ফিচার আর্টিকেল

বার্মা বা মায়ানমার কীভাবে ভারত থেকে আলাদা হল?

একটা সময় বার্মা বা মায়ানমার ভারতেরই অংশ ছিল, ১৮২৪ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বার্মা ব্রিটিশ ভারতেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল কিন্তু ভারত স্বাধীন হওয়ার দশ বছর আগে বার্মাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ব্রিটিশরা। ১ এপ্রিল, ১৯৩৭ সালে ইংল্যান্ডের রাজা জর্জ ষষ্ঠ ঘোষনা করে বার্মাকে ভারতীয় সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা। আজ থেকে প্রায় ৮৭ বছর আগে বার্মা ভারত থেকে আলাদা হলেও অতীতকাল থেকেই বার্মার সাথে ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিল। প্রাচীন ভারতে বার্মার অনেক অংশ স্বর্নভূমি নামেও পরিচিত ছিল। কিন্তু ভারত থেকে আলাদা হলেও বার্মা ভারতের মতো শক্তিশালী, উদার দেশ হয়ে উঠতে পারেনি।

১৭৮৫ সালে বার্মিজ রাজা আরাকান অঞ্চল আক্রমন করে এবং আরাকান দখল করে, তখন থেকেই বার্মা ভারতের প্রতিবেশী হয়। তবে এই ঘটনা ব্রিটিশরা পচ্ছন্দ করেনি, ব্রিটিশদের ধারনা ছিল একটি রাজতান্ত্রিক দেশের সাথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সীমানা থাকা উচিৎ নয়। ব্রিটিশরা ভারতেও একের পর এক রাজত্বকে পরাজিত করছিলো সেসসময়, যেমন মারাঠা, আফগান, মাইশোর সহ একাধিক শক্তিশালী রাজত্বকে পরাজিত করে ব্রিটিশরা। ১৮২৪ সালে বার্মা আসাম আক্রমন করে, এরপরেই ব্রিটিশরা বার্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে যা প্রথম অ্যাংলো বার্মিজ যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৮২৬ সালে ইয়ানদাবোর চুক্তির মাধ্যমে এই যুদ্ধ শেষ হয় যাতে বার্মাকে আসাম, মনিপুর, রাখাইন বা আরাকান, তানিনথাই উপকূলের নিয়ন্ত্রন ছাড়তে হয় ব্রিটিশদের কাছে। যদিও ১৮৩৪ সালে কাবাও উপত্যকা বার্মাকে ফিরিয়ে দেয় ব্রিটিশরা। ১৮৩৭ সালে ব্রিটিশরা পাটকাই পাহাড়কে একতরফা ভাবে উত্তর সীমান্তের সীমানা হিসাবে ঘোষনা করে। ১৮৫২-৫৩ সালে দ্বিতীয় অ্যাংলো বার্মা যুদ্ধ হয় যাতে বার্মার আরও অনেকাংশ দখল করে ব্রিটিশরা এবং ১৮৮৫ সালে আরও একটি যুদ্ধে সম্পূর্ন বার্মা দখল করে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে ব্রিটিশরা। বার্মাকে দখল করার আরও একটি কারন ছিল তাহল আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সাথে একই ভৌগলিক লাইনে রয়েছে আরাকান অঞ্চল বিশেষ করে রাঙ্গুন বন্দর। এই রাঙ্গুন বন্দর থেকে ব্রিটিশরা দক্ষিন পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে জাপান আক্রমন করতে পারতো। অনেক ইউরোপীয়ান শক্তি রাঙ্গুন বন্দর হয়েই দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ দখল করেছিল। যেমন ফ্রান্স ব্রিটিশদের সাহায্যে রাঙ্গুন বন্দর হয়েই ভিয়েতনাম দখল করেছিল। 

