ভারত

ভারতবর্ষের অর্থনীতির প্রধান চাবিকাঠি মারোয়াড়ীরা। কেন বলা হয় এরকম?

রাজেশ রায়:- কলকাতার বড় বাজার থেকে শুরু করে ভারতের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানে মাড়োয়ারিদের আধিপত্য চোখে পড়ার মতন। বলা যায় ভারতে রীতিমতো ইন্ডাস্ট্রি কমিউনিটি তৈরি করে ফেলেছে মাড়োয়াড়িরা। তাবে এই অবস্থান রাতারাতি তৈরি হয় নি, দীর্ঘদিন সময় লেগেছে এর জন্য। স্থানীয় ব্যাবসা হোক কিংবা কোন রাজপুত বা মুঘল সাম্রাজ্যে ব্যাবসার কারনে মাড়োয়ারিরা সবসময়ই ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন ব্যাবসা করেছে এবং তাতে সাফল্য অর্জন করে প্রচুর ধনসম্পত্তি অর্জন করেছে। এজন্য তাদের সম্পর্কে একটি কথা বলা হয় “যাহা না পৌছে রেলগাড়ি উহা পৌঁছে মাড়োয়ারি।” কখনও ব্যাবসায়ী তো কখনও ব্যাঙ্কার আবার কখনও লোন দেওয়া, এভাবে সময়ে সময়ে তারা বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করেছে। মুঘল বা রাজপুত সাম্রাজ্যের অর্থনীতির প্রধান চাবিকাঠি ছিল এই মারোয়াড়ীরা। ভারতের প্রিন্সলি স্টেট গুলোতে ব্যাঙ্কারের ভূমিকায় ছিল এই মারোয়াড়িরা।

আজও ভারতের ১০ টি বড় কোম্পানির মধ্যে ছয়টিই মাড়োয়ারিদের যেমন আম্বুজা সিমেন্ট, উইপ্রো, রেমন্ড, সিয়েট টায়ার, বিড়লা গ্রুপ, এইচটি মিডিয়া, ডিবি গ্রুপ ইত্যাদি। আজকে এই মাড়োয়ারি কমিউনিটির উৎস এবং তাদের বিসনেজ স্ট্রাটেজি সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। যার দ্বারা মাড়োয়ারিরা ভারতের ব্যাবসায়িক জগতে রাজত্ব করছে এবং নিজেদের আলাদা পরিচয় তৈরি করেছে।

১৯১৬ সালে প্রকাশিত আরভি রাসেলের ট্রাইবস এন্ড কাস্টস অফ দি সেন্ট্রাল প্রভিন্সেস অফ ইন্ডিয়া বইতে বলা হয়েছে মাড়োয়ারি নামে এই জাতের উৎপত্তি রাজস্থানের মাড়োয়ার নামক অঞ্চল থেকে। আজ যেখানে যোধপুর, বামের, পালি এবং জাগোর নামক জায়গা রয়েছে তাকে অতীতে মারোয়ার বলা হত, এখানকার লোকেদের মাড়োয়ারি বলা হয়। আজ আগরওয়াল, মহেশ্বরী, খান্ডেলওয়াল ইত্যাদি বিশেষ টাইটেল ভুক্ত লোকেদের মাড়োয়ারি বলা হয়। দ্বিজেন্দ্র ত্রিপাঠি এবং অ্যানে হার্ডগ্রোভের মত বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য অনুযায়ী এদের মাড়োয়ারি তখনই বলা হয়েছে যখন এরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে। বিশেষত গঙ্গা যমুনা বানিজ্য পথের কাছে বসতি স্থাপন করায় বাকী জাতিদের তুলনায় মাড়োয়ারিদের অন্যত্র বসতি স্থাপন করা তুলনামূলক সুবিধাজনক হয়েছে। উত্তর ভারতের রাজারা মাড়োয়ারিদের তাদের ব্যাঙ্কিং ও অর্থনীতির দায়িত্ব দেবার জন্য ডাকত, এই রাজকীয় সমর্থনের কারনে আজ উত্তর ভারতের ব্যাবসায়ীক জগতে মাড়োয়ারিদের আধিপত্য রয়েছে। যদি যোধপুরের অবস্থানকে দেখেন দেখবেন অতীতে এটি তিনটি প্রধান ব্যাবসায়ীক কেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিল একদিকে মুঘলদের রাজধানী আগ্রা, অন্যদিকে কান্দাহার এবং আরেকদিকে আমেদাবাদ।

