মহাত্মা গান্ধী সহ বিশ্বের ইতিহাসে তিনজন গুরুত্বপূর্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি যারা শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করা সত্বেও হত্যা করা হয়েছিল
কোনও কারনের জন্য বিশেষ কোনও ব্যক্তিকে হত্যা করা কারনটির কোনও সমাধান নয় কিন্তু বর্তমান বিশ্বে হিংসা ও সংঘাতের পরিমান ক্রমশ বাড়ছে। বিগত কয়েক শতাব্দীতে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয় যে বিশ্বের ইতিহাসে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা মানুষরাই হিংসার স্বীকার হয়েছেন। যেমন ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকেও গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আজীবন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস নীতিতে লড়াই করা এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ন ভূ্মিকা রাখা অন্যতম মহান ব্যক্তিত্ব মহাত্মা গান্ধীকে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি বিকেল ৫:১৭ এর কাছাকাছি সময়ে বিড়লা ভবনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল যা বিশ্বের ইতিহাসে বিশেষ করে ভারতের ইতিহাসে এক কালো দিন ছিল। সুদূর দক্ষিন আফ্রিকা থেকে এসে ভারতীয়দের পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করার জন্য নিয়োজিত মানুষটি দেশের জন্য প্রান বিসর্জন দেন। এই ঘটনায় জড়িত দুজন প্রধান ব্যক্তি নাথুরাম গডসে ও নারায়ন আপ্টেকে ফাঁসির সাজা দেওয়া হয়। গান্ধীজির দুই ছেলে মনিলাল গান্ধী ও রামদাস গান্ধী নাথুরাম গডসে ও নারায়ন আপ্টের ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আবেদন করেছিল। কিন্ত সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারি, জওহরলাল নেহেরু ফাঁসির রায়ই বহাল রাখেন। আম্বালা জেলে ফাঁসি দেওয়া হয় নাথুরাম গডসে ও নারায়ন আপ্টেকে। মহাত্মা গান্ধী ছাড়াও বিশ্বের ইতিহাসে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত তিনজন বহুল পরিচিত ব্যক্তিও হিংসার বলি হয়েছিলেন।
আব্রাহাম লিংকন:— আমেরিকার ষোলোতম রাষ্ট্রপতি ছিলেন আব্রাহম লিংকন। আটবার নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরেও তিনি রাজনীতি ছাড়েননি, অবশেষে তিনি ১৮৬১ সালে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সেসময় আমেরিকাতে ক্রীতদাস প্রথার প্রচলন ছিল। বিশেষ করে দক্ষিন আমেরিকাতে ক্রীতদাস প্রথা ব্যাপক আকারে ছিল। আফ্রিকা থেকে মানুষদের জোর করে ক্রীতদাস হিসাবে আমেরিকাতে বিক্রি করে দেওয়া হত। পুরো জীবন আব্রাহাম লিংকন এই অন্যায় ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধেই কথা বলেছিলেন। একজন আইনজ্ঞ হিসাবে আব্রাহাম লিংকন চাইতেন প্রত্যেক মানুষ স্বাধীন জীবনযাপন করুক। ১৮৬১ সালে যখন আব্রাহাম লিংকন যখন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন সেসময় আমেরিকাতে গৃহযুদ্ধ চলছিলো, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিন আমেরিকা রীতিমতো একে অপরের বিপক্ষে ছিল। আব্রাহাম লিংকনের ক্রীতদাস প্রথা বিরোধীতার সমর্থন করছিলো উত্তর আমেরিকা