১৯২২ থেকে ১৯২৭ সালে ভারতে ব্রিটিশ রাজকীয় পুলিশে ছিল জর্জ অরওয়েল, যিনি বার্মিজ ডেস নামে একটি বই লিখেছিলেন যাতে তিনি ভারত ও বার্মার মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্কের কথা লিখেছেন। সেসময় ভারত থেকে প্রচুর মানুষ বার্মাতে কাজে যেত এবং বার্মা থেকেও মানুষ ভারতে কাজে আসতো। বার্মা থেকে মূলত সেগুন কাঠ ও চাল আমদানি করা হত ভারতে। বার্মিজ সেগুন কাঠের খ্যাতি ছিল জগৎ বিখ্যাত। ব্রিটিশরা ভারতে যত  স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছে যেমন কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে শুরু করে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবন, মুম্বাইয়ের প্রিন্স অফ ওয়েলস মিউজিয়াম, হায়দ্রাবাদ, চেন্নাই সহ সমস্ত জায়গায় বার্মা সেগুন কাঠের ব্যবহার করা হয়েছে। বার্মার চাল ভারতকে অনেক সময় রক্ষা করেছে। ব্রিটিশ শাসনে ভারতে বিশেষ করে বাংলা, উত্তরপ্রদেশে যখনই দুর্ভিক্ষ, খরা হয়েছিল তখন বার্মা থেকে আমদানি করা চালই ব্যবহার করেছিল মানুষকে খাদ্য সরবরাহ করতে। ভারত থেকে কয়লা ও কোক রপ্তানি করা হত বার্মাতে। রাঙ্গুনকে বন্দরের পাশপাশি জেল হিসাবেও ব্যবহার করত ব্রিটিশরা, কলকাতা বন্দর থেকে রাঙ্গুন হয়ে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের সেলুলার জেলে জাতীয়তাবাদীদের পাঠাতো ব্রিটিশরা, আবার রাঙ্গুনের জেলেও পাঠানো হত ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের যাতে তারা ভারতের মূল ভূখন্ড থেকে দূরে থাকে। 

বার্মাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করবার প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯২৭ সালে সাইমন কমিশনের মাধ্যমে। এই সাইমন কমিশনকে ঘিরে তৎকালীন ভারতে বিশাল আন্দোলন হয়েছিল, সাইমন ফিরে যাও স্লোগান বলা হত সেসময়। এই সাইমন কমিশনকে বার্মার তরফ থেকে এক রাজনৈতিক ব্যক্তি প্রস্তাব দেয় বার্মাকে ভারত থেকে আলাদা করে দেওয়া হোক। সাইমন কমিশনকে বলা হয়েছিল ভারতীয়রা যেমন জাতিগত ও ভাষার দিক থেকে ব্রিটিশদের থেকে আলাদা, ঠিক তেমনি বার্মিজরাও ভারতীয়দের থেকে জাতিগত ও ভাষাগত ভাবে আলাদা। সাইমন কমিশনের এক সদস্য ক্লেমন্ট অ্যাটলিকে এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। ক্লেমন্ট অ্যাটলি পরে ব্রিটিশ সরকারকে এই প্রতিবেদন পাঠায়। জনঘনত্বের কারনেও বার্মা ভারত থেকে আলাদা হতে চাইছিলো। ১৯২০ এর দশকে বাংলার জনসংখ্যা ছিল ৭৮ মিলিয়ন, গোটা ভারতের জনসংখ্যা ছিল ২৪৭ মিলিয়ন। সেই তুলনায় বার্মার জনসংখ্যা ছিল মাত্র মিলিয়ন যা ভারতের একটি প্রদেশের থেকেও কম ছিল। বার্মার এই ১৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার মধ্যে ১১ মিলিয়ন বৌদ্ধধর্মালম্বী ছিল। আয়তনের তুলনায় বার্মার জনসংখ্যা কম ছিল যার জন্য বার্মা ভারত থেকে আলাদা হতে চাইছিলো। ১৯২৭ সালে সাইমন কমিশনের তথ্যের উপর ভিত্তি করে ১৯৩৫ সালে নতুন আইন আনতে চলেছিলো ব্রিটিশরা যাতে বার্মাকে ভারত থেকে আলাদা করার কথা বলা হত। কিন্তু তার আগে ব্রিটিশরা বার্মাতে একটি জনভোট করায়। বার্মায় সেসময় দুটি দল ছিল বিভাজন দল ও বিভাজন বিরোধী দল। ৬৪টি আসনে ভোট হয়, ভোটের ফলে ব্রিটিশরা অবাক হয়ে যায়, দেখা যায় বার্মার অধিকাংশ মানুষ ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে না। এই নির্বাচনে বিভাজন দল ২৭টি ও বিভাজন বিরোধী দল ৩৭টি আসন পেয়েছিল। কিন্তু ব্রিটিশরা সবসময় বিভাজনের পক্ষে ছিল, সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কোনও দেশ থেকে যখনই ব্রিটিশরা তাদের শাসন প্রত্যাহার করেছে তখনই সেখানে কোনও না কোনও রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে দিয়ে গেছে যার কারনে আজও সেসব অঞ্চলে রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে, এর সবচেয়ে বড় উদাহারন ভারত পাকিস্তান সংকট, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা। ঠিক এরকমই বিভাজন বিরোধী ভোট বেশী থাকা সত্বেও ব্রিটিশরা সিদ্ধান্ত নেয় বার্মাকে ভারত থেকে আলাদা করে একটি স্বাধীন দেশ করবে। বার্মাতে বৌদ্ধ ছাড়াও কারেনস, কাচিনস, শান এবং রোহিঙ্গা নামেও কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে। বার্মা তৈরি হওয়ার সময় সংখ্যালঘু বিরোধী দাবী ছিল। বার্মাতে বর্তমানে সেনাশাসন রয়েছে, বার্মার সবচেয়ে বড় গনতান্ত্রিক নেতা আং সাং সুকী যিনি মায়ানমার বা বার্মাতে গনতন্ত্র আনবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি এখন জেলে আছে। আং সাং সুকীর বাবা আং সাং ছিলেন বার্মার সেনাবাহিনীর সদস্য তিনিও গনতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন কিন্তু ভারত বার্মার থেকে আলাদা হওয়ার দশ বছরের মধ্যে তাকে হত্যা করা হয়। ভারত ও মায়ানমারের মধ্যে ১,৬৪৩ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত রয়েছে। 