সুতরাং খুব স্বাভাবিক ভাবেই মাড়োয়ারিদের ব্যবসার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। যদি আমরা ইতিহাসের পাতা উল্ট দেখি দেখা যাবে কান্দাহারে মুঘল এবং সাফাবিদ সাম্রাজ্য ছিল ভিন্ন ভিন্ন সময়ে। এই সময় তৈরি বানিজ্যিক রুট গুলোকে নিয়ন্ত্রন করত মাড়োয়ারিরাই। অনেকে তো আবার মুঘল সাম্রাজ্যে বড় বড় পদেও ছিল যেমন রাজা তোদর মল যিনি জাতে মাড়োয়ারি ছিলেন তিনি মুঘল সাম্রাজ্যে আকবরের সময়ে মুশরিফ ই দিওয়ান ছিলেন যাকে অর্থমন্ত্রী বলা হয়। রাজপুত অনেক রাজ্য মাড়োয়ারিদের তাদের অর্থনীতির প্রধান কান্ডারি হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন। এভাবে উত্তর ভারত সহ পূর্ব ও মধ্য ভারতের ব্যাবসায়ীক বাজারে মাড়োয়ারিদের আধিপত্য বৃদ্ধি পায়। বিখ্যাত ব্রিটশ লেখক কলোনেল ট্রডের বক্তব্য বলেছিলেন ১৮৩২ সালেও কলকাতার বড়োবাজারে প্রতি দশ জনের মধ্যে নয় জন ব্যাবসায়ী ও ব্যাঙ্কার ছিল মাড়োয়ারিরা। এর বড় কারন ছিল সেসময় ইংরেজরা ভারতে আধিপত্য বিস্তার করছিল এবং মুঘল সাম্রাজ্যের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়ে তুলনামূলক ভাবে ব্রিটিশ অধীন বোম্বে, কলকাতার অর্থনীতি মজবুত ছিল তাই মাড়োয়ারিরা ১৮৩৫ থেকে ১৮৫০ এর মধ্যে কলকাতা ও বোম্বেতে চলে আসে এবং ধীরে ধীরে স্থানীয় ব্যাবসায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে। ঐতিহাসিক মেধাম কুদেশিয়া বলেন ব্রিটিশ শাসন কালে মাড়োয়ারিরা ব্যাবসায়িক থেকে শিল্পপতি হতে শুরু করে। যার প্রমান দেখা যায় ১৯২০ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে। সে-সময় ভারতের পাট শিল্পে ব্রিটিশদের মোনোপলি শেষ করে মাড়োয়ারিরা। এরপর তারা চিনি ও তুলো শিল্পে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে, এভাবে ১৯৫০ আসতে আসতে ভারতের প্রাইভেট ইন্ডাস্ট্রির অনেকাংশ মাড়োয়ারিদের দখলে চলে আসে। ১৯৯০ আসতে আসতে বিড়লা গ্রুপ, গোয়েঙ্কা গ্রুপ, বাজাজ গ্রুপ সিমেন্ট, গাড়ি, অ্যালুমিনিয়াম, টায়ার কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে নিজেদের অবস্থান শক্ত করে। গুরুচরন দাস বলেন যেখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মাড়োয়ারিরা সাধারন ব্যাবসা করত সেখানে ১৯৭০ আসতে আসতে তাড়া বড় শিল্পপতি হয়ে যায়।

কেন মাড়োয়ারিরা এত সফল??? তাদের ব্যাবসার স্ট্রাটেজিই বা কী? থমাস এ টিমবার্গ তার বই দি মাড়োয়ারিস ফ্রম জগত শেঠ টু বিড়লা তে বলেছেন ব্যাবসা তাকেই লাভবান করে যে ঝুঁকি নিতে পারে। মাড়োয়ারিদের সবচেয়ে বড় গুন হচ্ছে তাদের ঝুঁকি নেবার ক্ষমতা, তাদের এই মনোবল তাদের সফল করে। তারা প্রধানত দুটি বিষয়ে লক্ষ রাখে প্রথমত যেকোনও বিনিয়োগের জন্য ফান্ডিং জোগাড় করতে এবং তাদের তৈরি করা সংস্থা সঠিক ভাবে পরিচালনা করতে। বলা হয় কোন মাড়োয়ারির পকেটে ১০০ টাকা পড়ে থাকলেও তারা সেটা কোন জায়গায় বিনিয়োগ করার কথা ভাবে। লেখল ক্রিতিকা পারওয়াল তার প্রতিবেদন দি সিক্রেট ৫ ইনকাম রুল অফ মাড়োয়ারি তে বলেছেন মাড়োয়ারিরা এমন জায়গায় বিনিয়োগ করে যেখান থেকে লাভ হবে। এরপর তারা লভ্যাংশ রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করে যেখান থেকে মাসে মাসে মোটা টাকা উপার্জন হয়। তারা তাদের আয়ের কীছুু অংশ সামাজিক মাধ্যমে বিনিয়োগ করে যাতে সমাজে তাদের সম্পর্কে একটি স্পষ্ট ধারনা তৈরি হয়। মাড়োয়ারিদের মধ্যে ঐক্য খুব বেশী। একজন মাড়োয়ারি ব্যাবসায়ী নতুন কোনো ব্যাবসা শুরু করলে তাকে সাহায্য করারা জন্য অন্য মাড়োয়ারি ব্যাবসায়ীরা তার কিছু শেয়ার কিনে নেয়। এভাবে একজন ব্যাবসায়ী সফল হলে তার ভাগ সবাই পায়, এজন্য মাড়োয়ারি কমিউনিটি খুবই ঐক্যবদ্ধ। 

