আফ্রিকান হিটলার ইডি আমিন সম্পর্কে জানা আছে!
রাজেশ রায়:– পৃথিবীতে যুগে যুগে একের পর এক অত্যাচারী শাসক এসেছে। বিংশ শতাব্দীতেও এরকম অনেক শাসক ছিল জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার থেকে শুরু করে ইটালির বেনিটো মুসোলিনী, রাশিয়ার জোসেফ স্তালিন, ব্রিটেনের মুখোশধারী ভদ্রলোক উইনস্টন চার্চিল, চীনের মাও জেডং, জাপানের তোজো সহ আরও অনেকে। তবে আফ্রিকা মহাদেশে এমন এক অত্যাচারী শাসক ছিল যাকে ডাকা হত আফ্রিকার কসাই, আফ্রিকার হিটলার, মানবতার শত্রু আরও অনেক নামে। আফ্রিকা মহাদেশের একটি দেশ উগান্ডার এই অত্যাচারী শাসকের নাম ইডি আমিন যে তার আট বছরের শাসনে কয়েক লাখ লোককে হত্যা করেছিল। ইতিহাসে অনেক অত্যাচারী শাসক এসেছিল কিন্তু ইডি আমিনের মতন দ্বিতীয় কেউ হয়নি। অত্যাচারিতা ও নৃশংসতার সব সীমা পার করে দিয়েছিল এই ইডি আমিন। বলা হয় ইডি আমিন মানুষকে হত্যা করে তার মৃতদেহকেও ছাড়তনা। ইডি আমিন সম্পর্কে অনেক লেখক বলেন ইডি আমিন তার শত্রুদের হত্যা করে শরীরের বিভিন্ন অংশ তার ফ্রিজে রাখত এবং খেতো। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী ইডি আমিন তার শাসনকালে ছয় লাখ লোককে হত্যা করেছিল, এর মধ্যে শুধু যে উগান্ডার লোক ছিল তাই নয় বরং ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ অন্যান্য এশিয়ান দেশের লোকও ছিল। ইডি আমিন বিভিন্ন কারনে প্রতিদিন ২৫০ লোককে হত্যা করত।
ইডি আমিন দাদা ঔমের জন্ম ১৯২৫ সালে উগান্ডার উত্তর পশ্চিমে কোবোকো প্রদেশে হয়। সেসময় উগান্ডা ব্রিটিশ অধীনে ছিল। আফ্রিকা মহাদেশে প্রথম থেকেই বিভিন্ন জাতি বা ট্রাইবের লোক বাস করে। তার বাব ছিল কাকওয়া জাতির এবং মা ছিল কুগবারা জাতির। ছোটবেলাতেই তার বাবা মা আলাদা হয়ে যায় এবং ইডি আমিনের দেখাশোনা তার মা করে। ইডি আমিনের ছয় ভাইবোন ছিল যার মধ্যে সে ছিল তৃতীয়। অত্যন্ত দারিদ্র্য পরিবারের ছেলে হওয়ায় ছোট থেকেই শিক্ষা অর্জন করেতে পারে নি। তার ছোট বেলা কেটেছে মাঠে ছাগল চড়িয়ে। যুবক বয়সে লুগাসিতে একটি ব্রিটিশ রেস্তোরাঁতে প্রথম চাকরী পায় ইডি আমিন। এখানেই তার উপর নজর পড়ে এক আমেরিকান সেনা অফিসারের। এখান থেকেই তার জীবনের মোড় পরিবর্তন হতে শুরু করে। ৬.৪ ফুট লম্বা ও ২৪০ পাউন্ড ওজনের ইডি আমিনকে দেখে সে অবাক হয়ে গিয়েছিল। সেই ব্যক্তিটি ইডি আামিনকে উগান্ডার রয়েল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে। ১৯৪৬ সালে উগাণ্ডায় ব্রিটেনের কিং আফ্রিকান রাইফেলস বিভাগে যুক্ত হয় সে। এই সময়েই উগান্ডায় হেভি ওয়েট বক্সিং প্রতিযোগিতা জেতে ইডি আমিন এবং ১৯৫১-৬০ অবধি এই শিরোপা তার দখলেই ছিল। অসাধারন শারীরিক জোরের জন্য সেনাবাহিনীর একের পর এক উচ্চপদে আসিন হয় ইডি আমিন।
১৯৪৯ সালে সোমালিয়ায় শিফটা বিদ্রোহীদের দমন করতে পাঠানো হয় তাকে। এরপর ১৯৫২ সালে কেনিয়াতে মাও বিদ্রোহীদের দমন করতে পাঠানো হয়। এই দুই মিশনে সফল হবার পর তাকে কর্পোরাল ও পরে সার্জেন্ট পদে প্রমোশন করা হয়। ১৯৫৩ সালে সে সেনাবাহিনীর এফেন্দি পদে পৌঁছায়। ব্রিটিশ কলোনীতে যেকোনো আফ্রিকার দেশে সেনাবাহিনীতে সর্বোচ্চ পদ ছিল এফেন্দি। ১৯৬১ সালে ইডি আমিন সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট পদে প্রোমশন পায়। ইডি