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পর যেমন ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে পরিচিতি পায়, তেমনটা কিন্তু বার্মার সাথে হয়নি। ১৯৩৭ সালে ভারত থেকে আলাদা হওয়ার পর ১৯৬২ সালে মায়ানমারে নি উইনের নেতৃত্বে সেনাশাসন শুরু হয়, যেখানে ভারতে আজ পর্যন্ত কখনও সেনাশাসন হয়নি। মায়ানমারে সময়ে সময়ে গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবার চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু বারবার সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে দেশটিতে। আং সাং সুকী জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মায়ানমারে নির্বাচনে দাঁড়ায়, তার দল নির্বাচনে জয়লাভও করে কিন্তু ব্রিটিশ নাগরিককে বিয়ে করার কারনে আং সাং সুকীকে কখনও মায়ানমারের প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হতে দেওয়া হয়নি। আং সাং সুকী মায়ানমারের বিদেশমন্ত্রী হয়েছিলেন কিন্ত আবারও সেনা অভ্যুত্থানে তাকে জেলে ভরে দেওয়া হয়। মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সাথে ভারতের নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম রাজ্যের সীমানা আছে। এই রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর মায়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচারে অনেক রোহিঙ্গারা বাধ্য হয়ে ভারত ও বাংলাদেশে পালিয়ে আসে, যার জন্য আজও ভারতে বিশেষকরে বাংলাদেশে প্রচুর পরিমানে রোহিঙ্গা শরনার্থী রয়েছে। মায়ানমারে রাখাইন রাজ্য সহ বেশ কিছু প্রদেশে অন্তত পনেরোটি সন্ত্রাসী সংগঠন রয়েছে যারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে বিশেষকরে ১৯৯০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত চীনের সাহায্য ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলিতে অশান্তি তৈরি করবার চেষ্টা করেছিল। 

২০১৪ সালের পর থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার এই সমস্যা সমাধান করেছে। তাছাড়া ২০১৪ সালের পর মায়ানমার সেনাবাহিনীও ভারতকে সহায়তা করছে সন্ত্রাসী দমনে। ভারতীয় সংবিধানে যেমন ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসাবে ঘোষনা করা হয়েছে অর্থাৎ ভারতে সমস্ত ধর্মের, সমস্ত জাতির মানুষ সমান অধিকার পেয়েছে শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, জীবিকা নির্বাহে, নির্বাচনে সবক্ষেত্রে কিন্তু মায়ানমারে তা হয়নি যার জন্য আজও দেশটিতে সেনাশাসন রয়েছে। তাই ভারত থেকে আলাদা হয়ে মায়ানমার ভারতের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.