অ্যামেরিকা

পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হয়েও আমেরিকা কেন এত ঋণগ্রস্থ জানেন?

রাজেশ রায়:— যখনই আমেরিকান অর্থনীতির কথা ওঠে৷ তখন আমাদের মাথায় আসে বিশাল শক্তিশালী একটি দেশের ছবি যার থেকে ক্ষমতাবান কেউ নেই। যার অর্থনীতি বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী ও মজবুত। আমেরিকার অর্থনীতিকে আজও বিশ্বের সবদেশ একটি রোল মডেল হিসেবে দেখে। কিন্তু জানেন কী আমেরিকার অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশী লোন রয়েছে। ২০২২ এর মে মাসের তথ্য অনুযায়ী এই মহূর্তে আমেরিকার উপর প্রায় ৩০.৪৯ ট্রিলিয়ন ডলারের লোন রয়েছে। যদি তুলনা করা হয় তাহলে এই মহূর্তে ভারতের লোন আছে ৬২০ বিলিয়ন ডলার এবং রাশিয়ার লোন আছে প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। ১৯৯০ সাল থেকে আমেরিকার লোন প্রায় ৮০০ গুন বেড়েছে যা আজ সর্বোচ্চ। কয়েক বছর ধরে আমেরিকার লোন ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে। এখন স্বাভাবিক ভাবেই কীছু কথা মাথায় আসবে আমেরিকা কেন এত লোন নেয়? পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ আজ এত ঋণগ্রস্থ কেন? আমেরিকা লোন নেয়ই বা কার কাছ থেকে? এর থেকে বরোনোর উপায় কী? অর্থনীতির এই বিষয় সম্পর্কেই আজ সহজ ভাষায় বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

লোন কোন নতুন বিষয় না, বহু কাল ধরেই বিভিন্ন দেশের সরকার দেশ চালাতে লোন নেয়। ইতিহাসে বিভিন্ন দেশের শাসক বিশাল সংখ্যায় লোন নিয়েছে বিশেষ কিছু কারনে যার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে যুদ্ধের জন্য। যেমন ১৮১৫ সালে নেপোলিয়নের সাথে যুদ্ধের পর ব্রিটেনের ঋণ তার মোট জিডিপির ১৬৪ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। আবার ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেনের ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় তার জিডিপির ২৫৯ শতাংশ। আসলে এই লোন নেওয়া হত দেশের অর্থব্যাবস্থাকে সচল রাখতে। এমনই অবস্থা হয়েছে আমেরিকার সাথে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার ঋণ দাঁড়ায় তার জিডিপির ১০০ শতাংশ বেশী। আজ এই সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ সংখ্যায় পৌঁছেছে। আসলে আমেরিকার তখন এত লোন বা ঋণ বেড়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের অর্থনীতির সংকোচনের জন্য। তবে আজ যে আমেরিকার এত লোন রয়েছে তার অনেক কারন আছে যার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে আমেরিকার ফেডারেল বাজেট। 

আমেরিকার ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ট্যাক্স আদায় করে এবং ফেডারেল সরকারকে তা দেয়। এবার সেই ট্যাক্স কত হবে এবং কী কী বিভাগে তা খরচ করা হবে তা ঠিক করে আমেরিকান কংগ্রেস এবং রাষ্ট্রপতি। অনেক সময় কোন দেশের খরচ তার মোট লাভের তুলনায় কম হয় যাকে বাজেট ঘাটতি বলে। তখনই লোবেট দরকার হয়। আমেরিকায় গত কয়েক বছর ধরেই বাজেট ঘাটতি ক্রমশ বাড়ছে। ২০১৯ সালে আমেরিকার অর্থনৈতিক উন্নতি যথেষ্ট হয় কিন্তু তা সত্বেও সেবছর আমেরিকার বাজেট ঘাটতি দাড়ায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। আমেরিকায় জীবন যাপনের মান প্রচুর উন্নত ও আধুনিক যার জন্য আমেরিকার জিডিপি তার নাগরিকদের জন্য যথেষ্ট নয়। আমেরিকার জিডিপি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ২৩ ট্রিলিয়ন ডলার তাও তার নাগরিকদের খরচ অনেক বেশী। এই জন্য ২০২১ এ আমেরিকার লোন ও জিডিপির অনুপাত ১৩৭.২ শতাংশে পৌঁছেছে এবং তথ্য অনুযায়ী আগামী ৭৫ বছরে এটা বেড়ে ৪৭৫ শতাংশ হবে। আসলে এই ব্যাপক খরচ জানতে হলে প্রথমে আমেরিকার ফেডারেল বাজেট সম্বন্ধে জানতে হবে। আমেরিকার ফেডারেল বাজেট তিন ভাগে বিভক্ত। প্রথমে থাকে জরুরী খরচ, দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে অন্যান্য খরচ এবং তৃতীয় ভাগে রয়েছে লোনের সুদ দেওয়া। 

