে, সাথে সাথে হাসান সালামি ও আমিনুল হুসেমির সাথে জড়িত ব্যাক্তিদের তথ্য জানা যায়। এভাবেই বেন গ্যুরোনের নেতৃত্বে ইহুদিদের বিরুদ্ধে হওয়া অনেক ষড়যন্ত্র বানচাল করে আরব প্লাটুন। আরব প্লাটুন যখন বিভিন্ন দেশে তথ্য সংগ্রহ করছিলো তখন বেন গ্যুরোন তার আরও একটি গোপন দলের মাধ্যমে ব্রিটিশদের থেকে অস্ত্র নিয়ে আসে, ব্রিটিশরা প্যালেস্টাইন ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তাদের অধিকাংশ অস্ত্র সংগ্রহ করে বেন গ্যুরোন।
১৯৪৮ সালেই যখন ইসরায়েল গঠন নিয়ে সিদ্ধান্ত প্রায় হয়ে গেছে তখন বেন গ্যুরোন খবর পায় একদল আরব ব্যক্তি ইহুদি অধ্যুষিত অঞ্চলে বোম্ব বিস্ফোরনের পরিকল্পনা করছে। পরেরদিন যে গ্যারেজে বসে ওইসব আরব ব্যক্তিরা বোম্ব বিস্ফোরনের পরিকল্পনা করছিল হঠাৎ সেই গ্যারাজের সামনে একটি অ্যাম্বুলেন্স এসে থামে এবং কিছুসময় পর সেই অ্যাম্বুলেন্সে বিশাল বিস্ফোরন হয় যাতে গ্যারাজে থাকা ওইসব আরব ব্যক্তিরা সবাই মারা যায়। ইসরায়েল গঠন হওয়ার পর এবং ডেভিড বেন গ্যুরোন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি সর্বপ্রথম তিনটি ইনটেলিজেন্স সংস্থা তৈরি করেন, আমান যেটি ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফের গোপন সংস্থা, শিনবেথ বা শবাক যেটি ইসরায়েলের আভ্যন্তরীন নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছে এবং পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্ট। ইসরায়েলের বিদেশ মন্ত্রকের আওতায় রাখা হয় পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টকে, যার কাজ ছিল বিদেশে ইসরায়েলের শত্রুদের বিরুদ্ধে অপারেশন করা। আইজার হ্যারলকে আমানের প্রধান নিয়োগ করা হয়েছিল। কিছুসময় পর ডেভিড বেন গ্যুরোন পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টকে বিদেশ মন্ত্রকের অধীনে না রেখে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে নিয়ে আসে এবং পলিটিক্যাল ডিপার্টমেন্টের নাম পাল্টে রাখা হয় মোসাদ। এভাবেই জন্ম হয় বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্কের। ইসরায়েল তৈরির আগে থেকে ডেভিড বেন গ্যুরোন ইহুদিদের নিরাপত্তার জন্য সর্বোতভাবে চেষ্টা করে আসছে, বেন গ্যুরোনের জন্যই ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স বিভাগ এতটা উন্নত হয়েছিল। মোসাদের জন্যই ইসরায়েল আজও টিকে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা তার ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্কের, যার সূচনা হয়েছিল ডেভিড বেন গ্যুরোনের হাত ধরে।
১৯৫২ সালে কায়রো থেকে মিশন শেষ করে ফিরে আসার পর শ্লোমো কোহেনকে বেন গ্যুরোন মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিন আমেরিকা, ইউরোপে বিভিন্ন মিশনে মোসাদের ডেপুটি প্রধান হিসাবে পাঠিয়েছিল, তার কাজ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদিদের হত্যা করা নাজিদের খুঁজে বের করা। হলোকাস্টের পেছনে প্রধান দায়ী অ্যাডলফ আইখম্যানকেও আর্জেন্টিনার বুয়েনস এরিয়ার্স থেকে খুঁজে বের করার পেছনে অন্যতম কৃতিত্ব ছিল এই শ্লোমো কোহেনের।