ফিচার আর্টিকেল

ভারতের সড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়নের জন্য তৈরি উত্তর- দক্ষিন, পূর্ব-পশ্চিম করিডর

সড়ক একটি এমন মাধ্যম যার মাধ্যমে পাহাড়, নদী, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেকোনও জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব। প্রত্যেক গ্রাম, শহর, দেশ কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য মজবুত সড়ক ব্যাবস্থা দরকার না হলে সেই অঞ্চলের আর্থিক বিকাশ ব্যাহত হয়। সড়ক ব্যবস্থা নির্মানকে উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত বলা হয়। যেদেশের সড়ক নেটওয়ার্ক যত উন্নত সেই দেশ আর্থিক ভাবে তত শক্তিশালী। আমেরিকা এবং ইউরোপের বেশীরভাগ দেশের মজবুত জিডিপির অন্যতম প্রধান ভিত্তি তাদের আধুনিক সড়ক ব্যবস্থা। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীন, জাপান, দক্ষিন কোরিয়ার সড়ক নেটওয়ার্ক ইউরোপীয়ান দেশগুলোকেও টেক্কা দেবে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যত সভ্যতা ছিল সেইসব সভ্যতাতেই নির্দিষ্ট সড়ক ব্যবস্থার প্রমান পাওয়া গেছে। ভারতেও প্রাচীনকাল থেকেই সড়ক ব্যবস্থা তৈরির প্রমান রয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার সময়েও ভারতে সড়ক ব্যবস্থার নির্দেশন পাওয়া গেছে। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময় রেলওয়ে ব্যবস্থার উপর বেশী জোর দেওয়া হয়েছিল, সড়ক ব্যবস্থার প্রতি ততটা নজর দেওয়া হয়নি। তবে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার পর প্রথম পাঁচ বছরের পরিকল্পনাতেই সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরিতে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে ভারতে বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৩.৭২ লাখ কিলোমিটার। ডিসেম্বর, ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী ভারতে জাতীয় সড়ক রয়েছে ১,৪৬,১৪৫ কিলোমিটার। ২০১৪ সালে ভারতে জাতীয় সড়ক ছিল ৯১,২৮৭ কিলোমিটার, ২০১৪ সালে বিজেপি ভারতের লোকসভা নির্বাচনে জেতার পর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার ভারতের সার্বিক উন্নয়নে একাধিক প্রজেক্ট শুরু করেছে যার মধ্যে আধুনিক সড়ক ব্যাবস্থা নির্মানও রয়েছে। ২০১৪ সালের পর থেকে বিগত নয় বছরে জাতীয় সড়কের দৈর্ঘ্য ৬০ শতাংশ বেড়েছে। ভারতে বিভিন্ন সময়ে এক্সপ্রেসওয়ে, জাতীয় সড়ক সহ আরও আধুনিক সড়ক নির্মানের জন্য একাধিক প্রজেক্ট শুরু করা হয়েছে। তবে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই ভারতমালা পরিযোজনা শুরু করে, যা ভারত সরকারের সবচেয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলা হচ্ছে। ভারতের ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতীয় সড়ক তৈরির প্রজেক্ট এই ভারতমালা পরিযোজনা যা ভারতের অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখবে। এই ভারতমালা প্রজেক্টেরই একটি অংশ হচ্ছে উত্তর- দক্ষিন ও পূর্ব- পশ্চিম করিডর নির্মান।

