দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রেডিওর ব্যবহার যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। জানুন বিস্তারিত
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয় জার্মানির নেতারা তাদের সেনাদের জানিয়েছিল ডিসেম্বর মাস আসতে আসতে সবাই নিজের বাড়ি চলে আসবে ততদিনে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে। জার্মানি ভেবেছিল এই যুদ্ধে ইউরোপের সমস্ত ছোট ছোট লড়াই শেষ হয়ে যাবে কিন্ত জার্মানির নেতাদের ধারনা ভুল প্রমানিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দীর্ঘ চার বছর ধরে চলেছিল তার প্রধান কারন হল ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার। এই পদ্ধতিতে উভয়পক্ষের সেনা যুদ্ধক্ষেত্রে কয়েকশো কিলোমিটার লম্বা পরিখা খনন করে তার মধ্যে যুদ্ধ করতো। তবে সুড়ঙ্গ যেমন মাটির নীচে হয় এই পরিখাও ঠিক সুড়ঙ্গের মতোই গর্ত করা হত কিন্ত মাথার উপর খোলা থাকতো। এই পরিখার মধ্যে উভয়পক্ষের সেনা রীতিমতো বেস তৈরি করে লড়াই করতো যার কারনে দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চলছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মার্নের যুদ্ধে ফ্রান্স এভাবেই জার্মান সেনাদের আটকে দিয়েছিল। মার্নের যুদ্ধ ১৯১৪ সালে শুরু হয়ে পরবর্তী তিন বছর ধরে চলেছিল। এমনকী প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পরও কোথাও কোথাও পরিখার ভিতরে লড়াই চলছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সফল ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার নীতি কিন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কাজ করেনি। বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্যাঙ্কের ব্যবহারের কারনে ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার কাজ করেনি কিন্ত শুধু ট্যাঙ্কই মুখ্য কারন নয় কারন পরিখার উপর দিয়ে ট্যাঙ্ক চলে যাওয়া সম্ভব ছিল কিন্তু পিছনের স্থলসেনার পরিখা অতিক্রম করা সম্ভব ছিলনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার কাজ না করার জন্য একাধিক কারন আছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে জার্মান সেনা বেলজিয়াম দখল করে ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়৷ ফ্রান্স সেনাও জার্মানির আক্রমনের প্রস্ততি নিয়েই ছিল। অ্যালায়েড সেনা ফ্রান্সের সীমানায় জার্মান সেনাবাহিনীর সামনে পরিখা খনন করে রাখে, জার্মান সেনাও পরিখা খনন করে। প্রথমে উভয়পক্ষের পরিখাই নির্দিষ্ট কয়েক কিলোমিটার জুড়ে ছিল যার কারনে উভয়পক্ষের সেনাবাহিনীই ঠিক করে পরিখা যেখানে শেষ হচ্ছে সেখানে গিয়ে অন্যপক্ষকে ঘিরে ফেলবে। কিন্তু দু’পক্ষের চিন্তাভাবনা এক হওয়ায় কেউ কাউকে ঘিরতে দেয়নি বরং দু’পক্ষই পরিখার দৈর্ঘ্য বাড়াতে শুরু করে। ফ্রান্স সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে পরিখা উত্তরে সমুদ্র উপকূল পর্যন্ত খনন করা হয়। যতক্ষননা সমুদ্র উপকূল এসে যায় ততক্ষন পর্যন্ত দু’পক্ষই পরিখা খনন করে, একে সমুদ্র বরাবর প্রতিযোগিতাও বলা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এরকম ৩০০ থেকে ৩৫০ মাইল বিস্তৃত পরিখা ছিল উভয়পক্ষেই। পরিখা যুদ্ধে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল সেনাদের নির্দেশ দেওয়া। সেসময় সেনাপ্রধান পরিখার ভিতর থাকা সেনাকে গুরুত্বপূর্ন নির্দেশ দিত দুভাবে।
একটা পদ্ধতি হল সরাসরি কোনও সেনাকে পাঠানো। কিন্ত এই পদ্ধতিতে একটা অসুবিধা হল পরিখা লম্বা ছিল প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার পর্যন্ত, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে অনেক সময় লাগতো, তারপরেও পুরোপুরি নিশ্চিত থাকা যেতনা বার্তাবাহক বার্তা পাঠাতে পারবে কীনা কারন পরিখার ভিতর লড়াইয়ে মারা যাওয়ার সম্ভবনাও ছিল।
১৯১৭ নামে একটি সিনেমায় পরিখা যুদ্ধ ও কি করে দুজন ব্যক্তি পরিখার ভিতর এক প্রান্তে বার্তা পৌঁছায় সেটা খুব ভালোভাবে দেখানো হয়েছে। এই পদ্ধতি ছাড়াও আরও একটি পদ্ধতি ছিল টেলিগ্রাফ, যার মাধ্যমে সহজেই বার্তা পৌঁছানো যেত। কিন্ত টেলিগ্রাফ পোস্টে আক্রমন হলে সরাসরি লোক দিয়ে বার্তা পৌঁছানো ছাড়া কোন উপায় ছিলনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি রেডিও তৈরি করে ফেলে যার ফলে খুব সহজেই নির্দেশ দেওয়া যেত, এতে তারেরও দরকার ছিলনা। রেডিও তৈরির সুফল জার্মানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ভাবে পায়।
