ফিচার আর্টিকেল

ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ন শহর অভদিভকা দখল করে নিল রাশিয়া

২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমন করে। এরপর দুই বছর কেটে গেছে কিন্ত যুদ্ধ এখনও থামেনি। এই দুই বছরে যুদ্ধের গতিমুখ পরিবর্তন হয়েছে অনেকবার, কখনও মনে হয়েছে রাশিয়া জিতবে আবার কিছুদিনের মধ্যেই ইউক্রেন জোরালো প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ হিসাবে রাশিয়া সহজেই ইউক্রেনকে পরাজিত করবে প্রথমে এটাই মনে হয়েছিল কিন্তু আমেরিকা সহ ন্যাটোর সহায়তায় ইউক্রেন যথেষ্ট প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে হটিয়ে কিছু এলাকা পুনর্দখলও করেছে। কিন্তু রাশিয়া পীছু হটেনি, ইউক্রেনের শহরগুলো একে একে দখলের জন্য রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা করছিলো। অবশেষে নয় মাস ধরে যুদ্ধের পর ইউক্রেনের একটি গুরুত্বপূর্ন শহর অভদিভকা দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। যদিও এই শহরে এখনও কিছু ইউক্রেনীয় সেনা রয়েছে তবে শহরের পূর্ননিয়ন্ত্রন রাশিয়ান সেনাবাহিনী নিয়ে নিয়েছে। 

রাশিয়া ইউক্রেনের সমস্যা ২০১৪ সাল থেকেই শুরু হয় যখন রাশিয়া ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয়। তখনই রাশিয়ার উপর বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল পশ্চিমা দেশগুলো। তবে এসব নিষেধাজ্ঞার প্রভাব রাশিয়ার উপর তেমন পড়েনি। ক্রিমিয়ার মতোই পূর্ব ইউক্রেনও রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ন।

পূর্ব ইউক্রেনীয় অঞ্চলকে ডনবাস অঞ্চল বলে। ৫৩,২০১ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিশিষ্ট এই ডনবাসের দুটি গুরুত্বপূর্ন অঞ্চল লুহানস্ক ও ডোনেতস্ক। এই ডনবাস অঞ্চল সরকারি ভাবে ইউক্রেনের হলেও এখানে বসবাসকারী অধিকাংশ লোক রাশিয়ার সমর্থক এবং তারা চায় রাশিয়া ডনবাস অঞ্চল দখল করে নিক। এই জন্য ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ইউক্রেন হয়েই আক্রমন শুরু করে রাশিয়া। অভদিভকা শহর এই ডোনেতস্ক অঞ্চলে অবস্থিত। অভদিভকা শহরের কাছেই আরও একটি শহর বাকমুটকে দখল করে রাশিয়া নয় মাস আগেই। তাই এবার অভদিভকা দখল রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে ইউক্রেন যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে নিয়ে আসবে। গত চারমাস ধরে অভদিভকাতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হচ্ছিল কিন্ত রাশিয়ান সেনাবাহিনীর তুলনায় ইউক্রেন সেনার সংখ্যা কম হওয়ায় এবং ইউক্রেন সেনাবাহিনীর অস্ত্রভান্ডার কমে যাওয়ায় ইউক্রেন সেনাবাহিনী অভদিভকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়ে অভদিভকা দখলকে গুরুত্বপূর্ন বিজয় বলেছেন। বিগত দুই বছর ধরে ইউক্রেনে যুদ্ধ করছে রাশিয়ান সেনাবাহিনী। তাই অভদিভকা দখলের ফলে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর মোনোবলও বৃদ্ধি পাবে। ভ্লাদিমির পুতিনও জানিয়েছে এই জয় রাশিয়ান সেনাবাহিনীর উৎসাহ বৃদ্ধি করবে। 

