ফিচার আর্টিকেল

ব্রিটিশরা জোর করে ভারতে আফিম চাষ করত!

রাজেশ রায়:— প্রায় ২০০ বছর ধরে ভারতে চলা ব্রিটিশ শাসনে এত অত্যাচার করা হয়েছিল ভারতবাসীর উপর তা জানলে মন দুঃখে ভারাক্রান্ত হয় ওঠে এবং ব্রিটিশদের উপর রাগে মাথা গরম হয়ে যায়। এমনই এক অত্যাচারের ঘটনা শুরু হয় আফিম ব্যাবসাকে কেন্দ্র করে। একদিকে আফিম চাষ থেকে যখন ইংরেজরা বিপুল লাভ করছিল অন্যদিকে অনেক কষ্ট করে এই আফিম চাষ করত যেইসব কৃষকরা তারা ছিল চরম দারিদ্রতা ও শোষনের শিকার। সম্প্রতি বিভিন্ন ঐতিহাসিক বইয়ে আফিম চাষকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছেনা তার কারন হচ্ছে ব্রিটিশ আফিম চাষ খুবই বিশেষ কীছু জায়গায় করত। তবে ভারতীয়দের অবদান ছাড়া ভারতে ব্রিটিশদের কোনও কাজই সফল হয়নি। তথ্য অনুযায়ী ১৯০০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতে ইংরেজদের আয়ের ১৫ শতাংশই আসত আফিম বিক্রি থেকে কিন্তু এই আফিম চাষ উত্তর ভারতকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এবার আপনাদের মনে হবে আফিম চাষ যখন এতটা লাভজনক ছিল তাহলে কেন কৃষকরা লাভবান হচ্ছিল না? এবিষয়েই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। প্রথমেই আলোচনা করা হবে ভারতে আফিম চাষের বিস্তারিত ইতিহাস সম্পর্কে এবং তার পর বলা হবে কীভাবে এই ব্যাবসায় ব্রিটিশরা তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে। 

বলা হয় ভারতে আফিম অষ্টম শতক থেকই চাষ হচ্ছে। আরব পর্যটকরা পশ্চিম ভারতে প্রথম এই আফিম চাষ শুরু করে। ষোল শতক আসতে আসতে বিহার ও অবিভক্ত বাংলার পশ্চিম প্রান্তেই মূলত আফিম চাষ হত। ১৬৫০ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইউরোপের সাথে আফিম ব্যাবসা শুরু করে। এই ডাচ সংস্থাটি দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলোতেও আফিম রপ্তানি শুরু করে। এইসময় দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় সবচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল বাতাবিয়া শহর যাকে আজ জাকার্তা বলা হয়। এখান থেকে ডাচ সংস্থাটি বিভিন্ন জায়গায় আফিম রপ্তানি শুরু করে। চীনেও আফিম রপ্তানি শুরু হয়। ১৬৭০ আসতে আসতে আফিমের চাহিদা এতটা বৃদ্ধি পায় যে বাতাবিয়া ডাচদের থেকে বছরে প্রচুর আফিম কিনতে শুরু করে। ১৭০৮ সালে ব্রটিশরা আফিম ব্যাবসা শুরু করে। ব্রিটিশরা ভারত থেকে আফিম দক্ষিন পূর্ব এশিয়া ও আফগানিস্তানে রপ্তানি শুরু করে। যার ফলে গাঙ্গেয় উপত্যকা পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে আফিম চাষের পরিমান বৃদ্ধি পায়। ১৬৬০ থেকে ১৮০০ সাল অবধি ভারতের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা ছিল আফিমের। 

ভারতের এই আফিম ব্যাবসায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ১৭৫৭ সালে। এই সময় ব্যাটেল অফ প্লাসি ও বক্সারের যুদ্ধে ব্রিটিশরা জয়লাভ করে পুরো বাংলায় ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা দখলের আগে অবধি এখানে আফিম চাষ নিয়ন্ত্রন করত স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়। তারা কৃষকদের কাছ থেকে আফিম নিয়ে ইউরোপীয়ানদের বিক্রি করত কিন্তু বাংলা দখলের পর ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও ডাচ এজেন্টরা সরাসরি কৃষকদের থেকে আফিম কিনতে শুরু করে। কিন্ত ফ্রান্স ও ডাচদের সরাতে ১৭৭২ সালে ব্রিটিশরা ভারতে আফিম চাষের উপর শুধু ব্রিটিশদের অধিকার ঘোষনা করে কারন তারাই সেসময় বাংলায় রাজত্ব করত। ১৭৯৭ সাল অবধি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আফিমের জন্য প্রতি বছর টেন্ডার জারি করত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকই এই টেন্ডার পেত। আফিম কেনা, প্যাকেজিং সহ বিক্রি সব কিছুই যে টেন্ডার পেত সে নিয়ন্ত্রন করত। যদি কোন কৃষক আফিম বিক্রি বা চাষ করতে না চাইত তাহলে তার উপর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হত। এই ভাবেই ভারতে আফিম চাষ শুরু হয় এবং ধীরে ধীরে ব্রিটিশরা এই ব্যাবসায় তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে।