১৯৪০ সালে জার্মানির ফ্রান্স আক্রমনের সময় রেডিওর ব্যাপক ব্যবহার করে জার্মানি। সেসময় জার্মান কম্যান্ডার গুডেরিয়ান এবং রোমেল দুজনকেই হিটলার রেডিওর মাধ্যমে সরাসরি নির্দেশ দিচ্ছিল কখন কি করতে হবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে টেলিগ্রাফ ও বার্তাবাহকের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতে অনেক সময় লাগতো যার কারনে একবার নির্দেশ দিলে তা কাজে লাগাতে অনেক সময় লাগতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিটি জার্মান ট্যাঙ্কের ভিতর রেডিও থাকতো, যার কারনে ট্যাঙ্কের ভিতর থেকেই কম্যান্ডার জানতে পারতো তাদের কী করতে হবে এবং তাদের সেনাবাহিনী কোথায় আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধের সরাসরি তথ্য পাওয়া যেতনা অন্তত একদিন পর যুদ্ধের তথ্য পাওয়া যেত, সেই একদিনে যুদ্ধের পরিস্থিতি অনেক পরিবর্তিত হয়ে যেত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রেডিও তৈরি হয়ে যাওয়ায় যুদ্ধের সরাসরি খবর জার্মান কম্যান্ডাররা পেয়ে যেত এবং সেই অনুযায়ী নির্দেশ দেওয়া হত। যার কারনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতোন ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কাজ করেনি কারন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আরও একটি বড় পরিবর্তন হয় তা হল মেকনাইজড ইনফ্রেন্টি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সেনাদের পায়ে হেঁটে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে হত। মার্নের যুদ্ধের সময় ফরাসি নাগরিকরা ট্যাক্সি করে সেনাদের যুদ্ধক্ষেত্রে দিয়ে এসেছিল। যার কারনে যুদ্ধ সেসময় অত্যন্ত ধীর গতিতে হত কারন সম্পূর্ন স্থলসেনা একস্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে সময় লাগত, সেই কারনে পরিখার ভিতর যুদ্ধ হত যাতে সব সেনা একত্রে থাকতে পারতো। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ট্যাঙ্কের পাশপাশি সেনাবাহিনীর জন্য বিশেষ গাড়ি, বাইক এবং ট্রাক ছিল যা দিয়ে খুব সহজেই দ্রুত যুদ্ধ করা যেত। ট্যাঙ্ক ডিভিশন এগিয়ে গেলেও নিশ্চিত থাকতো পেছনে স্থলসেনাও দ্রুত গতিতে আসছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কোনও স্থানে ট্রেনে করে লজিস্টিক, গোলা বারুদ এলে সেগুলো যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া হত ঘোড়া করে যাতে অনেক সময় লাগতো। কিন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গাড়ি, ট্রাকে করে লজিস্টিক বহন করা হত যার কারনে যুদ্ধে লজিস্টিকের কোনও সমস্যা হয়নি। জার্মানি এই ভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্লিজক্রিগ পদ্ধতিতে যুদ্ধ করেছিল যাতে কম সময়ে প্রায় গোটা ইউরোপ দখল করে ফেলেছিল। আর্ডেনস জঙ্গল হয়ে জার্মানি যখন ফ্রান্সে প্রবেশ করেছিল তখম জার্মানির স্থলসেনা প্রথমে আসেনি, জার্মানির ট্যাঙ্ক ডিভিশন প্রথমে এসে আক্রমন করেছিল। ব্লিজক্রিগ পদ্ধতির নিয়মই হচ্ছে শত্রুকে বুঝতে না দিয়ে দ্রুত গতিতে কোথাও না দাঁড়িয়ে আক্রমন করতে করতে এগিয়ে যাওয়া। যার কারনে ফ্রান্সের সেনাবাহিনী বাধা দিতেই পারেনি তেমন, জার্মানির ট্যাঙ্ক ডিভিশন এগিয়ে যাওয়ার পর পেছন থেকে নাজি সেনার মেকানাইজড ইনফ্রেন্টি এসে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলেছিল ফলে ফ্রান্সের সেনাবাহিনী বাধ্য হয় আত্মসমর্পনে।
রেডিওর ব্যবহার এবং ট্যাঙ্ক সহ মেকানাইজড ইনফ্রেন্টি এই দুটো প্রধান কারন ছিল যার কারনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতোন ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার কাজ করেনি। জার্মানির এই ব্লিজক্রিগ নীতি প্রথমে যতটা সাফল্যতা দিয়েছিল পরে ততটাই ঘাতক সিদ্ধ হয় কারন ব্লিজক্রিগ পদ্ধতিতে ট্যাঙ্ক ও মেকানাইজড ইনফ্রেন্টি দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায় ঠিকই কিন্ত পেছনে লজিস্টিক সরবরাহ অতটা দ্রুতগতিতে হওয়া সম্ভব হয়না। এই কথা জার্মান কম্যান্ডোরা হিটলারকে বলেছিল কিন্তু হিটলার কোন কথাই না শুনে ব্লিজক্রিগ পদ্ধতি চালিয়ে যাওয়ার আদেশ দিয়েছিল যার ফলে পরে পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধে বিপর্যস্ত হতে হয় জার্মান সেনাকে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও খুব অল্প কিছু জায়গায় ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার হয় যেমন সেবাস্তিপোলের যুদ্ধে সোভিয়েত রেড আর্মি সেবাস্তিপোলের বাইরে অনেক পরিখা খনন করে রেখেছিল যার কারনে সেবাস্তিপোল দখলে জার্মানের অনেক সময় লেগেছিল। আবার লেলিনগ্রাদের যুদ্ধেও লেলিনগ্রাদ শহরের বাইরে পরিখা খনন করে রেখেছিল সোভিয়েত সেনা, যার কারনে জার্মান সেনা লেলিনগ্রাদকে ঘিরে ফেলেছিল কিন্তু আক্রমন করেনি।