জরুরী খরচের মধ্যে রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তা, পেনসন, চিকিৎসা ব্যাবস্থা এবং মিলিটারি মাইনে। আমেরিকার মোট জনসংখ্যায় বেশীরভাগ হচ্ছে বয়স্ক মানুষ। তরুন ও কর্মঠ জনসংখ্যার বিপীরতে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা আমেরিকায় তুলনামূলক ভাবে বেশী৷ অন্যান্য খরচের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রতিরক্ষা এবং শিক্ষা খরচ। তবে সবচেয়ে বেশী খরচ প্রতিরক্ষা খাতে। ২০১৯ এ আমেরিকার ডিফেন্স বাজেট ছিল ৭০০ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের প্রথম সারির সাতটি দেশের সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বাজেটের থেকেও বেশী আমেরিকার এই মিলিটারি বাজেট কারন আমেরিকা বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার। এছাড়া আমেরিকান সরকার সর্বদা নাগরিকদের জন্য অতিরিক্গ ট্যাক্স কমানোর চেষ্টা করে। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ হোক কিংবা ডোনাল্ড ট্রাম্প সবাই ট্যাক্স কমিয়েছেন কারন তাদের মতে এতে জিডিপি বাড়বে। আমেরিকাতে প্রতি বছর জিডিপি এক শতাংশ বাড়ার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে কিন্তু অতিরিক্ত কর ছাড়ের জন্য সরকারের লাভও কম হয় যার প্রভাব পড়ে বাজেটে। এসব কারনেই আমেরিকা অতিরিক্ত লোন নেয় বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

এবার জানা যাক আমেরিকাকে এত পয়সা দিচ্ছে কে! আমেরিকার মোট খরচের ৪০ শতাংশই দেয় তাদের ফেডারেল সরকার। এছাড়া এই লোনের এক তৃতীয়াংশ বহন করে আমেরিকার বিভিন্ন সংস্থা, বিনিয়োগকারী, পেনশন প্রকল্প, ব্যাঙ্ক ও স্থানীয় প্রশাসন। সব মিলিয়ে আমেরিকার ৭০ শতাংশ ঋণ আমেরিকা নিজেই বহন করে। বাকী ৩০ শতাংশের মধ্যে ২৫ শতাংশই আসে বিদেশী বিনিয়োগ থেকে। একসময় চীন আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী ছিল কিন্তু এখন জাপান এই জায়গা নিয়েছে। আমেরিকার মোট ঋণের ৪.৪ শতাংশ জাপানের দোওয়া। এনমকী ভারতও ২১৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে আমেরিকাকে। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের কাছ থেকে আমেরিকা কেনো ঋণ নেয়?! এর উত্তর হচ্ছে বানিজ্য। আমেরিকা প্রচুর জিনিস আমদানি করে, ভারতের অন্যতম রপ্তানি বাজার আমেরিকা। আর আমেরিকাতে সমস্ত রপ্তানি হয় ডলারের মাধ্যমে। ডলারকে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও মজবুত কারেন্সি বলা হয়। গত ৭০ বছর ধরে ডলার বিশ্বে তার অবস্থান মজবুত করেছে। এজন্য প্রতিটি দেশ তার বৈদেশিক রিজার্ভ ডলারেই রাখে। ধরুন কোন দেশ আমেরিকা থেকে ১০০ ডলার কিনল, আমেরিকা তখন একটা কাগজে ১০০ ডলার লিখে দিয়ে দিল একে ডলার বন্ড বলে, এর উপর ২-৪ শতাংশ সুদ চাপায় আমেরিকা। এই বন্ড বিক্রি করে আমেরিকা তার খরচ কীছুটা চালায়। আজ পর্যন্ত আমেরিকা তার শত্রু দেশের পর্যন্ত ডলার বন্ড নষ্ট করে নি যেজন্য আমেরিকার উপর সব দেশ বিশ্বাস করে। এই কারনে ভারত সহ বহু দেশ আমেরিকায় বিনিয়োগ করে। এবার জানা যাক আমেরিকার এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার উপায়।