আমিন ছিল প্রথম কোন উগান্ডার ব্যাক্তি যে এতবড় পদে পৌঁছেছিল। এই সময় পর্যন্ত তাকে অনেক সামরিক অপারেশনে পাঠানো হয়েছিল। তবে ইডি আমিন যেখানে যেখানেই গেছিল সেখানেই নরসংহার করেছিল। তার শত্রুদের অত্যন্ত নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল সে। ১৯৬২ সালের ৯ অক্টোবর উগান্ডা ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং মিলটন ওবোটে উগান্ডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়। মিলটন ওবোটে খুব ভালোভাবেই জানত ইডি আমিনকে। সেজন্য ১৯৬২ সালে তাকে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৬৩ সালে উগান্ডার সেনাবাহিনীর মেজর করা হয়। এরপর ১৯৬৪ সালে সেনাবাহিনীর ডেপুটি কম্যান্ডার এবং ১৯৬৫ সালে সেনাবাহিনীর কম্যান্ডার হয় ইডি আমিন। এর মাঝে একটি ঘটনা ঘটে। ১৯৬৫ সালে প্রধানমন্ত্রী মিলটন ওবোটে এবং ইডি আমিন কঙ্গো থেকে ইভোরী ও সোনা পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়ে। যার জন্য উগান্ডার সাংসদ প্রধানমন্ত্রী মিলটন ওবোটের উপর তদন্ত করবার আদেশ দেয়। এরপরই মিলটন ওবোটে উগান্ডার সংবিধানই তুলে দেয় এবং ইডি আমিনের সাহায্যে দক্ষিন ও মধ্য উগান্ডার রাজা মুস্তেসা দ্বিতীয়কে রাজত্ব থেকে বঞ্চিত করে নিজেকে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট ঘোষনা করে এবং সাংসদকেও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ইডি আমিন মুস্তেসা দ্বিতীয়র প্রাসাদে আক্রমন করে এবং রাজা মুস্তেসা বাধ্য হয়ে উগান্ডা ছেড়ে ব্রিটেন চলে যায়। এর বদলে মিলটন ওবোটে ইডি আমিনকে ১৯৭০ সালে উগান্ডার সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করে। মিলটন ওবোটে কখনও স্বপ্নেও ভাবে নি যে ইডি আমিনকে এত ক্ষমতা প্রদান করেছিল সেই তাকে সরিয়ে উগান্ডা দখলের পরিকল্পনা করছে। ইডি আমিন রাষ্ট্রপতিকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিল যদিও তাতে সে সফল হয়নি, মিলটন ওবোটে যখন এখবর জানতে পারল তখনই ইডি আমিনের সাথে তার ঝামেলা শুরু হয়। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীর ফান্ড থেকে ৪০ মিলিয়ন শিলিং চুরীর অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়। তাকে সেনাবাহিনী থেকে সাসপেন্ড করা হয় এবং গ্রেপ্তারের ঘোষনা করা হয়। খবর শুনে ইডি আমিন কাম্পালায় গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের ২৫ জানুয়ারি মিলটন ওবোটে সিঙ্গাপুরে একটি বৈঠকে ছিল তখনই ইডি আমিন উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা দখল করে এবং অ্যান্টাবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে ব্লক করে নিজেকে উগান্ডার রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষনা করে। এখান থেকেই শুরু হয় উগান্ডার ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ সময়ের।