আগেই বলা হয়েছে যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আফিম বিক্রির জন্য টেন্ডার ডাকতে শুরু করে প্রতিবছর। কিন্ত কিছুদিনের মধ্যেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসাররা ক্ষমতার অপব্যবহার শুরু করে। তারা ক্ষমতার জোরে কৃষকদের খুবই কম দামে আফিম বিক্রি করতে বাধ্য করত। এতটাই কম দামে যে অনেক সময় আফিম চাষের খরচও উঠত না। যদি কেউ প্রতিবাদ করত তার জমি কেড়ে নেওয়া হত এবং সীমাহীন অত্যাচার করা হত। আরও বেশী লাভের জন্য আফিমে ভেজাল যুক্ত করা শুরু হয় যার প্রভাব পড়ে আফিমের কোয়ালিটির উপর। সেসময় ভারতে ইংরেজ গভর্নর ছিল ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি এই ব্যাপার জানতে পেরে ১৭৭৫ সালে আফিম থেকে প্রাপ্ত লাভকে সরকারি কর হিসাবে যুক্ত করে ফলে তখন থেকে আফিম ব্যাবসা প্রাইভেট থেকে সরকারি হয়ে যায় এবং প্রতি বছরের বদলে প্রতি চার বছর অন্তর আফিম ব্যাবসার জন্য টেন্ডার ডাকা শুরু হয়। এরপর ১৭৯৩ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল হয় জন শো তিনি এই টেন্ডার সিস্টেমকেই তুলে দেন এবং একটি নতুন নীতি নিয়ে আসেন যাকে বলে এজেন্সি সিস্টেম। এই সিস্টেমই আফিমে ব্রিটিশ মোনোপলিকে প্রতিষ্ঠা করে। এজেন্সি সিস্টেম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দুই অফিসারকে আফিম এজেন্ট বানানো হয়। এদের মুখ্য,কার্যালয় ছিল পাটনা ও বেনারসে। এই দুই এজেন্টই পুরো গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে আফিম চাষ ও ব্যাবসা নিয়ন্ত্রন করত যা আজকের উত্তর প্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খন্ড। পাটনা ও বেনারস এজেন্সিতে যথাক্রমে ১১ ও ১৬ টি সাব এজেন্সি ছিল। পুরো ব্রিটিশ ভারতে আফিম ব্যাবসা এরাই নিয়ন্ত্রন করত। তবে ভারতের কিছু প্রিন্সলি স্টেট বা স্থানীয় রাজাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজ্য ছিল তারা এসব নিয়মের আওতায় ছিল না। সাব এজেন্সির মধ্যে একটি ভারতীয় মহল যুক্ত ছিল যাদের গুমাস্তাস বলা হত। এই গুমাস্তাসরা বিভিন্ন গ্রামে আফিম চাষের জন্য আদর্শ জায়গা খুঁজত এবং গ্রামের প্রধানের সাথে আলোচনা করে কৃষকদের লাইসেন্স দিত চাষের।

লাইসেন্স ছাড়া কোন কৃষক আফিম চাষ করতে পারত না এবং ব্রিটিশ এজেন্সি ছাড়া কাউকে আফিম বিক্রি করাও যেত না। কৃষককে চাষের আগে একটি অগ্রিম মূল্য দেওয়া হত যা চাষের পর মূল লাভ থেকে কেটে নেওয়া হত। যেসব চাষীরা সঠিক পরিমান আফিম উৎপন্ন করতে পারত না তারা ধারে ডুবে যেত এবং পরের বছর নিজের খরচে চাষ করতে বাধ্য হত। উৎপন্ন আফিম বেনারস ও পাটনা ফ্যাক্টরিতে নিয়ে যাওয়া হত সেখানে সিন্ধুকে ভরে রপ্তানি করা হত। এভাবে ভারতে আফিম ব্যাবসা চলত। এবার দেখা যাক এই আফিম চাষ কীভাবে ভারতীয় কৃষকদের ক্ষতি করেছিল। 