মাড়োয়ারিদের মধ্যে আরও একটি ট্রেন্ডিং ব্যাপার হচ্ছে তারা তাদের যে কোন ব্যবসার ফাইন্যান্স ও অ্যাকাউন্টিং এর উপর বেশী জোর দেয়। আদিত্য বিড়লা গ্রুপ ভারতের অন্যতম বড় ব্রান্ড কিন্তু এই কোম্পানির ফাইন্যান্স ও অ্যাকাউন্টিং কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ন্ত্রন করে। উইলিয়াম থ্রনডিক তার আউটসাইডার বইয়ে বিশ্বের বড়বড় কোম্পানির সম্পর্কে লিখেছেন যাদের ফাইন্যান্স ও অ্যাকাউন্টিং কেন্দ্রীয় কমিটি নিয়ন্ত্রন করে। ১৬, ১৭ শতক থেকেই ভারতের বানিজ্য মোটামুটি মাড়োয়ারিরাই নিয়ন্ত্রন করত। যখন ভারতে ইংরেজ শাসন শুরু হয় তখন ইংরেজদের সাথেও তাদের ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায় যার জন্য ইংরেজদের অ্যাকাউন্ট সহ ব্যাবসায়ীক দিক ও তারাই দেখাশোনা করত। মাড়োয়ারিদের সম্পর্কে বলা হয় তারা বিনিয়োগে অর্থের জন্য তারা তাদের স্বাভাবিক জীবন যাপনে বৈভব ত্যাগ করে হলেও ফান্ডিং জোগান করবেই এবং তারা যেকোনও কঠিন পরিস্থিতিতোও নিজেদের মানিয়ে নেয়। যদি বিড়লা গ্রুপকেই দেখা হয় তবে এটা তাদের সপ্তম প্রজন্ম তাও তারা সমস্ত পরিস্থিতিতেই মজবুত ভাবে তাদের ভিত তৈরি করেছে। পাট শিল্প থেকে শুরু করে আজ দেশের ১৪ টি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাবসায়ীক সেক্টর চালাচ্ছে বিড়লা গ্রুপ। ভারতের শেয়ার মার্কেটের দুটি বড় নাম রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা যাকে ভারতের ওয়ারেন বাফেট বলা হয় এবং রাধাকৃষ্ণান দামানিও মাড়োয়ারি কমিউনিটির। শুধু এরাই নয় ফ্লিপকার্টের কো ফাউন্ডার শচীন বনসাল ও বিনি বনসাল, মিন্ত্রার কো ফাউন্ডার মুকেশ বনসাল, লেন্সকার্টের মালিক পীউস বনসাল, জোমাটোর কো ফাউন্ডার দীপেন্দর গোয়েল সহ ওলা, শপক্লুজ, স্ন্যাপডিল, ওয়ো এই সব কোম্পানির কো ফাউন্ডার মাড়োয়ারিই। এরা তো তবু নতুন প্রজন্ম এর আগে সিয়েট টায়ারস, জেকে সিমেন্ট, বাজাজ অটোমোবাইল, রেমন্ডস, আল্ট্রাটেক সিমেন্টের মতো কোম্পানিও মাড়োয়ারিদেরই। রাজস্থানের একটি ছোট এলাকা মাড়োয়ার থেকে বেরিয়ে মাড়োয়ারিরা যেভাবে গোটা ভারতের ব্যাবসায়িক মার্কেটে রাজত্ব করছপ তা সত্যিই অবিশ্বাস্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published.