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর স্বপ্নের প্রজেক্ট স্বর্নালী চতুর্ভুজের অন্তর্গত এই উত্তর- দক্ষিন ও পূর্ব- পশ্চিম করিডর ভারতের সড়ক ব্যবস্থাকে মসৃন করে তুলেছে। ১০ অক্টোবর, ১৯৯৮ সালে এই প্রজেক্টের ঘোষনা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী। এই প্রজেক্টের আনুষ্ঠানিক সূচনা করে ২০০৪ সালে তৎকালীন সড়ক পরিবহন মন্ত্রী বিসি খান্ডুরি এবং অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিং। ন্যাশনাল হাইওয়েস ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট বা এনএইচডিপি প্রজেক্টের দ্বিতীয় দফার অন্তর্ভুক্ত এই করিডরে শ্রীনগর থেকে কন্যাকুমারি, কোচি, পোরবন্দর ও শিলচর পর্যন্ত ৭,৩০০ কিলোমিটার লম্বা চার লেন অথবা ছয় লেন জাতীয় সড়ক নির্মান করা হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে এই প্রজেক্টের জন্য খরচ ধরা হয়েছিল ১২.৩১৭ বিলিয়ন ডলার। স্বর্নালী চতুর্ভুজ প্রজেক্ট ও বন্দর সংযোগকারী জাতীয় সড়ক প্রজেক্টের মতোই এই উত্তর- দক্ষিন ও পূর্ব- পশ্চিম করিডর ভারতের জাতীয় সড়ক নেটওয়ার্কের গুরুত্বপূর্ন অংশ যা ভারতের শিল্প উৎপাদন কেন্দ্র, বানিজ্যক কেন্দ্র ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলোকে সংযুক্ত করবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সড়ক পরিবহন ও জাতীয় সড়ক মন্ত্রকের অধীনে জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ এই করিডর নির্মানের দায়িত্বে আছে। 

উত্তর দক্ষিন করিডরের সম্পূর্ন দৈর্ঘ্য ২,৫০০ মাইল বা ৪,০০০ কিলোমিটার। জাতীয় সড়ক ৪৪ এর মাধ্যমে উত্তর- দক্ষিন করিডর শ্রীনগর- উধামপুর- দিল্লি- গোয়ালিয়র- ঝাঁসি- নাগপুর- হায়দ্রাবাদ- ব্যাঙ্গালোর- সালেম হয়ে কন্যাকুমারীকে সংযুক্ত করছে। জাতীয় সড়ক ৫৪৪ও এই করিডরের অন্তর্ভুক্ত যা সালেম- কোয়েম্বাটোর- পালাক্কাড- কোচিকে সংযুক্ত করেছে। পূর্ব পশ্চিম করিডরের সম্পূর্ন দৈর্ঘ্য ৩,৩০০ কিলোমিটার বা ২,১০০ মাইল। জাতীয় সড়ক ২৭ এর মাধ্যমে পূর্ব- পশ্চিম করিডর পোরবন্দর- রাজকোট- কোটা- কানপুর- লক্ষনৌ- অযোধ্য- গোরখপুর- মুজাফরপুর- পূর্নিয়া- ডালখোলা- জলপাইগুড়ি- আলিপুরদুয়ার- গৌহাটি হয়ে শিলচরকে সংযুক্ত করেছে। ২০০৭ সালে এই পুরো প্রজেক্ট সম্পূর্ন হবার কথা ছিল কিন্তু নানান জটিলতায় এই প্রজেক্ট দীর্ঘদিন ধরে প্রায় পঁচিশ বছর ধরে চলছে। ২০২২ সালে সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করি পূর্ব পশ্চিম করিডরের শেষ দুটি ভাগ সম্পূর্ন করার জন্য ১,৬৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। ২০১৮ সালের ৩১ মার্চের তথ্য অনুযায়ী ৬,৮৭৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মানের কাজ হয়ে গেছে। তবে প্রায় পঁচিশ বছর পুরোনো এই প্রজেক্ট অবশেষে শেষ হতে চলেছে। আসামের ডিমা হাসাও জেলায় নারিমবাংলো, হারাঙ্গাজাও জাতিঙ্গা বিভাগে এই প্রজেক্টের শেষ দুটি ভাগ বাকী আছে, বাকী সমস্ত প্রজেক্ট প্রায় শেষ হয়েই গেছে। এই শেষ দুটি ভাগে মোট ৪৯.২৩ কিলোমিটার সড়ক নির্মান হচ্ছে যার কিছু অংশ মার্চ, ২০২৪ সালেই শেষ হয়ে যাবে। বালাছেরা হারাঙ্গাজাও অঞ্চলে আগে ৩১ কিলোমিটার লম্বা রাস্তা নির্মানের কথা ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে এই অঞ্চলে পুনরায় জরিপ করে ২৫.১৫ কিলোমিটার রাস্তা নির্মানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বন্যা, জমি ধ্বসের কারনে প্রায় ছয় কিলোমিটার অঞ্চলকে জরিপের পর বাদ দেওয়া হয়েছে। এই উত্তর- দক্ষিন পূর্ব- পশ্চিম করিডর ভারতের একটি বড় প্রজেক্ট স্বর্নালী চতুর্ভুজের অংশ যা এখন ভারতমালা পরিযোজনার অংশ। 

