একশোর বেশী মানুষ এখনও পর্যন্ত উধাও হয়ে গেছে। অ্যামাজনের গহীন অরন্যে রহস্যময় শহর জেড
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অরন্য বলা হয় অ্যামাজন অরন্যকে। ব্রাজিল, কলম্বিয়া, পেরু, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম ও ফরাসি গায়ানা এই নয়টি দেশের ৫৫ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত অ্যামাজন অরন্যের ৬০ শতাংশ এলাকাই ব্রাজিলে রয়েছে। এই বিশাল অরন্যে ষোলো হাজার প্রজাতির প্রায় ৩৯০ বিলিয়ন উদ্ভিদ রয়েছে। এছাড়া এখানে প্রায় ৮৫ লাখ প্রজাতির কীট পতঙ্গ, প্রায় ১,২০০ প্রজাতির উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রানী রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও ভয়ানক অ্যানাকোন্ডা সাপ ও পিরানহা মাছ এই অ্যামাজনেই পাওয়া যায়। অ্যামাজন অরন্য চির রহস্যময়, অ্যামাজনের গহীন অরন্যে কত কী রহস্য লুকিয়ে আছে তা আজও অজানা আধুনিক বিশ্বের কাছে। বলা হয় অ্যামাজনের গহীন বনের কোথাও রয়েছে আস্ত এক প্রাচীন শহর যা আটলান্টিস সভ্যতার সমসাময়িক কালের। বিশ্বের ইতিহাসে এমন অনেক প্রাচীন শহরের নাম পাওয়া যায় যাদের অধিকাংশ ঐতিহাসিক গন কাল্পনিক বলে মনে করে। কিন্তু বহু মানুষের ধারনা আধুনিক মানব ইতিহাসের আগেও এমন অনেক শহর ছিল যা সময়ের সাথে লুপ্ত হয়ে গেছে। প্রাচীন আটলান্টিস সভ্যতার মতোন বলা হয় অ্যামাজনের বিশাল অরন্যে জেড নামে একটি প্রাচীন শহর ছিল। ব্রাজিলের জাতীয় পাঠাগারের ৫১২ নং পান্ডুলিপিতে বলা এই শহরের উল্লেখ রয়েছে। এক পর্তুগীজ ব্যক্তি জোয়াও দি সিলভা গুইমারেস এই পান্ডুলিপি লিখেছে বলে ধারনা করা হয়। ১৭৫৩ সাল থেকেই বহু অভিযাত্রী এই শহরের খোঁজে বারবার অ্যামাজনে গিয়েছিল কিন্ত আজ পর্যন্ত কেউ এই শহরকে খুঁজে পায়নি। বলা হয় পাথর দ্বারা নির্মিত এই শহরের সমতুল্য অন্য কোনও শহর ছিলনা। এই শহর খোঁজার জন্য সবচেয়ে বেশী চেষ্টা করেছিল এক ব্রিটিশ সার্ভেয়ার কর্নেল পার্সি হ্যারিসন ফাউসেট। তার ধারনা ছিল আটলান্টিসের অধিবাসীরাই এই শহর ধ্বংস করে দিয়েছিল। এ সম্পর্কে সবচেয়ে জনপ্রিয় মতবাদ হল আটলান্টিস সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সময় আটলান্টিসের অধিবাসীরা বিশ্বের বিভিন্ন কোনায় বসবাস শুরু করেছিল, তাদের মধ্যে কিছু অধিবাসী অ্যামাজনের গভীর অরন্যে এই শহরে বসবাস শুরু করেছিল। কর্নেল পার্সি হ্যারিসন ফাউসেট আটবার অ্যামাজনে অভিযান করেছিল এই হারিয়ে যাওয়া শহর জেড আবিষ্কার করার জন্য কিন্তু অষ্টম অভিযানের পর আর তিনি ফিরে আসেননি। তাঁর সাথে কী হয়েছিল, তিনি কি সত্যিই জেড শহর খুঁজে পেয়েছিলেন কিনা তা আজও জানা যায়নি।
প্রাচীন সভ্যতা আটলান্টিস সম্পর্কে প্রথম জানিয়েছিল গ্রীক দার্শনিক প্লেটো, এরও অনেক বছর পর ইউরোপীয়ান অভিযাত্রীরা যখন আমেরিকা এসেছিলো তখনই এধরনের পুরোনো সভ্যতা, প্রাচীন শহরের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। যেসব অঞ্চলে এসব প্রাচীন সভ্যতা বা শহরের অনুমান করা হয়েছিল সেসব অঞ্চলে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধানের জন্য যুগের পর যুগ ধরে বহু অভিযাত্রী