ভুটানের সাথে চীনের নতুন করে কুটনৈতিক সম্পর্কের ফলে কতোটা চাপে ভারতবর্ষ?
ভুটান ও চীনের মধ্যে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে মীমাংসার জন্য চেষ্টা শুরু করেছে দুই দেশই। ভারতের উত্তর পূর্বের দেশ ভুটান স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন কারন ভুটান থেকে কিছুটা দূরেই অবস্থিত শিলিগুড়ি করিডর। উত্তর ভুটান এবং ডোকলাম উপত্যকা নিয়ে চীনের সাথে সমস্যা রয়েছে ভুটানের। চীনের সাথে ভুটানের ঘনিষ্ঠতা সরাসরি প্রভাব ফেলবে ভারতের উপর।
সম্প্রতি ভুটানের বিদেশমন্ত্রী ডঃ তান্ডি দর্জি বেজিং সফরে গিয়েছিলেন। বেজিংএ গত সোমবার ও মঙ্গলবার ডঃ তান্ডি দর্জি এবং চীনের সহকারী বিদেশমন্ত্রী সান উইডং এর মধ্যে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে ২৫ তম বৈঠক হয়েছে। এই বৈঠকের শেষে দুই দেশের মধ্যে সহযোগী চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তি অনুযায়ী যৌথভাবে একটি দল গঠন করা হবে যা দুই দেশের সীমান্ত সমস্যা মেটানোয় কাজ করবে। চীন ভুটানকে জানিয়েছে তাদের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে। ভুটান এমন একটি দেশ যাদের সাথে খুব কম দেশেরই কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ভুটানে চীনের কোন দূতাবাস নেই, চীনেও ভুটানের কোন দূতাবাস নেই। তাই চীন চাইছে এবার ভুটানের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে এবং ভুটানে দূতাবাস খুলতে। ঐতিহাসিক ভাবেই ভুটানকে নিরাপত্তা দিয়ে আসছে ভারত।
ডোকলামে চীনের বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীই দাঁড়িয়েছিল ভুটানের পাশে। বহু বছর ধরেই ভারত ও ভুটানের সুসম্পর্ক রয়েছে কিন্তু ভুটানের সাথে চীনের কুটনৈতিক সম্পর্ক ভারতের জন্য একটু হলেও অস্বস্তির কারন। ভুটান একটি স্বাধীন দেশ তারা যেকোনও দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করতে পারে কিন্ত চীনের সাথে ভুটানের বন্ধুত্ব ভারতের জন্য সমস্যা কারন চীন ও ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক অতীতকাল থেকেই অস্থিতিশীল।
চীন ভারতের আকসাই চীন সহ অরুনাচল প্রদেশ তাদের বলে দাবী করে। চীন প্রতিবছর একটি করে মানচিত্র প্রকাশ করে আকসাই চীন এবং অরুনাচল প্রদেশকে চীনের অংশ বলে দাবি করে। গত ২০২০ তে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকাতে ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের পর থেকে চীনের সাথে ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে। তাছাড়া চীন ভারতের শত্রু পাকিস্তানের পরম বন্ধু। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য চীন করে। পাকিস্তান চীনের থেকে প্রাপ্ত অর্থ ও অস্ত্র বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনকে দেয় ভারতে অতর্কিত আক্রমন করার জন্য। চীন একটি এমন দেশ যার লক্ষ্য তার সীমানা বৃদ্ধি। চীনের চোদ্দটি দেশের সাথে সীমান্ত রয়েছে এদের মধ্যে বারোটি দেশের সাথে সীমান্ত নির্ধারন করে নিয়েছে চীন শুধুমাত্র ভারত ও ভুটানের সাথেই সীমান্ত সমস্যা রয়ে গেছে, তবে চীনের প্রায় সব প্রতিবেশীদেরই কিছু না কিছু এলাকা তাদের বলে দাবি করে চীন এবং কিছু দেশের এলাকা রীতিমতো দখল করে রেখেছে চীন।
ভারতের জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, সিকিম, উত্তরাখন্ড এবং অরুনাচল প্রদেশের সাথে চীনের ৩,৪৮৮ কিলোমিটার লম্বা সীমান্ত আছে একে এলএসি বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বলা হয়। অতীতে বহুবার ভারত চীনের সাথে সীমান্ত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছে কিন্ত প্রতিবার চীন বিরোধীতা করেছে। ভারতের অরুনাচল প্রদেশ চীন তাদের দাবি করে যার কারনে ভারত ও চীনের সীমান্ত সমস্যা আজও মেটেনি। এরকম ভুটানের সাথেও সীমান্ত সমস্যা রয়েছে চীনের। ভুটানের বিদেশমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর চীন জানিয়েছে তারা প্রতিবেশীদের নীতিকে সবথেকে বেশী গুরুত্ব দেয়, তাদের কাছে কেউ ছোট বা বড় নয়, সবাই সমান। চীন আরও জানিয়েছে তারা ভুটানের সাথে সীমান্ত সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে আক্ষরিক অর্থেই কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী যাতে চীন ও ভুটানের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়।