ভারতীয় কৃষকদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এই এজেন্সি সিস্টেম। ভারতীয়দের আফিম চাষ জোর করে করানো হত। কৃষক নিজের জমিতেই নিজের ইচ্ছে মতন চাষ করতে পারত না। ধরুন কোন চাষী মনে করল ধান চাষ করব যাতে লাভ বেশী হবে কিন্ত এমন করতে গেলে চাষীর জমি কেড়ে নেওয়া হত। সবচেয়ে বড় ব্যাপার আফিম চাষের পর তা শুধু ইংরেজ ব্যাবসায়ীদেরই বিক্রি করতে বাধ্য থাকত চাষী তাও আবার ব্রিটিশদের ঠিক করা মূল্যে। আফিম চাষ করতে অনেক খরচ হত কিন্তু ব্রিটিশ সরকার যে মূল্য ঠিক করত আফিম বিক্রির জন্য তা এতটাই কম ছিল যে চাষীদের সংসার চালাতে হত কোনও রকমে। অনেক সময়তো আফিম চাষের খরচই উঠত না যাতে চাষীদের নিজের খরচ দিয়ে আফিম তৈরি করতে হত। আজকের দিনে যে কোনও চাষী তার ফসল নিজের ইচ্ছে মত কাউকে বিক্রি করতে পারে একে মুক্ত বানিজ্য নীতি বলে কিন্তু তখন এমন নিয়ম ছিল না৷ 

অনেক সম চাষীরা প্রতিবাদ, আন্দোলন করত কিন্তু কড়া হতে ব্রিটিশ সরকার সেই আন্দোলন দমন করত। আসলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য দাঁড়িয়ে ছিল ভারতীয়দের লুঠ ও অত্যাচার করে। আফিম চাষের ফলে চাষীরা দেনায় জর্জরিত হয়ে পড়ত। আগেই বলেছি চাষের জন্য চাষীদের একটি আগাম মূল্য দেওয়া হত। সেসময় বর্তমান দিনের মত ব্যাঙ্ক ছিল না যে চাষীদের সহজে লোন দেওয়া হবে। কিন্তু আফিম চাষের ফলে চাষীদের লাভ এতটাই কম হত যে চাষীরা সেই আগাম মূল্য শোধ করতে পারত না ফলে চাষীদের জমি কেড়ে নেওয়া হত অথবা অত্যাচার করা হত। অর্থাৎ সব দিক দিয়েই আমাদের কৃষকরা অমানুষিক কষ্ট ভোগ করত। সেসময় ব্রিটিশ সরকার চাইলে যেকোনও কৃষকের জমি দখল করে নিতে পারত। অনেক সময় কৃষকরা আফিম চাষ করতে জানত না। তারা ভাগ চাষী দিয়ে জমি চাষ করাত। ভাগ চাষীরা কিছু ফসল জমির মালিককে দিত এবং বাকী ফসল নিজেদের রাখত কিন্তু আফিম বিক্রির ফলে লাভ কম হত যাতে ভাগচাষীদের হাতে কিছুই বাঁচত না কিন্তু জমির মালিক ও ইংরেজ উভয়ের দ্বারাই তারা অত্যাচারিত হত। 

আফিম চাষের আরও একটি বড় সমস্যা ছিল স্মাগলিং। ভারতে উৎপন্ন হওয়া আফিমের বেশীরভাগ রপ্তানি হত কিন্তু কীছু পরিমান আফিম ভারতে কিছু লাইসেন্স দোকানে বিক্রি করা হত। অনেক সময় জমি থেকে আফিম চুরি হয়ে স্মাগলিং হত এবং এতে নীরিহ চাষীরা অনেক সময় ফেঁসে গিয়ে সাজা পেত। ব্রিটিশ ভারতে এরকম অনেক অত্যাচারের সাক্ষী থেকেছে সাধারন মানুষ। হয়ত ইতিহাসে আজ এসব কথা সব জায়গায় উল্লেখ করা হয় না বরং বলা হয় আফিম চাষে ভারতের অর্থনীতি মজবুত হয়েছে। হ্যা এটা ঠিক আফিম রপ্তানি করে হয়ত অনেক মুনাফা অর্জন হয়েছে কিন্তু যারা দিনরাত এক করে এই চাষ করত তারা  সর্বদা অবহেলিত পদদলিতই থেকে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.