১৯৭১ সাল থেকে ইডি আমিন নয় বছর ক্ষমতায় ছিল। উগান্ডায় চালু হওয়া এই মিলিটারি শাসনকে সেখানকার স্থানীয় মানুষ ও কীছু পশ্চিমা দেশ সমর্থন করেছিল। এর কারন হচ্ছে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মিলটন ওবোটের খারাপ শাসন এবং ইউরোপীয় দেশ গুলো ভাবছিল এর ফলে উগান্ডায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব কমবে। কিন্তু এটা ছিল ভুল ধারনা কারন ইডি আমিনকে সমর্থন করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও লিবিয়ার নেতা গদ্দাফি। ইডি আমিন ক্ষমতায় এসেই বন্দিদের মুক্তি দেয়, সিক্রেট পুলিশ সার্ভিসকে বন্ধ করে দেয়। সংবিধানকে অনেক পরিবর্তন করে। মিলিটারি শাসনকে সিভিল আইনের উপরে রাখে। এক এক করে তার সমস্ত শত্রুদের শেষ করে ইডি আমিন। ব্রিটেন ও মিলটন ওবোটের ঘনিষ্ঠ লোকেদের হত্যা করা হয়। উগান্ডার সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে শুধু তার ঘনিষ্ঠ লোকেদেরই রাখা হয়। আখোলি ও ল্যাঙ্গো নামে দুটি খ্রীষ্টান ট্রাইবের লোকেদের বেশীরভাগকে হত্যা করা হয় কারন তারা মিলটন ওবোটে ঘনিষ্ঠ ছিল। উগান্ডায় এশিয়ান যেসব মানুষরা ছিল তাদের রাতারাতি উগান্ডা থেকে বের করে দেওয়া হয়। প্রথম দিকে ইডি আমিন তার সন্ত্রাসী কাজকর্ম বাকী বিশ্বের থেকে লুকোনোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু তা ধীরে ধীরে বাকী বিশ্ব জেনে যায়। আসলে উগান্ডায় ৮০,০০০ এশিয়ান থাকত সেসময়, তাদের মাধ্যমেই এই খবর বাইরে আসে। যার জন্য ইডি আমিন ১৯৭২ সালের ৪ আগস্ট ঘোষনা করে সে রাতে স্বপ্নে দেখেছে উগান্ডার খারাপ আর্থিক ব্যাবস্থার জন্য এশিয়ান লোকেরাই দায়ী, তাই তাদের দেশ থেকে আগে বের করতে হবে।
উগান্ডায় যেসব এশিয়ান থাকত তারা আসলে ব্রিটিশ সরকারের সময় থেকে ছিল। উগান্ডার ব্যাঙ্ক, স্থাপত্য কাজ, গবেষনায় এরাই যুক্ত ছিল। ইডি আমিন ৯০ দিনের মধ্যে এদের উগান্ডা ছাড়ার নির্দেশ দেয়। ৯ আগস্ট আসতে আসতে এখানে থাকে ভারতীয়, পাকিস্তানি ও বাংলাদেশীদের ও চলে যাবার আদেশ দেওয়া হয়। ১৪ আগস্ট আসতে আসতে ইডি আমিন ঘোষনা করে এশিয়ান লোকদের চলে যাবার পর ইউরোপীয়ানদেরও দেশ থেকে বের করে দেওয়া হবে। উগান্ডা থেকে বের হয়ে যাওয়া লোকদের ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা আশ্রয় দেয়। এশিয়ানরা চলে যেতেই উগান্ডার অর্থনীতির অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়, আসলে উগান্ডার অর্থনীতি নিয়ন্ত্রন করত এই এশিয়ানরাই। এইসময় ইডি আমিনের বিরুদ্ধে দুবার বিদ্রোহ ঘোষনা হয়েছিল কিন্তু সফল হয় নি তবে বিদ্রোহে জড়িত থাকা লোকেদের যে অবস্থা হয়েছিল তা খুবই নৃশংস। কিন্তু ধীরে ধীরে তার অত্যাচার এতটাই চরমে ওঠে যে ১৯৭৮ সাল থেকে উগান্ডায় তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মিলটন ওবোটে তখন তানজানিয়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। সেজন্য ইডি আমিন তাকে মারবার জন্য একটি পরিকল্পনা করে। ইডি আমিন এটা বলে যে তানজানিয়া উগান্ডায় আক্রমন করতে চাইছে যার জন্য ইডি আমিন তানজানিয়া আক্রমন করে ক্যাগ্রা প্রদেশ দখল করে নেয়। এর দুসপ্তাহ পর তানজানিয়া উগান্ডায় আক্রমন করে। ১৯৭৯ সালের ১১ এপ্রিল তানজানিয়া উগান্ডার রাজধানী ক্যাম্পেলা দখল করে নেয়। আমিনকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। প্রান বাঁচাতে আমিন লিবিয়া পালিয়ে যায়।। সেখান থেকে ইরাক হয়ে সৌদি আরব পালিয়ে যায় এবং সেখানেই ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট মারা যায়। এভাবেই শেষ হয় বিশ্বের অন্যতম নিষ্ঠুর শাসক ইডি আমিন।