অভিযানে গেছে। কিন্ত অধিকাংশ সময়ে দেখা গেছে এসব সভ্যতা বা শহরের অস্তিত্বের বাস্তব কোনও প্রমান নেই বরং এগুলো স্থানীয়দের দ্বারা প্রচলিত কাল্পনিক কাহিনী। কিন্ত জেড শহরের গল্পটা এখান থেকে আলাদা। জেড শহরের অস্তিত্বের যথেষ্ট প্রমান পাওয়া গেছে। কর্নেল পার্সি হ্যারিসন ফাউসেট ১৯১২ সালে অ্যামাজনের গহীন অরন্যে হারিয়ে যাওয়া এই শহরের নাম দিয়েছিল জেড। পান্ডুলিপি ৫১২তে লেখা রয়েছে ১৭৫৩ সালে কিছু পর্তুগীজ বান্দিরান্টিস অ্যামাজন জঙ্গলে একটি প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পায়। প্রাচীন সভ্যতার খোঁজে অভিযান করা মানুষদের পর্তুগালে বান্দিরান্টিস বলা হত। প্রথমদিকে এসব অভিযাত্রীরা আমেরিকা মহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে অভিযান করতো স্থানীয় আমেরিকান মানুষদের আটক করে ক্রীতদাস করবার জন্য। পরে ওইসব অভিযাত্রীরা ধনসম্পত্তি আহোরনের জন্য আমেরিকা মহাদেশে খোঁজ শুরু করে।
১৭৫৩ সালে পান্ডুলিপি ৫১২ এর লেখক জোয়াও দি সিলভা গুইমারেসের নেতৃত্বে পর্তুগীজ অভিযাত্রীরা অ্যমাজনের জঙ্গলে পাওয়া পুরোনো শহরের ধ্বংসাবশেষে একটি মূর্তি, একটি মন্দির খুঁজে পেয়েছিল, এই মন্দিরের দেওয়ালে হায়ারোগ্লিফিক্স লিপিতে লেখা ছিল। প্রাচীন মিশরে এই হায়ারোগ্লিফিক্স লিপি ব্যবহার করা হত। জোয়াও দি সিলভা গুইমারেস তার পান্ডুলিপি ৫১২তে এই শহর সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। গুইমারেসের নেতৃত্বে এই অভিযান উত্তর ব্রাজিলের বাহিয়া প্রদেশের সেরতাও অঞ্চলে হয়েছিল। কিন্ত এই শহরের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে তিনি লিখে যাননি পান্ডুলিপিতে। তিনি এই পান্ডুলিপিতে এমন অনেক তথ্য লেখেন যা সত্যিই আশ্চর্যের। একটি সোনার মুদ্রা ভর্তি ব্যাগের কথা লেখা আছে এই পান্ডুলিপিতে। ওই শহরের মন্দিরে পাওয়া যাওয়া হায়ারোগ্লিফিক্স লিপি ছাড়াও বেশ কিছু জায়গায় ভিন্ন লিপি পাওয়া গেছে যার উল্লেখ রয়েছে পান্ডুলিপিতে, এই লিপির সাথে প্রাচীন গ্রীক হরফের মিল রয়েছে। এই পান্ডুলিপিতে আরও লেখা আছে পর্তুগীজ অভিযাত্রীগন ওই শহরে বড় বড় বাক্স পেয়েছিল কিন্তু ওই সব বন্ধ বাক্স তারা খুলতে পারেনি।
ব্রাজিলের জাতীয় পাঠাগারে ওই পান্ডুলিপি ৫১২ অত্যন্ত নিরাপত্তায় রাখা হয়েছে যা খুব কম লোকেরই পড়ার অধিকার আছে। কর্নেল পার্সি হ্যারিসন ফাউসেট এই পান্ডুলিপি পরে খুবই অনুপ্রানিত হয়েছিলেন যার জন্য ১৯০৬ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে তিনি সাতবার অভিযানে গিয়েছিলেন এই শহর খুঁজে পাওয়ার জন্য। এর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য ব্রিটেনও ফিরে এসেছিলেন তিনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি জার্মানির বিরুদ্ধে পশ্চিম সীমান্তে লড়াই করছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি শুনেছিলেন চিলির জঙ্গলে থাকা এক প্রাচীন শহরের কথা তবে পান্ডুলিপি পড়ে তিনি নিশ্চিত হন ওই শহর অ্যামাজনের জঙ্গলে।
