যেভাবে একজন রাশিয়ান ব্যক্তি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আটকে দিয়েছিল
জীবাশ্ম ও ডিএনএ থেকে জানা গেছে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হয়েছিল আজ থেকে প্রায় তিন লাখ বছর আগে। এখনও বহু বছর পৃথিবী মানুষের বসবাসের উপযোগী রয়েছে। তবে ইতিহাসে এমন একটি দিন এসেছিল যেদিন পুরো মানব সভ্যতা পারস্পরিক লড়াইয়ের কারনে শেষ হয়ে যেতে পারতো। দিনটা ছিল ২৭ অক্টোবর, ১৯৬২ সাল, এই দিন মানব সভ্যতা নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে রাশিয়ান নৌবাহিনীর এক অফিসার ভ্যাসিলি আরখিপভ।
৩০ জানুয়ারি, ১৯২৬ সালে মস্কোর কাছে এক কৃষক পরিবারে জন্ম হয় ভ্যাসিলি আলেকসান্দ্রোভিচ আরখিপভের। বড় হয়ে তিনি সোভিয়েত নৌবাহিনীতে যোগ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ভ্যাসিলি সোভিয়েত ইউনিয়নের হয়ে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। ১৯৪৭ সালে ভ্যাসিলি সোভিয়েত সাবমেরিন বাহিনীতে যোগ দেয় অফিসার হিসাবে। ১৯৬১ সালে তার পোস্টিং হয় হোটেল শ্রেনীর সাবমেরিন কে ১৯এ। সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি পরমানু শক্তিচালিত ব্যালিস্টিক মিসাইল সাবমেরিনকে ন্যাটো হোটেল শ্রেনীর সাবমেরিন বলতো যা ১৯৫৯ সালে তৈরি করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৬১ সালের জুলাই মাসে গ্রীনল্যান্ডের কাছে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে একটি সামরিক অনুশীলন করবার সময় কে ১৯ সাবমেরিনের পরমানু চুল্লীতে সমস্যা দেখা যায়। সাবমেরিনটি কোনওরকমে তার বেসে ফিরে যায় কিন্তু তেজস্ক্রিয় বিকিরনের কারনে সাবমেরিনের অধিকাংশ সদস্যদের দুই মাসের মধ্যে মৃত্যু হয়েছিল। এই কারনে সোভিয়েত নৌবাহিনীতে কে ১৯ সাবমেরিনকে হিরোশিমা নামে ডাকা হত সেসময়। ভ্যাসিলি আরখিপভও তেজস্ক্রিয় বিকিরনের শিকার হয়েছিল কিন্তু সে বেঁচে যায়। ১৯৬২ সালের অক্টোবর মাস মানব ইতিহাসের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন কারন এইসময় ঠান্ডা লড়াই সবচেয়ে চরমে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা একইপক্ষে মিত্রশক্তি হিসাবে যুদ্ধ করেছিল। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেই এই দুই দেশ নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমানের জন্য পারস্পরিক প্রতিযোগিতা শুরু করে যা ইতিহাসে ঠান্ডা লড়াই নামে পারিচিত যা ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চলেছিল।
১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে কিউবার মিসাইল সংকটকে কেন্দ্র করে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক সবচেয়ে খারাপ হয়। আমেরিকার ঠিক নীচে একটি ছোট দেশ রয়েছে যার নাম কিউবা। ১৯৬২ সালে আমেরিকার কিছু গোয়েন্দা বিমান কিউবার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করে কিউবাতে অনেক মিসাইল স্থাপনা রয়েছে। এই ঘটনার কারনে পুরো আমেরিকাতে শোরগোল পড়ে যায় কারন ওই মিসাইলগুলো ছিল পরমানু মিসাইল যা সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবাতে মোতায়েন করেছিল। আমেরিকা থেকে মাত্র ৯৫ মাইল দূরে কিউবাতে থাকা পরমানু মিসাইল আমেরিকার জন্য যথেষ্ট হুমকি ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের তৎকালীন ফাস্ট সেক্রেটারি নিকিতা ক্রুশ্চেভকে কিউবা অনুরোধ করেছিল এই পরমানু মিসাইল রাখবার জন্য। আমেরিকা আগে থেকেই ইতালি ও তুরস্কে জুপিটার পরমানু মিসাইল মোতায়েন রেখেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ নজরদারি শুরু করে কিউবার উপর। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার একটি গোয়েন্দা বিমান ইউ২কে কিউবাতে ধ্বংস করে দেয়। এই ইউ২ বিমানই সর্বপ্রথম কিউবাতে সোভিয়েত মিসাইল স্থাপনার ছবি তুলেছিল। আমেরিকা কিউবার কাছে ক্যারিবিয়ান সমুদ্র অবরুদ্ধ করে দেয় তাদের যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে অর্থাৎ কোনও জাহাজ আমেরিকার নৌবাহিনীর অনুমতি ছাড়া কিউবাতে প্রবেশ করতে পারতো না। এর জবাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি সাবমেরিন বহর পাঠায় ক্যারিবিয়ান সাগরে। এই বহরে বি ৫৯ নামে একটি সাবমেরিনে ছিল ভ্যাসিলি আরখিপভ যে এই পুরো সাবমেরিন বহরের নেতৃত্বে ছিল। সোভিয়েত সাবমেরিন বহরের প্রতিটি সাবমেরিনে একটি করে পরমানু টর্পেডো ছিল। সোভিয়েত নৌবাহিনী থেকে প্রতিটি সাবমেরিনের ক্যাপ্টেনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যদি কোনও কারনে মস্কোর সাথে সংযোগ করা সম্ভব না হয় তাহলে পরিস্থিতি অনুযায়ী পরমানু টর্পেডো সোভিয়েত নৌবাহিনীর অনুমতি ছাড়াই যেন ব্যবহার করা হয়। ১৯৬২ সালের ২৭ অক্টোবর আমেরিকান নৌবাহিনীর ইউএসএস বেইল যুদ্ধজাহাজের রেডারে বি ৫৯ ধরা পড়ে। আমেরিকার নৌবাহিনীর থেকে বাঁচতে বি ৫৯ সাবমেরিন সমুদ্রের এতটাই গভীরতায় চলে যায় যে সাবমেরিনটির সাথে মস্কোর সংযোগ নষ্ট হয়ে যায়, এমনকী সাবমেরিনটি আমেরিকান রেডিও স্টেশনের কোনও খবরও শুনতে পারছিলোনা। হঠাৎই সাবমেরিনের সদস্যরা শুনতে পায় তাদের আশেপাশে ডেপথ চার্জ হচ্ছে। আসলে আমেরিকার একটি যুদ্ধজাহাজ বি ৫৯ সাবমেরিনের অবস্থান বুঝতে পেরে ডেপথ চার্জ শুরু করে। ডেপথ চার্জে যুদ্ধজাহাজ থেকে সমুদ্রের গভীরতায় থাকা সাবমেরিন লক্ষ্য করে জলের নীচে গ্রেনেডের মতোন বিস্ফোরন ঘটানো হয়। ডেপথ চার্জ দুইরকমের হয় একটি ডেপথ চার্জ করা হয় সিগন্যালিং ডেপথ চার্জ যেখানে সাবমেরিনকে নির্দেশ দেওয়া হয় জলের উপরে আসার জন্য, আরেকটি ডেপথ চার্জ করা হয় সাবমেরিনটিকে ধ্বংসের জন্য। আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ সিগন্যালিং ডেপথ চার্জ করছিলো বি ৫৯কে লক্ষ্য করে। কিন্তু মস্কো ও আমেরিকা কারও সাথেই সংযোগ না থাকায় বি ৫৯ এর ক্যাপ্টেন মনে করে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সেইকারনে বি ৫৯ এর ক্যাপ্টেন ভ্যালেটিন স্যভিটস্কি পরমানু হামলার নির্দেশ দিয়ে দেয়। বি ৫৯এ যে পরমানু টর্পেডো ছিল তা জাপানের হিরোশিমাতে আমেরিকার ফেলা লিটল বয় পরমানু বোম্বের সমান শক্তিশালী ছিল। মস্কো থেকে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়াই ছিল প্রয়োজনে প্রতিটি সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন ও দ্বিতীয় ক্যাপ্টেনের নির্দেশে পরমানু হামলা করা যাবে কিন্তু বি ৫৯ এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা ছিল। বি ৫৯ এর পরমানু হামলা করতে তিনজনের অনুমতি লাগতো ক্যাপ্টেন, দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন এবং সাবমেরিন বহরের নেতৃত্বে থাকা ভ্যাসিলি আরখিপভের। ভ্যাসিলি আরখিপভ ক্যাপ্টেনকে পরমানু হামলার জন্য কিছুক্ষন অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেন পরিস্থিতি আরও ভালোকরে বোঝার জন্য। বি ৫৯ এর ক্যাপ্টেন এবং দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন দুজনেই পরমানু হামলার পক্ষে ছিল কিন্তু ভ্যাসিলি আরখিপভ এর বিপক্ষে ছিল। ভ্যাসিলি তাদের বোঝায় এটা সিগন্যালিং ডেপথ চার্জ। বি ৫৯ পরমানু শক্তিচালিত সাবমেরিন ছিলনা বরং এটি একটি ডিজেল ইলেকট্রিক সাবমেরিন ছিল। ডিজেল সাবমেরিনকে নির্দিষ্ট সময় পর জলের উপরে আসতে হয় অক্সিজেনের জন্য এবং ব্যাটারি চার্জের জন্য। ইতিমধ্যেই বি ৫৯ বেশ কয়েকদিন সমুদ্রের গভীরতায় থাকার কারনে সাবমেরিনে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল এবং ব্যাটারির চার্জ কমে গিয়েছিল। তাই ভ্যাসিলি আরখিপভের আদেশে বি ৫৯ জলের উপরে আসে এবং নিরাপদে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিরে যায়। সেদিন শুধুমাত্র ভ্যাসিলি আরখিপভের কারনে বিশ্ব পরমানু যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। যদি সেদিন বি ৫৯ থেকে পরমানু মিসাইল ছোঁড়া হত তাহলে এর বদলা নিতে আমেরিকাও সোভিয়েত ইউনিয়নকে লক্ষ্য করে পরমানু আক্রমন করতো। এমনিতেই শীতল যুদ্ধের কারনে গোটা বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার পক্ষে দুইভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, তাই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যেত যাতে মানবজাতির অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যেত, শুধুমাত্র ভ্যাসিলি আরখিপভের বুদ্ধিমত্তায় মহা বিনাশক যুদ্ধের থেকে বিশ্ব রক্ষা পায়। বলা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের কে ১৯ সাবমেরিনে যখন পরমানু চুল্লিতে সমস্যা হয়েছিল তখন ভ্যাসিলি আরখিপভের কারনেই সাবমেরিনটি বেসে ফিরে যেতে পরেছিল, তখন থেকেই সোভিয়েত নৌবাহিনীতে ভ্যাসিলি আরখিপভকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত। ভ্যাসিলি আরখিপভের উপর বিশ্বাসের কারনেই বি ৫৯ সাবমেরিনের ক্যাপ্টেন ও দ্বিতীয় ক্যাপ্টেন শেষ পর্যন্ত ভ্যাসিলি আরখিপভের কথা শুনে পরমানু আক্রমন করেনি এবং জলের উপরে এসেছিল।
বি ৫৯ সাবমেরিন যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে যায় তখন সাবমেরিনের প্রত্যেক সদস্যকে যথেষ্ট অসম্মান করা হয়। বি ৫৯ আমেরিকার যুদ্ধজাহাজের আদেশে জলের উপর উঠে আসাকে সোভিয়েত বাসীরা পচ্ছন্দ করেনি, এটা তাদের জন্য একরকম পরাজয়েরই সমান ছিল। এই জন্য ভ্যাসিলি আরখিপভ সহ বি ৫৯ সাবমেরিনের প্রত্যেক সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। তদন্তেও দেখা যায় ডিজেল সাবমেরিন হওয়ার কারনে বি ৫৯কে জলের উপরে উঠে আসা ছাড়া কোনও উপায় ছিলনা। এই জন্য বি ৫৯ এর সদস্যদের কোনও শাস্তি দেওয়া হয়নি। এরপরেও ভ্যাসিলি আরখিপভ সোভিয়েত নৌবাহিনীতেই ছিলেন। ১৯৮৮ সালে ভাইস অ্যাডমিরাল হিসাবে তিনি অবসরে যান। ১৯৯৮ সালে কিডনিতে ক্যান্সারের কারনে তার মৃত্যু হয়। বলা হয় কে ১৯ সাবমেরিনের তেজস্ক্রিয়তার কারনেই তার এই ক্যান্সার হয়েছিল। তার মৃত্যুর নয়দিন পরেই মৃত্যু হয় কে ১৯ সাবমেরিনের ক্যাপ্টেনের। আমেরিকানরা ১৯৬২ সালে হওয়া ওই ঘটনার ৫০ বছর পর ভ্যাসিলি আরখিপভের বিষয়ে জানতে পারে। যার জন্য আমেরিকা ভ্যাসিলি আরখিপভকে তার মৃত্যুর ১৯ বছর পর ফিউচার অব লাইফ সম্মান দেয় যা গ্রহন করে তার কন্যা ইলিনা এন্ড্রিউকোভা।