কিন্তু দক্ষিন আমেরিকা ক্রীতদাস প্রথা রদের বিরোধী ছিল। আব্রাহাম লিংকন ১৮৬৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারী আমেরিকাতে ক্রীতদাস প্রথা বন্ধের আইন প্রস্তাব করেন যা ৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৫ সালে আমেরিকার সব প্রদেশগুলো অনুমোদন করে। কিন্তু তার আগেই ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল আব্রাহাম লিংকনকে হত্যা করা হয়। ১৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে ফোর্ড থিয়েটারে আওয়ার আমেরিকান কাসিন দেখার সময় আব্রাহাম লিংকনের মাথায় গুলি করে দক্ষিন আমেরিকার জন উইলকস বুথ নামে এক ব্যক্তি। এই থিয়েটারের বিপরীতে অবস্থিত পিটারসেন হাউসে পরেরদিন সকাল ৭:২২ নাগাদ মাথায় আঘাতের কারনে মৃত্যু হয় আব্রাহাম লিংকনের। আব্রাহাম লিংকনই আমেরিকার প্রথম কোনও রাষ্ট্রপতি যাকে হত্যা করা হয়েছিল।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র:— যদি তুমি উড়তে না পারো তাহলে দৌড়াও, যদি তুমি দৌড়াতে না পারো তাহলে হাঁটো, যদি তুমি হাঁটতে না পারো তাহলে হামাগুড়ি দাও, কিন্তু যাই কর না কেন তোমাকে সামনে এগিয়ে যেতেই হবে, এই কথাটি বলেছিলেন আমেরিকার মহান রাজনৈতিক ব্যক্তি ডঃ মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, তাকে আমেরিকার গান্ধীও বলা হত। আমেরিকায় আফ্রিকান আমেরিকান মানুষদের উপর চামড়ার রঙের কারনে হওয়া বৈষম্যের জন্য প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। মহাত্মা গান্ধীর মতোনই তিনি প্রতিবাদের জন্য অহিংসা নীতিই গ্রহন করেন। ১৯৫৫ সালে মন্টগোমারিতে বাসে করে যাওয়ার সময় মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র লক্ষ্য করেন এক শেতাঙ্গ ব্যক্তিকে বাসে সিট ছেড়ে না দেওয়ায় এক আফ্রিকান আমেরিকান ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। এই ঘটনা তার মনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলে এবং তিনি কালো চামড়ার মানুষদের সমান অধিকারের জন্য কর্মসূচি শুরু করেন। এই ঘটনার কারনে ৩৮১ দিন ধরে আমেরিকাতে আন্দোলন হয় এবং অবশেষে আমেরিকান সরকার বাসে শেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের জন্য আলাদা আলাদা সিট রাখার নিয়ম বাতিল করে দেওয়া হয়। এরপরে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র দক্ষিন আমেরিকার খ্রীষ্টান লিডারশিপ কনফারেন্সে সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬০ এর দশকে আমেরিকারতে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের অধিকারের জন্য শান্তিপূর্ন ও অহিংস উপায়ে একাধিক প্রতিবাদ কর্মসূচি করেছিলেন তিনি। যার জন্য ১৯৬৪ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৬৭-৬৮ সালে তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও দারিদ্র্যর বিরুদ্ধে কর্মসূচি শুরু করেছিলেন কিন্তু ১৯৬৮ সালের ৪ এপ্রিল টেনিসি প্রদেশের মেমফিসে এক মোটেলে জেমস আর্ল রে নামে এক ব্যক্তি তাকে হত্যা করে। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের মৃত্যুর পর তার পরিবার স্থানীয় অপরাধী ও আমেরিকান সরকারকে তার মৃত্যুতে জড়িত থাকার অভিযোগ করেছিল। যদিও আমেরিকার সরকারের জড়িত থাকার কোনও প্রমান পাওয়া যায়নি। এই ঘটনা প্রমান করে ১৮৬৫ সালে আব্রাহাম লিংকনের মৃত্যুর পর একশো বছর ধরেও আমেরিকাতে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদেরকে শেতাঙ্গ মনুষদের মতোন সমান অধিকার দেওয়া হতনা। তবে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের জন্যই ১৯৬৫ সালে আমেরিকাতে কৃষ্ণাঙ্গরা ভোট দেওয়ার অধিকার পায়।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন:— ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনকেও হত্যা করা হয়েছিল। উত্তর আয়ারল্যান্ড রিপাবলিকানের সদস্য থমাস ম্যাকমোহন হত্যা করেছিল লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে। আয়ারল্যান্ডের বিদ্রোহ থেকে প্রভাবিত ছিল থমাস এবং আয়ারল্যান্ডের বিভাজনের জন্যও ব্রিটেনের উপর ক্ষোভ ছিল থমাসের। ভারতের স্বাধীনতার সময় ভারত থেকে যেমন পাকিস্তানকে বিভাজন করা হয় ঠিক তেমনি ব্রিটেন ১৯২১ সালে আয়ারল্যান্ডকে স্বায়ত্তশাসন দেয় কিন্তু আয়ারল্যান্ডকে উত্তর ও দক্ষিন দুই ভাগে ভাগ করে দেয়। এই কারনে ১৯৬০ এর দশক ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত উত্তর আয়ারল্যান্ডে রীতিমতো সহিংস বিক্ষোভ হয় যা দি ট্রাবলস নামে পরিচিত। ইংল্যান্ডের আরও অনেক সামরিক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা থাকা সত্বেও লর্ড মাউন্টব্যাটেনকেই নিশানা করে উত্তর আয়ারল্যান্ডের বিদ্রোহীরা কারন লর্ড মাউন্টব্যাটেন ইংল্যান্ডের প্রশাসনিক ব্যক্তি ছাড়াও ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্য ছিল। সম্প্রতি মৃত্যু হওয়া ইংল্যান্ডের রানী দ্বিতীয় ভিক্টোরিয়ার দ্বিতীয় ভাই ছিলেন তিনি। ১৯৭৯ সালের ২৭ আগস্ট লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিবার সমেত আয়ারল্যান্ডে এসেছিলেন। সেসময় কান্টি সিলিগোতে মুলাঘমোর বন্দরে তার জাহাজ ছিল, সেই লঞ্চে ৫০ পাউন্ডের গিলিগনাইট বোম্ব লাগিয়ে দেয় ম্যাকমোহন। কয়েকঘন্টা পর মাউন্টব্যাটেন যখন তার পরিবার সমেত যখন জাহাজে ছিল তখনই বোম্ব বিস্ফোরন হয় এবং এই ঘটনায় মাউন্টব্যাটেন ও তার চোদ্দ বছর বয়সী নাতি নিকোলাস ন্যাচবুলের মৃত্যু হয়। এছাড়া এনিসকিলেনের একটি কিশোর ছেলে পল ম্যাক্সওয়েল যে ক্রু হিসেবে কাজ করছিল জাহাজে তারও মৃত্যু হয়। জাহাজে থাকা অন্য চারজন মাউন্টব্যাটেনের মেয়ে প্যাট্রিসিয়া, তার স্বামী জন ন্যাচবুল, তাদের ছেলে টিমোথি (নিকোলাসের যমজ ভাই) এবং জন ন্যাচবুলের মা ডোরিন সবাই গুরুতর আহত হন। পরের দিন হাসপাতালে মারা যান ডোরিন ন্যাচবুল। আইরিশ রিপাবলিকান প্যারামিলিটারি বা আইআরএ তিনদিন পর এই বিস্ফেরনের দায় স্বীকার করে। এই বিস্ফরোনের দুই ঘন্টা আগেই ম্যাকমোহনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। উনিশ বছর পর ১৯৯৮ সালে উত্তর আয়ারল্যান্ডের সাথে ইংল্যান্ডের গুড ফ্রাইডে শান্তি চুক্তি হয় এবং তখনই ম্যাকমোহনকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৯৮ সালেই এই চুক্তির পর তিন দশক ধরে চলা দি ট্রাবেলসের অবসান হয়।