১৯১২ সালে কর্নেল পার্সি হ্যারিসন ফাউসেট তার ছেলেকে চিঠি লিখে এই শহরের ব্যাপারে জানিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন ব্রাজিলের বিভিন্ন অঞ্চলের শিলালিপি থেকে জানা যায় ওই শহরের মানুষরা প্রাচীন ইউরোপীয় ও এশিয়ান হরফকে একসাথে ব্যবহার করেছিল। তিনি আরও লেখেন মধ্য ব্রাজিলের উঁচু পার্বত্যঞ্চলের মাঝে দশ মাইল এলাকাতেই কোথাও এই শহর রয়েছে। কর্নেল ফাউসেটের মতে এই শহরের বাড়িগুলোতে কোনও জানালা ছিলনা এবং এখানকার অধিবাসীরা পশুপালন করতো। তিনি জেড শহর ছাড়াও এই শহরের দক্ষিনদিকে আরও একটি প্রাচীন শহরের ব্যাপারে তার ছেলেকে জানিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯২০ সালে একাই অ্যামাজনে এই জেড শহর খোঁজার জন্য অভিযানে এসেছিলেন তিনি কিন্ত শারীরিক অসুস্থতার কারনে এই অভিযান ব্যর্থ হয়ে যায়। এর পাঁচ বছর পর গ্লাভ এন্ড রয়েল জিওগ্রাফিক সোশাইটির অর্থায়নে তিনি পুনরায় জেড শহরের অর্থায়নে তিনি ব্রাজিলের মাতো গ্রোসোর জঙ্গলে এসে উপস্থিত হন। এবারে তার অভিযানে সঙ্গী ছিল তার বড় ছেলে জ্যাক এবং জ্যাকের বন্ধু রালে রিমেল। কর্নেল ফাউসেট অভিযান শুরু করবার আগে জানিয়েছিলেন তিনি যদি কোনও কারনে ফিরে না আসেন তাহলে তাকে খোঁজার জন্য কোনও অভিযান যেন না করা হয় কারন তিনি তার জন্য অন্য কারও জীবন বিপন্ন করতে চাননি।
১৯২৫ সালের অভিযানে তিনি ব্রাজিলের জঙ্গলে এমন এমন জায়গায় খোঁজ শুরু করেছিলেন যেখানে তিনি আগে কোনওদিন আসেননি। কিছুদিন পর কর্নেল ফাউসেট ও তার দল ডেড হর্স ক্যাম্প নামে একটি জায়গায় এসে পৌঁছায়। এখান থেকে ২৯ মে, ১৯২৫ সালে তিনি তার স্ত্রীকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এটিই ছিল তার লেখা শেষ চিঠি। এরপরে কর্নেল ফাউসেট, তার বড় ছেলে জ্যাক ও তার বন্ধু রালে রিমেলকে খুঁজে পাওয়া যায়নি কখনও। কর্নেল ফাউসেটকে খোঁজার জন্য অনুসন্ধান দলও পাঠানো হয়েছিল কিন্ত সেই দলেরও কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কর্নেল ফাউসেটের পর এই অঞ্চলে অন্তত তেরোটি অভিযান করা হয়েছিল যাতে একশোর বেশী মানুষ ছিল কিন্ত সবাই কর্নেল ফাউসেটের মতো উধাও হয়ে গিয়েছিল। কারও কোনও চিহ্ন বা মৃতদেহ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এতজন মানুষের উধাও হয়ে যাওয়ার পর অনেকরকম ঘটনা শোনা গিয়েছিল পরে। একটি মতবাদ অনুযায়ী অ্যামাজনের স্থানীয় উপজাতিরা তাদের হত্যা করেছে, আরও একটি মতবাদ অনুযায়ী ওইসব মানুষরা হয়ত সত্যিই জেড শহরে পৌঁছেছিলেন এবং সেখানেই জীবনের শেষদিন কাটিয়েছেন। তবে কর্নেল ফাউসেটের উধাও হয়ে যাওয়ার পর জিনগু নদীর তীরে কুহিকুগু নামে একটি প্রাচীন জায়গা আবিষ্কার করা হয় যেখানে কুড়িটির বেশী শহরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় যাতে আনুমানিক পঞ্চাশ হাজার লোক থাকতো। এছাড়াও দক্ষিন অ্যামাজোনিয়াতে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় যা প্রমান করে কর্নেল ফাউসেটের হারিয়ে যাওয়া শহর জেডের ব্যাপারে মতবাদ সঠিক ছিল কিন্তু অনেক চেষ্টার পরেও সেই জেড শহর আজও আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি।
২০১৬ সালে হলিউডের চিত্র নির্মাতা জেমস গ্রে দি লস্ট সিটি অফ জেড নামে একটি সিনেমাও তৈরি করেছেন এই ঘটনার উপর।