১৯১৭ থেকে আমেরিকা প্রায়ই তার ডেবট সেলিং বৃদ্ধি করে আসছে। কোন দেশ কতটা ঋণ নিতে পারবে তার একটা সীমা আছে তাকে ডেবট সেলিং বলে। আমেরিকা ১৯১৭ থেকে যখন মোট ঋণ ডেবট সেলিংকে ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে তখনই ডেবট সেলিং এর মান বাড়িয়ে দিয়েছে, এখনও পর্যন্ত আমেরিকা ১০০ বারেরও বেশী ডেবট সেলিং বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এবার আমেরিকার ঋনের বোঝা রেকর্ড ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে যার কারনে অনেক বিশেষজ্ঞের ধারনা যদি আমেরিকা তার ডেবট সেলিং না বাড়ায় তাহলে আপনা আপনি লোন নেওয়া কমে যাবে। কিন্তু এটা সম্ভব নয়। কারন ৩০ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণের উপর আমেরিকাকে আগামী দশকে শুধু সুদ দিতেই হবে ৪.২ ট্রিলিয়ন ডলার। এখন আমেরিকা যদি তার কর্মচারীদের মাইনে কমিয়ে, বিভিন্ন প্রজেক্ট বন্ধ করে খরচ কমায় তাহলে আগের ঋনের সুদ দিতেই আমেরিকার সমস্যা হবে। এর প্রভাব পড়বে দেশের জনগনের উপর, সাধারন মানুষের গাড়ি, ঘরের লোনে সুদ বাড়বে, বন্ডে সুদ বাড়বে। ফলে আমেরিকার জিডিপি কমবে,  দেশে মূল্যবিদ্ধি হবে এবং আমেরিকার অর্থ ব্যাবস্থা পুরো ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এর পুরো প্রভাব পড়বে ভারতের মতো দেশের উপর। 

ভারত সহ বহু দেশে আমেরিকাতে প্রচুর রপ্তানি করে, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে আমেরিকার অর্থব্যাবস্থা ভেঙে পড়া মানে গোটা বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামোই বিপদের মুখে পড়বে। কিন্তু আমেরিকার কাছে একটি অস্ত্র আছে তা হচ্ছে যতখুশি তত পয়সা ছাপানো। আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন আমেরিকা যখন খুশি পয়সা ছাপাতে পারে। আসলে গোটা বিশ্ব নির্ভর করে আমেরিকান ডলারের উপর যা আমেরিকাকে যত খুশি পয়সা ছাপানোর লাইসেন্স দিয়েছে। বিশ্বের আর অন্য কোনও দেশ এটা পারে না। গোটা বিশ্ব যখন করোনা মহামারীর কারনে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল তখন আমেরিকা নিজের মর্জি মতো পয়সা ছাপিয়েছে। আজ বিশ্বে মজুত থাকা মোট ডলারের ৪০ শতাংশই ২০২১ সালে ছাপানো! এই জিনিসটাই যদি অন্য কোনওদেশ করত তাহলে আজ দেওলিয়া হয়ে যেত। এজন্য আমেরিকা যত ঋণই নিক কিংবা আমেরিকাতে যতই মূল্যবৃদ্ধি হোকনা কেন আমেরিকান অর্থনীতি সর্বদা মজবুতই থাকবে। তবে আমেরিকার এই লোন নেবার ব্যাপারটা ঠিক নাকী ভুল!! দেখুন আমেরিকার তার শক্তিশলী মিলিটারি পাওয়ার, রিসার্চের জন্য ব্যাপক লোন দরকার। তাছাড়া আমেরিকা বিশ্বের বহু দেশকে প্রতিবছর অনেক অর্থ সাহায্য করে। বিশ্বের প্রতিটি উন্নত দেশ, কোম্পানী সবাই তাদের অর্থনীতি মজবুত করবার জন্য লোন নেয়। কোন দেশ কোথাও থেকে লোন নিয়ে ৪-৫ শতাংশ সুদে সেই লোন শোধ করতে পারে। এতে দেশটির একবারে নিজের থেকে এত অর্থ খরচ করতে হয় না। বরং এই অর্থ বাঁচিয়ে দেশটি এই অর্থ অন্য কোথাও বিনিয়োগ করতে পারে যেখানে থেকে ১০-১২ শতাংশ বেশী ফেরত পাওয়া যাবে। বিশ্বের অর্থনৈতিক মডেল ও লোন নেবার প্রক্রিয়া এভাবেই চলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.