ভুটানও জানিয়েছে চীনের সাথে তাদের কুটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করতে তারাও আগ্রহী এবং তারা চেষ্টা করবে দ্রুত সীমান্ত সমস্যা সমাধানের। ভুটান চীনের একচীন নীতিকেও সমর্থন করেছে। চীনের এক চীন নীতি অনুযায়ী তাইওয়ানকে কোন দেশ আলাদা দেশ ভাবতে পারবেনা, চীনেরই অংশ মানতে হবে। কোনও দেশকে চীনের সাথে কুটনৈতিক ও বানিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করতে হলে তাকে এক চীন নীতি মানতেই হবে। ইতিমধ্যেই ভুটান ও চীনের একটি যৌথ দল গঠন করা হয়ে গেছে যে দল উভয় দেশের সীমানা নির্ধারনে কাজ শুরু করেছে। চীন উত্তর পশ্চিম এবং মধ্য ভুটানের ৭৬৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা দাবী করে তাদের। ১৯৮৪ সালের আগে ভুটান ও চীনের সীমানা সমস্যা নিয়ে চীন সরাসরি ভারতের সাথে আলোচনা করতো কিন্তু ১৯৮৪ সালের পর ভুটান নিজেই চীনের সাথে আলোচনা করে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে। ১৯৮৪ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত চীন ও ভুটানের মধ্যে ২৪ দফা বৈঠক হয়েছে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে, সম্প্রতি ২৫ তম বৈঠক হল। উত্তর ভুটানের জাকারলুং ও পাসামলুং এবং পশ্চিম ভুটানের ডোকলাম এলাকায় ভুটানের সাথে চীনের সীমান্ত সমস্যা রয়েছে। এই ডোকলাম উপত্যকাতেই ভারত ও চীনের সেনাবাহিনী ৭০ দিন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। ডোকালাম উপত্যকাতে ২০১৭ সালের জুন মাসে চীনের সেনাবাহিনী দক্ষিন ডোকলামের ডোকা লা পাসের দিকে অবৈধ ভাবে রাস্তা তৈরির চেষ্টা করছিলো। ১৮ জুন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২৭০ জন সশস্ত্র সেনা দুটো বুলডোজার নিয়ে সিকিম সীমান্ত অতিক্রম করে ডোকলামে গিয়ে চীনের সেনাবাহিনীকে রাস্তা তৈরিতে বাধা দেয়। অবশেষে ৭০ দিন পর ২৮ আগস্ট ভারত ও চীন উভয় দেশই সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেয় ডোকলাম থেকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অভিযানকে অপারেশন জুনিপার বলা হয়।
ভারত ডোকলাম উপত্যকাকে ভুটানের বলে মনে করে কিন্তু চীনের দাবি ডোকলাম উপত্যকা চুম্বি উপত্যকারই অংশ যার কারনে এটা তাদের ভূখন্ড। চীন ডোকলাম উপত্যকা দখল করতে পারলে তা ভারতের জন্য চিন্তার কারন। কারন ডোকলাম এলাকা যথেষ্ট উচ্চ, এখান থেকে খুব কাছেই শিলিগুড়ি করিডর। যদি কখনও ঝামেলা হয় ভারতের ও চীনের মধ্যে তাহলে চীন খুব সহজেই শিলিগুড়ি করিডরকে আক্রমন করতে পারবে। ২২ কিলোমিটার লম্বা শিলিগুড়ি করিডরই একমাত্র পথ যার মাধ্যমে ভারত উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখে, এই কারনে শিলিগুড়ি করিডরকে চিকেন নেক বলা হয় অর্থাৎ শিলিগুড়ি করিডর আক্রমন করার অর্থ পুরো উত্তর পূর্ব ভারতকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যার জন্য ভারত ডোকলাম উপত্যকাকে ভুটানের বলে সমর্থন করে। ডোকলাম এলকায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে বাধা পাওয়ার পর ২০২০ সালের জুন মাসে চীন পূর্ব ভুটানের সাকতেং বন্যপ্রানী সংরক্ষিত এলাকা তাদের বলে দাবি করে। মজার ব্যাপার হল এই সাকতেং এলাকার সাথে চীনের কোন সীমান্ত নেই, ভারতের অরুনাচল প্রদেশের তাওয়াং জেলার সাথে সাকতেং এর সীমানা রয়েছে। যেহেতু চীন মনে করে অরুনাচল প্রদেশ তাদের সেই কারনে সাকতেংকে চীন নিজেদের বলে দাবি করেছে। চীন এরকম ভাবে ইচ্ছে করেই প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সীমনা নিয়ে সমস্যা তৈরি করে যাতে নিজেদের এলাকা বাড়ানো যায়।
কিছুদিন আগে একটা খবর ছড়িয়ে পড়েছিল মিডিয়ায় যে চীন জাকারলুং ও পাসামলুং এলাকায় ভুটানের সাথে সীমান্ত সমস্যা মিটিয়ে ফেলবে যদি ডোকলাম এলাকা তাদের দিয়ে দেওয়া হয়। যদি এমনটা হয় তাহলে সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়বে ভারত কারন শিলিগুড়ি করিডরকে যেকোনও ভাবেই রক্ষা করতেই হবে ভারতকে। তবে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছে জাকারলুং ও পাসামলুং এলাকায় সীমান্ত সমস্যা নিয়ে তারা সরাসরি চীনের সাথে আলোচনা করবে কিন্ত ডোকলাম এলাকা নিয়ে ভারত, চীন ও ভুটানের মধ্যে বৈঠক হবে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী আরও জানিয়েছেন ডোকলাম সমস্যা নিয়ে চীনের সাথে আলোচনা তখনই হবে যখন ভারত ও চীনের সীমান্ত সমস্যা সমাধান হবে। এটা ভারতের জন্য খুবই ভালো খবর।