২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করার পর পর থেকেই রাশিয়ার নজর ছিল এই ডনবাস অঞ্চলের দিকে। তাই অভদিভকা দখল পুরো ডনবাস অঞ্চলকে রাশিয়ার অধীনে আনার গুরুত্বপূর্ন পদক্ষেপ বলা হচ্ছে। তবে এই যুদ্ধে ইউক্রেনের পাশাপাশি রাশিয়ান সেনাবাহিনীরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে যদিও রাশিয়া সঠিক তথ্য প্রকাশ করেনি কিছু। ইউক্রেনের নতুন সেনাপ্রধান কর্নেল ওলেকজান্দার সাইরেস্কি জানিয়েছে অভদিভকা শহর ছেড়ে চলে আসা তাদের একটি স্ট্রাটেজিক পরিকল্পনা ছিল। তিনি আরও বলেছেন ইউক্রেনের সেনাবাহিনী অভদিভকা ছেড়ে চলে এলেও তারা রাশিয়ান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আবারও সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ তৈরি করবে। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি পশ্চিমা দেশগুলোর থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য আরও অস্ত্র চেয়েছে। জেলেনেস্কি জানিয়েছে অভদিভকা ছেড়ে ইউক্রেন সেনাবাহিনী চলে এসেছে কারন তাদের কাছে পর্যাপ্ত আধুনিক অস্ত্র নেই। বলা হচ্ছে অভিদিভকা শহরে কোকের (কয়লা) কারখানা এবং তার আশেপাশে বেশ কিছু ইউক্রেনীয় সেনা লুকিয়ে আছে এখনও। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন জানিয়েছে আমেরিকা ইউক্রেনকে আবারও অস্ত্র সহায়তা করবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে। ২০২২ সালে যুদ্ধের শুরতেই রাশিয়া ইউক্রেনের বড় বড় শহর দখল করতে সমর্থ হয়নি, তারপর থেকেই বিশেষ করে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউক্রেনে আক্রমনের গতি বাড়িয়েছে রাশিয়া যার ফলে অভদিভকার মতোন গুরুত্বপূর্ন শহর রাশিয়ার দখলে চলে এসেছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয়দেশের সেনাই এখন পরবর্তী ধাপের যুদ্ধের জন্য প্রস্তত হচ্ছে। তবে যেহেতু ডনবাস অঞ্চলে রাশিয়ান সমর্থিত লোক বেশী থাকে তাই এই শহর হারিয়েও ইউক্রেনের তেমন কোনও ক্ষতি হয়নি। 

দি ইন্সটিটিউট ফর দি স্টাডি অফ ওয়ার জানিয়েছে রাশিয়ার অভদিভকা দখল রাশিয়ার রাজনৈতিক বিজয় যা বিশ্ব রাজনীতিতে রাশিয়ার প্রভাব বৃদ্ধি করবে আরও। ২০২২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ দখল করা। যার জন্য বেলারুশ থেকে কিয়েভ আক্রমনের চেষ্টা করেছিল, তাছাড়া ইউক্রেনের বড় বড় কিছু শহর খারকিভ, খেরসন আক্রমন করেছিল রাশিয়া কিন্তু এসব আক্রমনে রাশিয়ার তেমন কোনও লাভ হয়নি যার জন্য ২০২৩ সালের মাঝামাঝি ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধে নতুন করে পরিকল্পনা করে। কিয়েভ দখলের পরিবর্তে এবার রাশিয়া আপাতত ইউক্রেনের পূর্বপ্রান্ত দখল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ডিসেম্বরে ভ্লাদিমির পুতিন এক সাক্ষাৎকারে জানায় ইউক্রেনের কোনও ভবিষ্যৎ নেই যার অর্থ এই মূহুর্তে যুদ্ধ থামার কোনও লক্ষন নেই। 

এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতেও রাশিয়া ক্রিমিয়া অঞ্চলে সংযোগ ব্যবস্থা জোরদার করতে জলের নীচে একটি টানেল তৈরির চিন্তাভাবনা করছে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া অঞ্চল ইউক্রেন থেকে দখল করে নিয়েছিল। রাশিয়া থেকে ক্রিমিয়া একটি সেতুর মাধ্যমে যুক্ত, এই সেতুর উপর বহুবার আক্রমন হয়েছে। এই কারনে রাশিয়া সমুদ্রের নীচে একটি টানেল তৈরির চিন্তা করছে যাতে ক্রিমিয়ার সাথে নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়। এই প্রজেক্টে রাশিয়াকে সাহায্য করতে চলেছে চীন। গত ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ সালে আমেরিকার দি ওয়াশিংটন পোস্ট একটি প্রতিবেদনে জানায় চীন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিরা রাশিয়া ক্রিমিয়া টানেল প্রজেক্টে কথাবার্তা বলছে। কৃষ্ণ সাগরের তীরে অবস্থিত ক্রিমিয়ার পাশে রাশিয়ার মূল ভূখন্ড থাকলেও সরাসরি স্থল সীমান্ত নেই ক্রিমিয়ার সাথে রাশিয়ার। ক্রিমিয়ার সাথে কের্চ সেতুর মাধ্যমে যুক্ত রাশিয়া। এই সেতুর আশেপাশেই সমুদ্রের নীচে টানেল তৈরি করা হবে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়া থেকে ক্রিমিয়া পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটার লম্বা কের্চ সেতু তৈরি শুরু করে রাশিয়া যাতে ৩.৭ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। ২০১৯ সালে এই সেতু নির্মান সম্পূর্ন হয়। এই সেতুতে সড়ক পথও আছে আবার রেল পথও রয়েছে। এই সেতুতে রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৮.১ কিলোমিটার এবং সড়ক পথের দৈর্ঘ্য ১৬.৯ কিলোমিটার। ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ সালে এই প্রজেক্টে কাজ শুরু হয়ে ডিসেম্বর, ২০১৯ সালের মধ্যে অর্থাৎ মাত্র তিন বছরের মধ্যে সেতু নির্মান সম্পূর্ন হয়ে যায়। 

ক্রিমিয়ার সাথে সংযোগ রক্ষা করার জন্য এই সেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন রাশিয়ার জন্য। এই সেতুর মাধ্যমেই যুদ্ধের সময় রাশিয়া সেনাবাহিনী, অস্ত্র, খাদ্য, জ্বালানি পাঠায় ইউক্রেনে বিশেষ করে দক্ষিন ইউক্রেনের খেরসন প্রদেশ এবং জাপোরিজিয়া প্রদেশে। যদি এই সেতু কোনওকারনে ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে ক্রিমিয়ার সাথে সড়কপথে সম্পূর্ন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে রাশিয়ার এবং দক্ষিন ইউক্রেনে সেনাবাহিনী পাঠাতেও পারবেনা রাশিয়া। যার জন্য এই সেতু তৈরি হওয়ার পর থেকে বহুবার সেতুটি ধ্বংস করে দেবার জন্য ইউক্রেন বারবার আক্রমন করেছে। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসে এবং ২০২৩ সালের জুলাই মাসে এই কের্চ সেতুতে বিস্ফোরন করা হয় যদিও কিছুদিনের মধ্যেই সেতুটি ঠিক করা হয়। তবে এসব কারনে রাশিয়া চাইছে সমুদ্রের নীচে একটি টানেল তৈরি করতে যাতে কোনও সমস্যা না হয়। 

দি ওয়াশিংটন পোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে চীনের একটি সংস্থা সিআরসিসি বা চাইনিজ রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন কর্পোরেশন ৪ অক্টোবর রাশিয়ার প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠকে জানিয়েছে তারা ক্রিমিয়াতে যেকোনও ধরনের সড়ক ও রেল প্রজেক্টে কাজ করতে তৈরি আছে। সিআরসিসি চীন সরকারের অধীনস্থ একটি সংস্থা। চীনে একাধিক গুরুত্বপূর্ন রেল প্রজেক্ট সম্পূর্ন করেছে এই সংস্থাটি, এছাড়া ২০২১ সালে মস্কোর মেট্রো স্টেশন বৃদ্ধির কাজও করেছে এই সংস্থাটি। তবে এখনও এই প্রজেক্টের ব্যাপারে নিশ্চিত কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। তবে ক্রিমিয়া থেকে রাশিয়া পর্যন্ত সেতু নির্মানে সমস্যা রয়েছে, ক্রিমিয়ার পাশে রয়েছে অ্যাজোভ সাগর। এই অঞ্চল ভূমিকম্প প্রবন, তাই এখানে সমুদ্রের নীচে টানেল নির্মান যথেষ্ট কঠিন, তাছাড়া কের্চ সেতুর মতো ভবিষ্যতে এই টানেলেও আক্রমনের সম্ভবনা থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.