স্বাধীনতার পর ৭৬ বছরে ভারত সরকার আধুনিক সড়ক নির্মানের জন্য একাধিক বড় প্রজেক্ট শুরু করেছিল যার মধ্যে একটি হচ্ছে স্বর্নালী চতুর্ভুজ, যা শুরু হয়েছিল ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের আমলে। এই প্রজেক্টের লক্ষ্য ছিল জাতীয় সড়ক নির্মানের মাধ্যমে ভারতের চারকোন উত্তরে দিল্লি, পূর্বে কলকাতা, পশ্চিমে মুম্বাই ও দক্ষিনে চেন্নাইকে সংযুক্ত করা। ৫,৮৪৬ কিলোমিটার লম্বা জাতীয় সড়ক নির্মানের এই স্বর্নালী চতুর্ভুজ প্রজেক্ট বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম হাইওয়ে প্রজেক্টগুলোর মধ্যে একটি। ২০১২ সাল থেকেই শুরু হয়ে গেছে এই স্বর্নালী চতুর্ভুজ প্রজেক্টে নির্মিত হাইওয়ে। এই প্রজেক্টে চারটি মূল ভাগ রয়েছে, প্রথমেই রয়েছে দিল্লি ও কলকাতাকে সংযুক্ত করা ১,৪৫৪ কিলোমিটার লম্বা জাতীয় সড়ক ২ যা হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গকে সংযুক্ত করেছে। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে কলকাতা থেকে চেন্নাই পর্যন্ত ১,৬৮৪ কিলোমিটার লম্বা জাতীয় সড়ক যা পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুকে সংযুক্ত করেছে। তৃতীয় ভাগে চেন্নাই থেকে মুম্বাই পর্যন্ত ১,২৯০ কিলোমিটার লম্বা জাতীয় সড়ক রয়েছে যা তামিলনাড়ু, কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রকে সংযুক্ত করেছে। চতুর্থ বা শেষ ভাগে ১,৪১৯ কিলোমিটার লম্বা জাতীয় সড়ক রয়েছে দিল্লি থেকে মুম্বাই পর্যন্ত যা দিল্লি, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাট ও মুম্বাইকে সংযুক্ত করেছে। যেকোনও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ভালো রাস্তা, সমুদ্র বানিজ্য পথ এবং অন্তর্দেশীয় জলপথের মাধ্যমে। সড়ক নেটওয়ার্ক যত উন্নত হবে তত সেই দেশের পন্য পরিবহনে খরচ কম হবে এবং বানিজ্যে গতি বৃদ্ধি পবে যার ফলে অর্থনৈতিক ভাবেও শক্তিশালী হবে দেশটি। 

ভারত সরকার ভারতমালা পরিযোজনা শুরু করেছে ঠিক এই উদ্দেশ্যেই যার আওতায় আনা হয়েছে এই স্বর্নালী চতুর্ভুজ সহ উত্তর- দক্ষিন, পূর্ব- পশ্চিম করিডরও। এই ভারতমালা প্রজেক্টে গোটা দেশ জুড়ে জাতীয় সড়ক, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মান করা হচ্ছে, পুরোনো জাতীয় সড়কের দৈর্ঘ্য বাড়ানো হচ্ছে, যানজট কমানোর জন্য বিকল্প রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে, বন্দরগুলোর সাথে সংযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হচ্ছে। সাত পর্যায়ে ভারতমালা প্রজেক্ট সম্পূর্ন করা হবে, বর্তমানে এই প্রজেক্টের প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে। ১০.৬৪ লাখ কোটি টাকায় নির্মিত এই প্রজেক্ট ভারতের সড়ক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা বিশ্বমানের করে তুলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.